‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র


 দীপেন্দু চৌধুরী

ঐ চরকা-চাকায় ঘর্ঘর-ঘর

   শুনি কাহার আসার খবর,

ঢেউ দোলাতে দোলে সপ্তসাগর রে।

ঐ পথের ধুলা ডেকেছে আজ সপ্তকোটি প্রাণ মেলে।

        বাংলায় মহাত্মা, কাজী নজরুল ইসলাম        

আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, সংবিধান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গত কয়েক বছর বিভিন্ন বিতর্ক, আলোচনা হছে।আলোচনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘বহুত্ববাদী সমাজ’ থেকে জাতি গঠনের কাঠামো।যা ভারতীয় সংবিধানের আধারে নিহিত আছে। আলোচনার মূল বিষয় আমদের গণতন্ত্র তথা ভারতের সাধারণতন্ত্র।দেশের চুয়াত্তরতম প্রজাতন্ত্রদিবস ২৬ জানুয়ারি মাত্র কয়েকদিন আগেই আমরা উদযাপন করেছি। ইতিহাস দাবি করছে, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গীকার ছিল ‘পূর্ণ স্বরাজ’।বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে ১৯৩০ সালে অগ্নিগর্ভ সামাজিক এই অঙ্গীকার ঘোষিত হয়।দেশহিতৈষী  সংবিধান বিশেষঞ্জ তথা গণপরিষদের ৩০৮ জন সদস্য প্রায় তিন বছর আলোচনা করে সংবিধানটি রচনা করেন।১৯৪৬ সালের ৮ ডিসেম্বর যে সনদ লেখা শুরু হয়েছিল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পরে ২৬ জানুয়ারি আমরা পূর্ণাঙ্গ সেই সংবিধান পেলাম।গণপরিষদের সদস্যরা প্রায় তিন বছর আলোচনা করেন। এবং ভারতীয় ঐতিহ্য-ঘরানা ও পাশ্চাত্যের ব্যকরণ মেনে এই সংবিধান রচনা করেন।ভারতীয় সংবিধানের জন্মলগ্নে সাধারণতন্ত্রের দলিল হাতে ভারতীয় জনসাধারণ উচ্চারণ করল প্রজাতন্ত্রের অধিকার।রাজতন্ত্র শাসনের অবসান শেষে প্রজাদের মত, নাগরিক অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সার্বভৌমিক ভারতের অধিকার বলবৎ হল। অর্থাৎ ভারতীয় জনগণ আত্মশাসনের অধিকার অর্জন করল।সংবিধান বিশেষঞ্জরা লিখছেন, সংবিধানের প্রধান বিষয় ছিল ‘গণভিত্তিক সার্বভৌমত্ব’(পপুলার সভরেনটি)-র ধারণা। এবং বিশ্ব ধর্মসম্মেলনী(ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন)-র ব্রহ্মসঙ্গীতের অন্বেষণ। এই ধারণার প্রধান উপপাদ্য বিষয় হল, স্বাধীন ভারতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবেন অখন্ড ভারতের জনগণ।সংবিধানে ধ্রুপদী দাবিতে অন্তর্ভুক্ত হল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পরিচ্ছেদ।  

আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ভারতপথিক রাজা রামমোহনের ২৫০তম জন্মবর্ষে আমরা আরও একটা বিতর্ক তুলতে চাইছি। ভারতীয় সংবিধান রচনার সময় সংবিধান রচয়িতা তথা বিশেষঞ্জরা কী বহুত্ববাদী ভারতের অন্যতম দার্শনিক ‘রাজা’-র কথা মনে রেখেছিলেন? বলতে চাইছি, ভারতীয় সংবিধানের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচ্ছেদে কী রামমোহনের চিন্তা, মতাদর্শ, বিশ্বজনীন সংস্কৃতির প্রভাব আছে? সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহন রায়ের জীবনীগ্রন্থে লিখছেন, ''১৮৩০ সালে রামমোহন রায় ‘ব্রহ্ম সভা’-র একটা ট্রাস্ট ডিড রচনা করেন। সেই দলিলটি লেখা হয় সংস্কারমুক্ত উদার মনোভাব এবং সর্বজনীননতার আদর্শে।রাজা রামমোহন লিখে গেলেন, ‘ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, পালনকর্তা আদি অন্তরহিত, অগম্য ও অপরিবর্তনীয় পরমেশ্বরই একমাত্র উপাস্য। কোন সাম্প্রদায়িক নামে তাহার উপাসনা হইতে পারবে না। যে-কোন ব্যক্তি শ্রদ্ধার সহিত উপাসনা করিতে আসিবেন, তাহারই জন্য জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, সামাজিক পদ নির্বিশেষে মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত থাকিবে...............।’’ এই ছোট্ট পরিসরে বৃহৎ বাতায়ন চেনার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করার চেষ্টা করলাম। ইতিহাসবিদ, সমাজতত্ববিদ এবং রামমোহন বিশেষঞ্জদের জন্য খোলা আকাশের প্রতিশ্রুতিতে অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ রইল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করব, রামমোহনের উদার সাংস্কৃতিক আঙিনায় অন্যতম ঘরানা ‘মাঘ উৎসব’। ভারতীয় ঋতু বৈচিত্রের সামাজিকতায় আমরা পেলাম ‘মাঘ উৎসব’-র বহুত্ববাদী উদার সংস্কৃতির সবান্ধব আমন্ত্রণ। ইতিহাস দাবি করছে, ১৮৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজা রামমোহন রায় নিজে ‘মাঘ উৎসব’-র সূচান করেন। সেদিন ছিল বাংলা বঙ্গাব্দের ১১ মাঘ।মুঠো মুঠো ফসল তোলার আবেগ প্লাবিত উৎসবের ঋতু মাঘ মাসের এই উৎসব ব্রাহ্ম সমাজের কাছে আজও সমান ভাবে চিরন্তন।আবার সমাপতনও আছে, যেমন ১৮৩০ সালে রামমোহন ‘ব্রহ্ম সভা’-র ট্রাস্ট ডিড রচনা করেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নব জাগরণের সূচনা হয়েছিল কী এই দিন? ঠিক একশো বছর পরে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে ভারতে ‘পূর্ণ স্বরাজ’-র দাবি ওঠে। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ১১ মাঘ বা ২৫ জানুয়ারি। ইংরেজি বছরের তারিখটি বদলে গেলেও রামমোহন সৃষ্ট বঙ্গাব্দের তারিখ ১১ মাঘ থেকে গেছে। প্রতি বছর এই দিন মাঘোৎসব পালিত হয়। কেশবচন্দ্র সেন ১১ মাঘ ‘’সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’’-এ উপাসনা করেন। সেই আচারবিধি মেনে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের আত্মীয়রা প্রতি বছর আত্মীয় সভায় মাঘোৎসব পালন করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত ‘মাঘোৎসব’ আজও শান্তিনিকেতনে প্রাচুর্যের সঙ্গে পালিত হচ্ছে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৭-র ২৪ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। ওই দিন ছিল মাঘোৎসব। কবিগুরু সেদিন উৎসবের আচার্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


   কেউ কেউ দাবি করছেন, ব্রাহ্ম ক্যালেন্ডার মেনে ১১ মাঘ এই উৎসব হয়। ব্রাহ্ম সমাজের ঐতিহ্য মেনেই ওই দিন ব্রাহ্ম মন্দিরগুলিতে প্রার্থনা হয়। এবং উপস্থিত সব ধর্ম, সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করা হয়। ১১ মাঘ থেকে এক সপ্তাহ ধরে ব্রাহ্ম মন্দিরগুলিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, নব বিধান ব্রাহ্ম সমাজ, ব্রাহ্ম সম্মিলনী সমাজ আলাদা আলাদা ভাবে এই উৎসব পালন করে। হরিণাভি, কোণ্ণনগর, বানীবন, নিমতা, পদ্মপুকুরের ব্রাহ্ম মন্দিরে পৃথক পৃথক ভাবে মাঘোৎসব পালিত হয়।ওই দিন বিশেষ প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে তিনজন আচার্য উপাসনায় প্রধান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এবং ঠাকুর বাড়িতে প্রতি বছর মাঘোৎসব শুরু হয় ‘বৈতানিক’ গোষ্ঠীর ব্রাহ্ম সঙ্গীত দিয়ে।সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘বৈতানিক’ তৈরি করেছিলেন।ঠাকুর বাড়িতে মাঘোৎসবে এই রীতি আজও ঐতিহ্য মেনে একইরকম ভাবে চলে আসছে।

রাজা রামমোহন রায়ের সার্বজনীন মিলনমেলায় প্রান্তিক বা অন্ত্যজ বলে কিছু ছিল না।ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, সম্প্রদায়ের মিলিত আঙিনায় ‘ব্রহ্ম সভা’র রঙিন উৎসব হয়েছে। সনাতন ভারতের দর্শন ও সমাবর্তনের সকলসহা সংস্কৃতির মহাযঞ্জ উদযাপন হয়েছিল একদিন। প্রভাতী সঙ্গীতের মূর্ছনায় ভারত নামক অখণ্ড এই মহাদেশে আমরা সবাই সহনাগরিক।মহামানবের উপমহাদেশে বহতা নদীর খরস্রোতা প্রবাহে আমরা আহ্নিক করার অঙ্গীকার করতে চাইছি।পৌষ-মাঘের ফসল তোলার সোনালি স্নিগ্ধ ঊষাকালের লগ্ন চেনা সামাজিক সম্মেলন হোক একুশ শতকীয় উপাসনা।আর্থসামাজিক ভাবে উত্তর আধুমিক ভারতে ‘বেদান্ত আচার্য’ রাজা রামমোহনের আদর্শের পথেই নতুন ভারতের উত্তরণ।
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?