মধ্যরাতের স্বাধীনতা ও আহত বিবেক

দীপেন্দু চৌধুরী

আধখানা মুখ বাইরে রেখো, আধখানা মুখ অন্ধকারে,

দূর থেকে যেন সবাই তোমায় দেখতে পারে।

আধখানা মুখ, শঙ্খ ঘোষ

কথাটা মেনে নিতেই হচ্ছে, মানচিত্র জুড়ে ভাগ হয়ে যায় ঈশ্বর, ভালবাসা এবং পৃথিবী। নদী ভাঙ্গে, গঙ্গা ভাঙ্গে, পদ্মা ভাঙ্গে। জলের স্রোত তলিয়ে দেয় বাস্তুভিটে, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধন। তলিয়ে যায় আবেগ, মুঠো মুঠো অহংকার। আমরা আজও থাকি শিকড়ের সন্ধানে। ব্যক্তি জীবন, গোষ্ঠী জীবনের জন্ম-মৃত্যু চক্রের অনিবার্য ভাঙন-গড়ন, বৃহত্তর প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়ে যায়। সামাজিক অভিঘাত প্রকৃতির ভাঙনের থেকেও আরও মর্মান্তিক হয়ে দাগ কেটে দেয় আমরা অসহায়ের মতো মেনে নিই। বাংলার মাটি বাংলার জল ভাগ হয়ে যায়। হাবিবগঞ্জের জালালি কইতর ‘ডানা ভাইঙা’ কইলকাতায় এসে পড়েছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে এই সত্য আমরা খুঁজে নিতে পেরেছিলাম। ট্রেনের চাকা থেমে গেলেও পদ্মা-গঙ্গার সুর থামাতে পারেনি কেউ। ঘরে-বাইরে ভাঙনের মর্মন্তুদ যন্ত্রণা নিয়েই আমরা ‘বার ঘর এক উঠোন  আটপৌরে সমাজ গড়েছিলাম।

কলোনি উত্তর বৃহত্তর আঙিনা

‘এ আমার দেশ এ আমার উপত্যকা নয়’ বলতে পারলে ভাল হত। কিন্তু বলার অবকাশ নেই। দেশভাগের যন্ত্রণাকাতর মুখগুলির কথা আমাদের মনে পড়ে। আমাদের যৌথ পরিবারে, যৌথ সমাজে আমরা ওই মুখ দেখেছি। কতদিন তারা নির্বাক ছিল।ইজেলের ক্যানভাসে শিল্পীর চোখে যেন চলমান নির্বাক ছবি। স্মৃতিকাতর ম্লান মুখগুলি আজও আমার মনে পড়ে। আমি দেখেছি, হযা আমি দেখেছি আমার আত্মার আত্মীয়দের। একটা অখন্ড দেশের অখন্ড পরম্পরার সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে উঠেছিল কলকাতা, কাকদ্বীপ, কোচবিহার, ঢাকা, যশোর, নোয়াখালীতে। এবং লাহোর সহ দুই পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। নতুন উপত্যকা গড়ে উঠেছিল না গড়তে বাধ্য করেছিল? দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাষ্ট্রের ও স্বদেশী চেনা সভ্যতার কতকগুলি অচেনা মানুষ? দেশভাগের প্রাদেশিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করার আগে আমরা দেশভাগ কেন্দ্রিক একটি অমানবিক সামাজিক ক্ষতকে দেখে নিতে চাইছি। তাহলেই সম্ভবত আমরা প্রাদেশিক প্রেক্ষাপটে চলে যাওয়ার সূত্র খুঁজে পাব। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আমরা ভারত নামক খন্ডিত এক স্বাধীন দেশ পেলাম। যে দেশ মেনে নিতে পারেননি জাগরীর লেখক সতীনাথ ভাদুড়ি। আহত বিবেক নিয়ে  গাঁধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-র লেখক পূর্ণিয়ার আশ্রমে গিয়ে বসবাস করেন।       আমাদের স্বাধীনতার আবেগ থমকে গেল। আমরা আনন্দশ্রু নিয়েও গুমরে থাকলাম। পাকিস্তান নামে একটি প্রদেশ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। স্বজন হারালাম, প্রতিবেশী ফেলে এলাম। দেশভাগের উপর নির্মিত টেলিভিশনের জন্য নির্মিত ছবি ‘তমস’ মনে পড়ছে। ভীষ্ম সাহানীর লেখা সাহিত্য অ্যাকাডেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটির পরিচালক ছিলেন গোবিন্দ নিহালনী।       যন্ত্রণাকাতর দেশভাগের ঐতিহ্যবাহী চিরায়ত অনুভবি সংস্কৃতি খান খান হয়ে গেল। এক বুক বিষাদ নিয়ে মধ্যরাতের উৎসব দেখেছিলাম। স্যার র‍্যাডক্লিফস লাইন মেনে ভারত ভাগ হয়েছিলঅবশ্য মূলত ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কেউ কেউ এমনটা দাবি করে থাকেন। বর্তমানে সে দেশ আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এটাও কী ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের আরও একটা প্রাদেশিক প্রভাব? সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলেন ভারত বিভাগের মুখ্য স্থপতি। এই বিষয়ে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদরা প্রমাণসাপেক্ষ অভিমত দিতে পারবেন।

