দীপেন্দু চৌধুরী
বেঙ্গল থিয়েটার তথা পেশাদারি
সাধারণ বাঙলা রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর চলছে। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতার থিয়েটার
পাগল কয়েকজন যুবক ব্রিটিশশাসিত বাঙলায় প্রথম রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ করে। নাটকটি
ছিল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’। ২০২২ সাল আরও একটা কারণে উল্লেখযোগ্য ছিল। উৎপল
দত্তের ‘ব্যরিকেড’ নাটকের পঞ্চাশ বছর। ১৯ অগস্ট উৎপল দত্তের প্রয়াণ দিবস। বিগত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকের জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি নাটক আমাদের আজও চিরন্তনী মূর্ছনায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।সত্তর দশকে লেখা এবং মঞ্চস্থ হয়েছিল বিখ্যাত রাজনৈতিক নাটক ‘ব্যারিকেড’। উৎপল
দত্ত এবং বাদল সরকার বাংলা নাটককে একটা উচ্চতায় তুলে এনেছেন এ কথা আমরা
আজ অস্বীকার করতে পারি না। তাঁরা বাংলা নাটকের ভাষা, আঙ্গিক, চরিত্র, গণনাট্যের উপযোগী করে লোকনাট্যে রূপান্তরিত করেছেন বলে অনেক নাট্যসমালোচক মনে করেন। তাঁরা দু’জনেই ৫০টির বেশি নাটক লিখেছেন এবং অভিনয় করেছেন। বাদল সরকারের নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ হলেও উৎপল দত্তের নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক আনন্দ লাল। তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু নাটকে অভিনয় করেছেন এবং বাংলা-ইংরেজি নাটক নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন তাই তাঁর দাবিকে যুক্তিগ্রাহ্য বলেই মনে হয়েছে।
উৎপল
দত্তের লেখা কালজয়ী নাটক ‘ব্যারিকেড’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আনন্দ লাল। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পাঠকদের কথা মাথায় রেখে। ‘ব্যারিকেড’ নাটক একটি আদ্যপ্রান্ত রাজনৈতিক নাটক। এই নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭২ সালে। সত্তর দশক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দু’টো কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। এক, ভারতে নকশাল বাড়ি আন্দোলন। দু’ই, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ।সত্তর দশক ছিল আমাদের বাংলা তথা সারা ভারতে রাজনৈতিক উথালপাথালের সময়কাল। ব্যারিকেড নাটকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নাট্য সমালোচকরা ফ্যাসিস্ত হিটলার জমানার জার্মানির সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছেন। নাট্য
সমালোচক কিরণময় রাহা উৎপল দত্তের লেখা নাটক ‘ব্যারিকেড’-কে একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নাটক হিসেবে দাবি করেছেন।উৎপল দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত ‘ব্যারিকেড’ নাটক প্রসঙ্গে
কিরণময়বাবু একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘’দ্য ফরমোস্ট প্রপোনেন্ট অব পলিটিক্যাল থিয়েটার উইথ এ প্রোনাউন্সড লেফটিস্ট
অরিয়েন্টটেশন’’। আন্তর্জাতিক
খ্যতিসম্পন্ন অভিনেতা উৎপল দত্ত যদিও এর আগেই ১৯৫৯ সালে ‘অঙ্গার’ নামে একটি নাটক লিখেছেন।কয়লা খনি দুর্ঘটনাকে প্রেক্ষাপট করে রাজনৈতিক এই নাটকটি তিনি লেখেন এবং মঞ্চস্থ করেন। তারপর থেকেই নাট্যব্যক্তিত্ব তথা চলচ্চিত্র অভিনেতা উৎপল দত্ত ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক নাটক লেখেন এবং মঞ্চস্থ করেন। সমস্ত ধরণের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করে গ্রুপ থিয়েটারের দর্শকদের জন্য তিনি নিরলসভাবে নিজের লেখা নাটক মঞ্চস্থ করেন। বেশির ভাগ নাটকই মঞ্চস্থ করেছেন নিজের হাতে তৈরি গ্রুপ থিয়টার ‘পিপলস লিটিল থিয়েটার(পিএলটি)’-র ব্যানারে।প্রথমে
লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠা পরে গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য হয়ে একসঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।পথনাটকে অভিনয় এবং সব শেষে তাঁর নিজের দল ‘পিএলটি’। তাঁর
সমসাময়িক দর্শকদের কথায় তিনি তাঁর নাটকে আলো, ধ্বনি বা সাউন্ড, মিউজিক, দৃশ্যায়ন এবং মেলোড্রামার সংমিশ্রণ ঘটাতে সফল হয়েছিলেন। সেই কারণেই উৎপল দত্ত ব্যাতিক্রমী এক নাট্যব্যক্তিত্ব।
কখনও কখনও তাঁর নাটকের আবেদন উচ্চকিত মনে হলেও পারিচালকের চিন্তার দক্ষতার সমন্বয় ‘কাব্য গদ্যের’ গল্প শোনায়। যা থেকে গ্রুপ থিয়েটারে নতুন ধারার জন্ম হয়।
