লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?



দীপেন্দু চৌধুরী
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়......
                  দিন বদলায় না!
রাজা আসে যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আজ মনে পড়ছে বিগত  শতাব্দীর আশির দশকের কথা। স্মৃতি থেকে স্মরণ করি। আশির দশকে দু’বার জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন আমাদের নজর কেড়েছিল। আশির দশকের প্রথমার্ধ এবং শেষার্ধ দু’দফায় এই আন্দোলন হয়। মনে রাখতে হবে মসনদে তখন বামফ্রন্ট সরকার। গরিবদরদী, কৃষক শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষের সরকার। সেই সরকারের স্বাস্থ্যনীতি তথা রাজ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবার বিঞ্জানসম্মত পরিকাঠামো গড়ে তোলা, ইন্টার্ন, জুনিয়র ডাক্তারদের ভাতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহ একগুচ্ছ দাবিতে ওই আন্দোলন হয়েছিল। আমি নিজে একটি গণসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ওই সময়টা কিছু ডাক্তারদের কাছাকাছি ছিলাম। আজকের বাস্তবতায় খুব মনে করতে পারছি, আশির দশকের ‘জুনিয়র ডাক্তার’ আন্দোলনের একটা গোপন আদর্শ ছিল। এবং একটা সুনির্দিষ্ট দিশা ছিল। যে দিশা অবশ্যই মানবসেবা। যে আদর্শ পরবর্তীতে রাজ্যে কয়েকটি ‘শ্রমজীবী হাসপাতাল’ গড়ে তুলতে পেরেছে। মানবসেবাকে সামনে রেখেই এই আন্দোলনের শুরু। যে সেবার কথা আমরা গল্প উপন্যাসে পড়ি।
গত কয়েকদিন ধরে আমাদের রাজ্যে চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিবাদে রাজ্যের চিকিৎসকদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলনে রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এতটা সফল এবং স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক আন্দোলন এ রাজ্যে হয়নি। কি করে এতটা সফল হতে পারল? জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্বেও জুনিয়ার ডাক্তারদের শীর্ষ নেতৃত্ব আলোচনায় বসলেন না। ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের ক্ষোভ দাবানলের মতো আছড়ে পড়েছে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে, অসুস্থ মানুষের বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে চিকিৎসকদের বিরোধ মিটিয়ে নেওয়া উচিৎ। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজ্য সরকার এবং জুনিয়র ডাক্তারদের এই ‘ইগো’-র লড়াই বন্ধ হোক। তারপরেও জুনিয়র ডাক্তারদের আবেগতাড়িত আন্দোলন আজও অব্যাহত। সরকারি হাসপাতালের বড়ছোট ডাক্তারদের রোগী দেখা বন্ধ করাটা সামাজিক বা পারিবারিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। মানুষ মেনে নিতে পারেনি এবং পারবেও না। যদিও ট্রেন বাসের আলোচনায় শোনা কথা বলতে হয়, দেশের শতকরা আশি থেকে নব্বই শতাংশ মানুষ ডাক্তারবাবুদের পেটানোর কথা বা নিগ্রহের কথা ভাবতেই পারে না।    
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের গরিবমানুষ সরকারি হাসপাতালে গেলে আগের মতো চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না। এই অবসরে একটু উঁকি মেরে দেখি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কেমন?  ২০১১ সালে প্রথম ইনিংসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যান্য আটটি দফতরের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরও নিজের হাতে রাখেন। এবং এক বিশাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাঁর মধ্যে পড়ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসক এবং অচিকিৎসক কর্মচারীদের প্রচুর শূন্যপদ পূরণ করার প্রয়োজনে একটি নতুন আয়োগ প্রতিষ্ঠা করা। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে বাদ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কলকাতার এসএসকেএম, মেডিক্যাল কলেজ সহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলিতে ‘চাপ’ কমাবার জন্য এবং অপ্রয়োজনীয় ‘রেফারেল’ বন্ধ করতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ।