আমরা উত্তর দেশভাগ সময়ের অন্যতম আলোচ্য বিষয় উদ্বাস্তু সমস্যা এবং আন্দোলন ফিরে দেখতে চাইছিপশ্চিমবঙ্গে রক্তাত্ত দেশভাগের ক্ষত হিসাবে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৫০ লক্ষ উদ্বাস্তু আশ্রয় নেয়। এই দেশ আমার উপত্যকা নয় মেনে নিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ৪০ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ আসে কলকাতা মহানগরের শহরতলিতে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে এই স্রোত আছড়ে পড়ে। এবং ১২ লক্ষ মানুষ আসে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে। তৎকালীন জনগণনার হিসাব দাবি করছে, ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ৪,৩৩,০০০ বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসে।তাঁরা প্রথমে অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ শিয়ালদহ স্টেশনেও অস্থায়ী ভাবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথম দিকের হিন্দু উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাঁদের সঙ্গে কলকাতা শহরের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। তৎকালীন সদ্যগঠিত কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার প্রস্তুত ছিল না এই উদ্বাস্তু স্রোতকে সামলানোর জন্য। ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছিল ভিটে-মাটি হারানো ছিন্নমূল স্রোত। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল উদ্বাস্তু কলোনিকলোনিগুলির নামকরণের মধ্যেই জড়িয়ে আছে প্রাদেশিক রাজনীতি এবং গণআন্দোলনের প্রভাব। যেমন ‘বাপুজীনগর’। মহাত্মা গাঁধীর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই নামকরণের মহিমা। নেতাজীনগর সুভাষচন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা হয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে আশুতোষকলোনি রাখা হয়। সুচেতাকলোনি হয় সুচেতা কৃপালিনীর নামে। মাস্টারদা সূর্য সেনের নামে সূর্যনগর। স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান ব্যক্তিত্বদের স্মরণে এই নামকরণ। যারা প্রত্যেকেই কংগ্রেস রাজনীতির আদর্শবান লোক ছিলেন। এই বাঙলার বিভিন্ন জেলায় একইরকম ভাবে উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর নামকরণ স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্বের নামে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও পূর্ব বঙ্গের নিজেদের অঞ্চলের নামকে বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু পাড়ার লোকেরা।  



ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দু’দিকের দুই সীমান্ত পার হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ভারতে চলে আসেন লক্ষ লক্ষ্য ছিন্নমূল মানুষ। ১৯৫১ সালের জনগণনার পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হয়ে যারা ভারতে আসেন তাঁদের সংখ্যা ছিল ৩০ লক্ষ।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                       তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ১৯৫৪ সালে ‘ডিসপ্লেসড পার্সনস কমপেনসেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ আইন আনে। এই আইনে ১৯৪৭ সালের ১ মার্চের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। এই আইন বলে আরও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষদের। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান বা  সাবেকি পূর্ব বাংলা থেকে যে সব ছিন্নমূল মানুষ এই বাঙলায় এলেন তাঁরা কি সেই আইনের সব অধিকার পেয়েছিলেন? ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(২০১৬) সংসদে পেশ হওয়ার পর এই প্রশ্ন উঠেছিল

