দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার
দীপেন্দু চৌধুরী
নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এমনই এক পরিবার ওদের। উচ্চ মাধ্যমিকে এবং জয়েন্টে পর পর ভালো রেজাল্ট করলেও বাবা বলেছিলেন, ‘’আমি
আর পড়াতে পারব না। অত টাকা পাব কোথায়? আমার শরীর ভালো নেই। তুই আমার দোকানে বসে
ব্যবসা কর।’’ বাবা খুব ছোট একটা ষ্টেশনারী দোকান চালিয়ে ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক
পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে হেরে যেতে চায়নি। ছোট থেকে অঙ্কে ভালো হলেও বাড়ির
অভিভাবক এবং আত্মীয় বন্ধুদের কথায় আর্টস নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয় ওকে। সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে
আশিসকে। পরে কলেজের বিঞ্জানের শিক্ষক এবং বন্ধুদের পরামর্শে কলা বিভাগ থেকে বিঞ্জান
নিয়ে পড়াশোনা করে আশিস। নিজের মনের জোর এবং প্রাইভেট টিউশন করে আশিস ওয়েস্ট
বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (ডব্লিউ বি ইউ টি) থেকে এম সি এ পাশ করে। এই
পর্যন্ত আর পাঁচটা চেনা গল্পের মতো ছিল। কিন্তু তারপরের ঘটনা আমাদের চমকে দেয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সোনারপুরের আশিস ঘোষ
কম্পিউটার বিঞ্জানে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছে। আশিসের গবেষণার শিক্ষক ডঃ
শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং আশিস যৌথভাবে কম্পিউটার বিঞ্জানে এই গবেষণা করেছেন। নতুন
গবেষণা পত্র (উদ্ভাবনী কম্পিউটার বিঞ্জান)‘ইন্টারন্যাশন্যাল জার্নাল অব
ম্যাথেমেটিক্স অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশন’’ ডিসেম্বর ২০১৮,http://ijmaa.in/v6n4.html) পত্রিকায়
প্রকাশ হয়েছে। এই গবেষণা পত্রে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সহ গণিতের একটি নতুন Theorem: I = w102 (Square) এবং জ্যামিতির একটি নতুন Principle: GW or G ∝ A when F- sheet is constant বিশেষভাবে
উল্লেখিত হয়েছে। গবেষক অধ্যাপক ডঃ ভট্টাচার্য এবং তার ছাত্র আশিসের দাবি, এই নতুন
আবিষ্কৃত Theorem এর সাহায্যে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ আকারের বহু বক্ররেখা বেষ্টিত সমতল
ক্ষেত্র পরিমাপ করা সম্ভব হবে। সে পৃথিবীতে হোক অথবা মহাকাশে অবস্থিত গ্রহ, উপগ্রহ
হোক, সর্ব ক্ষেত্রেই এবং সমস্ত স্থানেই কম্পিউটার বিঞ্জানের এই নতুন আবিষ্কার কাজে
আসবে।
প্রচারবিমুখ ডঃ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, প্রায়
তিনশো বছর আগে আবিষ্কার হওয়া এই ধরণের পরিমাপ করার ফর্মুলা আজও প্রচলিত আছে। কিন্তু
এই পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য জটিল জ্যামিতির অঙ্কনের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে গণনা করার
প্রয়োজন হয়। এতেও সব সময় নির্ভুল ফল পাওয়া যায় না। নতুনভাবে আবিস্কারের এই
পদ্ধতিতে কোনও জটিলতার সম্ভবনা নেই। স্বল্প ব্যায়ে, কম
পরিশ্রমে এবং কম সময়ে নির্ভুল গণনা করা সম্ভব হবে। আকস্মিক দুর্যোগের সময়ে, ভয়াবহ
বন্যা, ভূমিকম্প, আগুনে পুড়ে যাওয়া অঞ্চল প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত পরিমাপ করার
প্রয়োজনে আবিষ্কৃত এই নতুন পদ্ধতি কম্পিউটার বিঞ্জানের কাজে আসবে।
নিজের পড়া চালাতে এবং গবেষণার কাজ করার সময়
নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিতে হয়েছে আশিসকে। বাবার দোকানে দিনে সময় দিয়ে রাত
জেগে পড়া চালিয়ে গেছে সে। সাহায্য করেছেন মা। নিজের পড়া এবং গবেষণার কাজ চালিয়ে
যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ বাবার দেখভাল করার দায়িত্ব আশিস নিজের কাঁধে তুলে
নিয়েছে। বাড়ির এক এবং একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে। উচ্চ শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক
রাখার ক্ষমতা আশিসের ছিল না। বন্ধুদের থেকে বই চেয়ে নিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছে
আশিস।
ছেলেকে পড়াতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন
গোবিন্দবাবু। আশিসের বাবা গোবিন্দ ঘোষ। তিনি বললেন, ‘’আমি দেনা করে, ওর মায়ের সব
গয়না বেঁচে আশিসকে পড়িয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ও জয়েন্টে আমাকে না জানিয়ে পরীক্ষা
দিয়েছিল। তার পরেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার সব কিছু দিয়ে ওকে পড়াব।‘’
আশিসের
নিজের কথায়, ‘’কম বয়স থেকেই আমার অঙ্ক খুব ভালো লাগত। আর্টস নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে
ভর্তি হয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমার অঙ্কের বিষয়ে আগ্রহ দেখে কলেজের এক শিক্ষক
আমাকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়তে বলেন। আমি জয়েন্ট এন্ট্রাস পাশ করে কলেজে পড়তে
পড়তে গবেষণার কাজ শুরু করি। তারপর আমার ‘গাইড’, আমার গবেষণার শিক্ষক অধ্যাপক
ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। তার সঙ্গে যৌথভাবে এই কাজ করে আমি নিজে গর্ব
বোধ করছি। তার কাছে আমি কৃতঞ্জ।‘’
দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুভাষ গ্রামের ঠিকানায়
বর্তমানে বসবাস করেন অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। প্রায় নব্বই বছর বয়সী ডঃ
ভট্টাচার্য বহরমপুর কলেজের শরীর বিঞ্জানের প্রাক্তন অধ্যাপক। ইতিমধ্যে তিনি আরও বিভিন্ন
বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার কাজ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা এবং
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। তিনি অধ্যাপনার কাজে
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর যুক্ত ছিলেন। প্রচারবিমুখ
ডঃ ভট্টাচার্য বলেন, ‘’আমার বয়স হয়েছে। আশিসের সঙ্গে এই কাজ করে আমি সফল। আশিস খুব
কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়েছে। আশিস সহ আমার সমস্ত গবেষক এবং মেধাবী ছাত্রদের সাফল্যই
আমার সাফল্য।‘’
Comments
Post a Comment