যেমন গ্রাম, মহকুমা এবং জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিকে ঢেলে সাজানো। এই অ্যাকশন প্ল্যানে আরও আছে সকলের জন্য ‘হেলথ কার্ড’। প্রতি ৬ কিমির মধ্যে ২৪ ঘণ্টার জন্য মায়েদের প্রসব পরিষেবা এবং ২৫ কিমির মধ্যে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য অস্ত্রোপচার পরিকাঠামো নির্মাণ। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে ‘সিক নিউ বর্ন ইউনিট’ গড়ে তোলার কাজ শুরু করা। ব্লকস্তর পর্যন্ত পুরুলিয়া মডেলে সদ্যোজাতদের চিকিৎসা চালু করা এক কথায় চিকিৎসক, নীচুতলার কর্মী সংখ্যা বাড়ানো। এবং যন্ত্রপাতি সহ পরিকাঠামো উন্নত করা। জেলা হাসপাতালগুলিতে স্নায়ুরোগের চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, হৃদরোগ, দুর্ঘটনার দ্রুত চিকিৎসা (Trauma care unit)-র ব্যবস্থা করা। এই সব বিশেষ চিকিৎসা করতে ধার-দেনা করে, বাড়ির ঘটিবাটি বেচে গরিব মানুষকে কলকাতায় যেন না আস্তে হয়।
সারা রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে কয়েকটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে পরিকাঠামো নিয়ে। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন বিরোধীদলের নেতারা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যনীতি যাই থাক মুখ্যমন্ত্রীর ‘অ্যাকশন প্ল্যন’-এর কাজ কতটা হয়েছে তার ফসল আমরা পাচ্ছি, বর্তমান সময়ের ‘জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘটে। কলকাতার সরকারি হাসপাতালে যে ভাবে চিকিৎসকদের নানা অছিলায় পেটানো হয়, সেটা ভারতের অন্যান্য রাজ্যে নেই বললেই চলে। আমরাও ডাক্তারবাবুদের পেটানোকে সমর্থন করি না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় নিজেও করেন না। শনিবার তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে সেই কারণে আবার আবেদন করেছেন, এই আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য। জুনিয়র ডাক্তারদের আহ্বান জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীকে পছন্দ না হলে তাঁরা রাজ্যপালের উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যসচিব, মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। শেষ পাওয়া খবর, জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকে রাজি তবে তাঁরা ‘নবান্ন সভাঘর’-এর আপ্যয়ন নিতে আগ্রহী নন। ‘ফিস ফ্রাই’ রাজনীতিতে যুক্ত তাঁরা হতে চাইছেন না সম্ভবত। নবান্নের বাইরে বসতে চাইছেন। আশা করা যায় মুখ্যমন্ত্রী একুশ শতাব্দীর ডাক্তারবাবুদের নব্য নেতৃত্বের দাবি মেনে নেবেন। তবু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যব্যবস্থা সচল রাখতে ‘এসমা’ জারি করবেন না। শনিবার (১৫ জুন) সাংবাদিক সম্মেলন করার সময় মুখ্যমন্ত্রী কয়েকটি রাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা সচল রাখতে এসমা জারির কথা উল্লেখ করেন।

ধরে নেওয়া যাক লোকসভার বাজেট অধিবেশন চলাকালীন এই ধর্মঘট উঠে গেল। তারপর? রাজ্য সরকারকে যেমন হাসপাতালে চিকিৎসক নিগ্রহ বন্ধ করতে হবে। একুশ শতাব্দীর চিকিৎসকদের নব্য নেতৃত্বকেও দায়িত্ব নিতে হবে। উদার অর্থনীতির সুযোগে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার, বিদেশভ্রমণ একটা অ্যাজেন্ডা হতে পারে, পাশাপাশি ‘মানবিক’ শব্দটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে গরিব মানুষদের চিকিৎসা করা, সামাজিক, পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে রাখাটাও একান্ত জরুরী।
একবছর আগে আমি একজন নব্য চক্ষু চিকিৎসককে দেখেছি। দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে তাঁর চেম্বারে। প্রায় দু’ভরি সোনার চেন গলায়, হাতে সোনার বালা। ৩০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ফিজ তাঁর। তারপর বাবার বয়সী রোগীকে ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বলে থাকেন তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন নামকরা প্রবীণ চিকিৎসককে দেখেছি। মাত্র ১০০ টাকা ফিজ নিয়ে রোগী দেখেন। প্রত্যেক রোগীকে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলেন। গড়িয়া অঞ্চলে ‘ডায়বেটিক’-এর ব্যস্ততম চিকিৎসক তিনি। চিকিৎসক নিগ্রহ, ডাক্তারদের ধর্মঘট সাময়িক। আসলে এই সামাজিক ব্যধি, অবক্ষয় থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা। সমস্ত প্ররোচনার উর্ধে উঠে ডাক্তার-রোগীদের মধ্যে লাগাতর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে প্রচার করতে হবে এই সম্পর্কের বিষয়টা আইএমএ রাজ্য শাখাকেও ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির(সিএসআর)’ কথা ভাবতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই ‘অপবাদ’ থেকে মুক্তি পেতে। তবেই হয়ত পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি চারদশকের এই ব্যধি থেকে মুক্তি পাবে।                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র