স্বজনহারা মধ্যরাতের মিলনান্তক ও বিয়োগান্ত ধারা

আমরা ইতিহাস লিখছি না, ইতিহাস লেখার কাজ আমাদের নয়। ইতিহাসবিদেরা ইতিহাস লেখেন। সমাজ যত উন্নত হয়েছে, গণমাধ্যম যত জনপ্রিয় হয়েছে, ইতিহাসের গতিপথ ততই বাস্তবসম্মত ও মসৃণ হয়েছে। নতুন ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধান ও লব্ধঞ্জানে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আধুনিক ইতিহাসবিদদের অভিমত গড়পড়তা ইতিহাস লেখার সময় প্রাধান্য পেয়েছিল আধিপত্যবাদী শক্তি বা বিজয়ীপক্ষের মাহাত্মপ্রচার। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘হিস্ট্রোরিয়োগ্রাফি’। এই একদেশদর্শী ‘কমিটেড’ ভাষ্যের প্রতি-উত্তরে লেখা হয় প্রতি-ইতিহাস। প্রতি-স্পর্ধার জন্ম হয়। উত্তর আধুনিক প্রজন্মের ইতিহাসবিদদেরর অনুসন্ধানে প্রতি-ইতিহাস সামাজিক ক্যানভাসে উঠে আসে। আমরা নবনায়ন আলোকেবৃত্তে প্রবেশের অধিকার অর্জন করি। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারত নামক পরাধীন দেশটি  স্বাধীনতা পেল অনেক ঘাম, অনেক রক্ত বহু আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে উপমহাদেশ দীর্ঘ লড়াই, রক্ত প্লাবিত বহতা রক্তনদী পেরিয়ে তবেই স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তারপরেই আমরা ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’ উচ্চারণ করেছি। সহস্র আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজল থেকে ভারত মুক্তি পায়। এটাই ঐতিহাসিক সত্য।

                                                                                                                                         ১৫ অগস্ট দিনটি আসার অনেক আগেই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চতুর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তি অনুমান করতে পেরেছিল। ইতিহাসবিদরা বলছেন, ১৯৪৭ সালের পনেরই অগস্টের পটভূমি পনের মাস আগের ঘটনা পরম্পরায় নিহিত রয়েছে। তাঁরা বুঝে গিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে আর বেশিদিন শাসন করতে পারবে না। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত স্তরের আপামর ভারতীয়দের স্বাধীনতার লড়াই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে। তাই ব্রিটিশ শক্তি ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ ভিক্টোরিয়ান কৌশলী রাজনীতির প্রয়োগ শুরু করে। যে রাজনীতি ব্রিটিশ রাজনীতির কূটনীতিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারই অন্যতম ফসল ছিল দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ। জটিল সেই ঘটনা প্রবাহে দু’টি সমান্তরাল ধারার কথা বলছেন ইতিহসবিদরাএক সাংবিধানিক পথ ও পন্থা। এবং পরবর্তী সময়ের অস্থির অচলবস্থা। আর দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মোকাবিলা।     

এই প্রস্তুতির অন্যতম মঞ্চ ছিল পূর্ব পরিকল্পিত বাংলার দুর্ভিক্ষ বা পঞ্চাশের মন্বন্তর। পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রাসঙ্গিকতা বাদ দিয়ে দেশভাগের প্রাদেশিক প্রভাবের কথা লেখা হবে অর্ধেক সত্য। আমাদের দায় যেমন থেকে যায়। তেমনি দায়বদ্ধতার সঙ্গেই পঞ্চাশের মন্বন্তর উচ্চারণ করতে হবে। আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগে ১৯৪৩ সালের জুলাই-অগস্ট মাসের সংবাদপত্রের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে, দুর্ভিক্ষের সংবাদ ও ছবি। যে খবর এবং ছবি আজও আমাদের বিমূঢ় করে দেয়। অস্থিসার মানবশরীর আর মৃত, অনাহারবিকৃত আমারই প্রদেশের কোনও এক প্রতিবেশির ছবি। খবরের বৈপরীত্য উঠে আসছে সংবাদপত্রে, প্রচুর চাল রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের আন্তর্বিরোধী চিত্র দেখে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান আমরা বুঝতে শিখি। অনেক অনেক পরে আমাদের এই বোধ তৈরি হয় খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিঞ্জানীদের অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণী ব্যাখ্যায়। তৎকালীন অমৃতবাজার পত্রিকায় ৭-৮ অগস্ট  প্রকাশিত খবর, অনাহারে মৃত্যুর সংবাদে তোলপাড় বিধানপরিষদ। শহরের অঞ্চলে অঞ্চলে লঙ্গরখানা খোলা হচ্ছে। ১৩ অগস্ট সংখ্যায় অমৃতবাজার পত্রিকা লিখছে, বিগত কয়েক মাসে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের চাল।

বাঙলায় তখন মুসলিম লিগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা প্রিমিয়ার ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। খাদ্য সরবরাহ দফতরের মন্ত্রী ছিলেন এইচ এস সোহারাবর্দি। তিন বছর পরে সোহারাবর্দি বাঙলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার নাম ইতিহাসে আছে। প্রখ্যাত লেখক এবং ম্যাজিস্ট্রেট অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথায় সোহারাবর্দি ছিচল্লিশের পূর্ব পরিকল্পিত দাঙ্গার অন্যতম মন্ত্রণাদাতা ছিলেন। ১৯৪৩ সালের ৯ অগস্ট দৈনিক পত্রিকা লিখছে, খাদ্যমন্ত্রী সমাজকর্মীদের কাছে আবেদন করছেন নতুন নতুন অঞ্চলে লঙ্গরখানা বা ‘ফ্রি কিচেন’ খোলার জন্য। কারণ পরের মাস থেকে অবস্থা আরও খারাপ হবে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে অবস্থা আরও খারপ হবে বলে প্রাদেশিক সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। যদিও একাধিক সামাজিক সংগঠন আগে থেকেই কলকাতায় লঙ্গরখানা খুলে দিন-রাত্রী খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি, মাড়োয়ারি রিলিফ সোসাইটি, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। এছাড়াও ছিল স্থানীয় ক্লাব বা সংগঠন। কলকাতা, হাওড়া, চব্বিশ পরগণায় যেমন লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল পাশাপাশি পূর্ব বঙ্গের ঢাকাতেও লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। এই বাঙলার জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ছিল মেদিনীপুরে।

১৯৪৩ সালের অগস্ট মাসের সংবাদপত্রের খবর, অনাহারক্লিষ্ট, জীর্ণ চেহারার অসুস্থ গ্রামের লোক রাজপথে পড়ে আছে। কারণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মানুষের ঠাসা ভির। কলকাতা কর্পোরেশন কতৃপক্ষ চার্চিল এবং রুজভেল্টকে চিঠি লিখছে। চিঠির আবেদনে কাতর প্রার্থনা আমাদের জন্য কিছু করুন। বাঙলার মানুষ যে অপুষ্টিতে মরতে বসেছে। ১৭ অগস্টের খবর, অনাহারক্লিষ্ট হাড় জিরজিরে ৬০ জনকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁদের মধ্যে চার জন মারা গেছে। ২০ অগস্টের কাগজে এই খবর প্রকাশ হয়। ২২ অগস্টের কাগজে আরও একটা খবর আমাদের নজরে পড়ে। বাঙলার প্রাদেশিক সরকার ঘোষণা করে অক্টোবর মাস থেকে গণ সরবরাহ(রেশনিং)ব্যবস্থার মাধ্যমে সস্তা দরে চাল দেওয়া হবে। ওই একই পৃষ্ঠায় খবর ছাপা হচ্ছে, অগস্ট মাসের প্রথম দিকে ২০ হাজার টন চাল শহরে এসে পৌঁছেছে।

দুর্ভিক্ষের পরে পরেই প্রশ্ন উঠেছিল এত চাল যদি এসেই থাকে গণ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়নি কেন? সেই মজুত চালই বা কোথায় পাঠানো হয়েছিল? প্রশ্ন আরও উঠেছিল রেশন ব্যবস্থা চালু করার পরেও কেন অনাহারে মৃত্যু ঠেকানো গেল না? খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের গবেষণায় এই সত্য উন্মোচিত হয়েছে। মনুষ্য সৃষ্ট পঞ্চাশের(১৩৫০)মন্বন্তর বা ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিলেন চালের অভাবে নয়। খাদ্য কিনতে পারার মতো ক্রয় ক্ষমতার অভাবে। অধ্যাপক সেনের ভাষায় এই অবস্থা ছিল ‘কেপ্যাবিলিটি ডিপ্রাইভেশন’। অর্থনীতিবিদ, সমাজবিঞ্জানী এবং ইতিহাসবিদদের অভিমত পঞ্চাশের মন্বন্তরও ছিল দেশভাগের অন্যতম কূটনৈতিক কৌশল। যার মদতদাতা ব্রিটিশ শাসকরা।  

ব্রিটিশ শাসকদের বাংলা ভাগের পরিকল্পনা ছিল বহু বছর আগে থেকেই। আমরা ১৯০৫ সালের কথা জানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একক প্রচেষ্টায় সে দফা ভারতভাগ বা বাংলা ভাগ আটকে গেলেও ১৯৪৭ সালে যা সফল হল।ম্নে পড়ছে মিথ হয়ে যাওয়া ছড়ার লাইন ‘তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ কর।’ বাঙলার দুর্ভিক্ষের পরেই বাংলা নির্ভর জাতীয় রাজনীতি মূলত দিল্লি এবং লাহোর নির্ভর হয়ে পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা লাভ এবং ভারত বিভাজন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দু’টি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন তর্কবিতর্কের অবকাশ রয়েছে। প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই উঠেছিল ভারত কী প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা পেয়েছিল? না ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল? ইতিহাস দাবি করছে, গণপরিষদের সদস্য শীর্ষ কংগ্রেস নেতা ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারত ভাগকে অভূতপূর্ব পরিস্থিতির বেদনাদায়ক পরিণতি বলে অভিহিত করেছেন। সেই বেদনাদায়ক পরিস্থিতির দগদগে ক্ষত আজও আমাদের বয়ে বেরাতে হচ্ছে। দেশভাগের প্রাক্কালে দাঙ্গায় ১০-১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার জন্য কে বা কারা দায়ী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বৃহৎ প্রেক্ষাপট প্রয়োজন। আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না। দেশভাগের জন্য কোনও দল বা নির্দিষ্ট ধর্ম্যাবলম্বী মানুষেরা দায়ী নয়। দায়ী ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। যার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের সূতিকাগৃহে। যা নিহিত ছিল পরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আর্থসামাজিক ব্যবধান। সেই উৎসের চরম পরিণীতি তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম। যার মূল্য চোকাতে হয়েছে উপ মহাদেশের বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারকে। অভিশপ্ত সেই অভিঘাতের বোঝা আজও আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি। 

যে কারণে গুজব বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতসহ খণ্ডিত দু’ই পাকিস্তানে।দাঙ্গার বীভৎসতায় সধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দলে দলে একটু আশ্রয়ের আশায় ছুটে আসে আমাদের বাঙলায়সাবেক পূর্ববঙ্গ থেকে ছুটে আসা মানুষের দল কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ঠাঁইনাড়া মানুষ একটু আশ্রয়ের আশায় জলা-জঙ্গল পতিত জমি সাফ করে ‘বন কেটে বসত’ তৈরি করে। কাঁচা রাস্তা, বাপুজীনগর অঞ্চল তখন ঘন জঙ্গল আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা যেন এক মায়াময় আমার সোনার বাঙলা তখন প্রতিদিন চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, যশোর, ঢাকা, মৈমনসিংহসহ পূর্ববঙ্গের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসছে, যাদবপুর, বাঘাযতীন, বিজয়গড় অঞ্চলে। রাজা এস সি মল্লিক রোডের নাম তখন লেডি ওয়েলিংটন রোড। ওই অঞ্চলের রুটে একমাত্র বাস চলে ৮০ নম্বর। বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে গড়িয়া হয়ে টালিগঞ্জ ট্রামডিপো পর্যন্ত চলত। দলছুট মানুষ দলবদ্ধ হওয়ার আশায় বাঁশ, বাখাড়ির বেড়া, টালির চাল দিয়ে ঘর তৈরি করে নিয়েছিলউদ্বাস্তু কলোনিতে বরাদ্দ ঘর তৈরি হল পাঁচ হাত বাই সাত হাত। এবং দশ ফুট বাই দশ ফুট। খাটিয়ায় খড় বিছিয়ে শুতে হত নতুন যুগের নতুন সভ্যতার উদ্বাস্তু মানুষদের। এই সব ঘরে প্রায়ই শিয়াল ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। নয়া বসতের মানুষজন স্বপ্নে নীলকন্ঠ পাখি খুঁজত।

বাপুজীনগর কলোনিতেও ছিল কাঁচা রাস্তা। ওই অঞ্চলে পাকা বাড়ির কথা কেউ ভাবতেও পারত না। বর্ষায় জল জমে থাকে, কাঁচা পাকে হাটু ডুবিয়ে মানুষ চলা ফেরা করত। বিদ্যুতের আলো ছিল না। হ্যারিকেনের আলোই ভরসা। কাছের কৃষ্ণা গ্লাস কারখানা ও সুলেখা কারখানার বৈদ্যুতিক আলো এসে ঠিকরে পড়ত কলোনির আঙিনায়। ঘরে ঘরে কলেরা আর ম্যালেরিয়া রোগী। মানুষের তৈরি সেই সভ্যতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে আধুনিক সভ্যতার বাল্মিকদের।    

সারা রাজ্য জুড়েই তখন সংগঠিত হচ্ছে উদ্বাস্তু আন্দোলন। আন্দোলনকে এক মঞ্চে আনতে এবং বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য গঠিত হয় সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা সমিতি(ইউসিআরসি স্বজন ও স্বদেশ হারানো উদ্বাস্তুরা লড়াইয়ের মানসিকতা থেকেই নিজেদের অঞ্চলকে ‘দুর্গ ভাবত।’ যে কারণে অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল ‘বিজয়গড়’, ‘রামগড়’ ইত্যাদি। ‘গড়’ শব্দের অর্থ দুর্গ। সরকারের ঔদাসিন্য ও পুলিশি হয়রানির সঙ্গে লড়াই করেই গড়ে উঠল জবর দখল কলোনি। ১৯৫০ সালে বাঘাযতীন অঞ্চলে গঠিত হয় সম্মিলিত উদ্বাস্তু বালক এবং বালিকা বিদ্যালয়। শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশন সহ কলকাতার বিভিন্ন অফিসে অফিসে কৌটো ঝাঁকিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন কলোনির মানুষ। শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সভ্যতা গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ছিন্নমূল মানুষগুলিকেগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের প্রথমদিক থেকে টানা আশির দশক পর্যন্ত নতুন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। উদ্বাস্তু কলোনির চিন্তাশীল মানুষের নেতৃত্বে। মধ্যরাতের স্বাধীনতা এসছিল আহত বিবেকের হাত ধরে। উদ্বাস্তু কলোনির মানুষ নিজেদের স্বার্থে এই বাঙলার সংস্কৃতি গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিল। আধুনিক শহরতলি বেষ্টিত একুশ শতকের কল্লোলিনী কলকাতা মহানগর অনেকটাই ঋণী হয়ে আছে পূর্ব বঙ্গের ছিন্নমূল মানুষের চিলেকোঠার ঘাম আর রক্তে।

গ্রন্থঋণ

এই সময়, অন্নদাশঙ্কর রায়

বিপনচন্দ্র সম্পাদিত Indian Struggle for Independence(দিল্লি ১৯৮৮)

‘আজকের ভারত ও জাতীয়তার সমস্যা’, প্রবন্ধ, তরুণ রায়, অনীক, অক্টোবর-নভেম্বর সংখ্যা, ১৯৯১ এবং বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকা।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

                                                         

 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?