নাট্য সমালোচকদের ভাষায় থিয়েটারটা যেমন মস্তিস্কের কাজ ঠিক তেমনি গা-গতরেরও কাজ। চরিত্রের সঙ্গে মানানসই করে গা-গতরকে কাজে লাগানোর দক্ষতাই হচ্ছে নাটক।নাট্য শিল্পের শারীরিক ছন্দের উপস্থাপনা দর্শকের মনে পৌঁছে যায় ধ্রুপদী শিল্পের মত।যে শিক্ষা লোকনাটক বা যাত্রা থেকে আমরা পাই বা আরোহণ করি। বিভিন্ন নবীন এবং প্রবীণ নাট্য ব্যক্তিত্বদের কাছে শুনেছি, নাট্যনির্মাণের সময় একজন নাট্য নির্দেশক নির্দিষ্ট টেক্সট অথবা সংলাপকে কয়েকটি ইউনিটে ভাগ করে সাজিয়ে নেন। প্রতিটি ইউনিটকে সেই নাট্যনির্দেশক আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেন। এছাড়াও কাজের সুবিধার জন্য ওই সব ইউনিটকে আলাদা আলাদা নাম দিয়ে চিহ্নিত করে নেন। এইসব ইউনিটগুলি জুড়ে জুড়েই একটা গোটা নাটক তৈরি হয়ে যায়। একই কথা প্রযোজ্য একজন দক্ষ অভিনেতার ক্ষেত্রেও। উৎপল দত্ত এই দুটি কাজই সফল ভাবে সাজিয়ে নিতে পারতেন তাই তিনি নাটক এবং সামাজিকতায় ব্যাতিক্রমী নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁকে যেমন দক্ষিণপন্থীরা আক্রমণ করেছে পাশাপাশি বামপন্থীরাও আক্রমণ করতে ছাড়েনি। বামপন্থীরা ‘উৎপল মানস’-কে ‘বাবু ইন্টেলেকচুয়াল’ বলে চিহ্নিত করেছিল। তৎকালীন বামপন্থী ঘরানার নাট্য বিষয়ক পত্রিকা ‘অভিনয়’ তাঁকে বলেছিল ‘বাবু ইন্টেলেকচুয়াল।’ অনেকেই মনে করেন উৎপল দত্তের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক ঘরানা তথা অধ্যায়ের শেষ হয়েছে। এতদসত্বেও তাঁকে বাদ দিয়ে গত শতাব্দীর তিন চার দশকের বঙ্গ সংস্কৃতি বা বাম সংস্কৃতি কল্পনা করা যায় না। উৎপল দত্ত এক বহুমুখী প্রতিভা, তিনি একাধারে যেমন নাট্যকার, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের অভিনেতা, পরিচালক এবং নাট্য সমালোচক ছিলেন। তাঁর ‘ব্যারিকেড’ নাটকে যেমন বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের রাজনৈতিক টানাপড়েনকে আমরা দেখতে পেয়েছি। ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুর এক আখ্যান ওই নাটকে তিনি উপস্থাপনা করেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যের ব্যুৎপত্তির কথাও আমাদের বলতে হবে। রাজনৈতিক তত্ব সহ নানান বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল গভীর। উৎপল দত্তকে নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাঁরা জানেন, ‘গিরিশ মানস’ এবং ‘চায়ের ধোয়া’ বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়।
তাঁর নাটক প্রসঙ্গে সমালোচকরা বলেছেন, বিষয় বস্তুর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র ছিল বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন, যে আন্দোলন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কথা বলে। সেই রাজনীতির প্রেক্ষাপট তাঁর নাটকে উঠে এসেছে। দেশ বিদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রামের বিভিন্ন যুগ পরম্পরা উৎপল দত্তের সৃষ্টির ক্যানভাসে ধ্রুপদী মাত্রায় উঠে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনামের সংগ্রামী মানুষের কথা-উপকথা তাঁর নাটকের পরতে পরতে ছুঁয়ে থাকে।মননশীল মানুষ হিসেবে তিনি রাজনীতি বিমুখ বা সমাজ বিমুখ নাট্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ‘ব্যারিকেড’ নাটকে প্রথমে ‘’ব্যারিকেড’’ শব্দের অক্ষরগুলি উল্টো করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে ভ্রম হয়েছিল বিদেশী অজানা কোনও ভাষা বলে। ফ্যাসিবাদী হিটলারের সময়কাল ধরতেই কী সচেতন এই প্রয়াস?
পরে এই শব্দগুলো সোজা ব্যকরণ মেনে পড়লে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না। তাই একথা চিরন্তন সত্য হয়ে লেখা আছে ব্যারিকেড সব ভাষার, সব জাতির, সব সম্প্রদায়ের। সারা বিশ্বের সব দেশের জন্য এই নাটক লেখা হয়েছিল।লিটল থিয়েটার গ্রুপের জন্মের সময়কাল থেকে ধরলে মাত্র ৪৪ বছরের নাট্যজীবনে উৎপল দত্তের সৃষ্টির ভাণ্ডার বিরাট বিশাল। ব্যারিকেড নাটকের সঙ্গে নাম উচ্চারণ করা যায় ‘কল্লোল’ নাটকেরও।যদিও রাজনৈতিক নাটক লেখা এবং অভিনয় করার কাজ উৎপল দত্ত প্রথম শুরু করেছিলেন এমনটা বলা যাবে না। কারণ নাটক রাজনীতি বর্জিত হতে হবে এই ধরণের সংস্কৃতি নাগরিক গণতন্ত্র অনুমোদন করে না।মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটক পৌরাণিক নাটকের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও নাটকটি সম্পূর্ণরূপেই রাজনৈতিক নাটক। হয়ত ওই নাটকে গাঁন্ধীবাদের প্রভাবের কথাও বলা হয়েছে।গাঁন্ধীবাদও একটি রাজনৈতিক মতবাদ।এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বর্তমান সময়ের গণনাট্য আন্দোলনও রাজনৈতিক থিয়েটারকেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।বাঙলা নাট্য একাডেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় গত কয়েক বছরে নতুন নতুন নাটকের দল নাটক
করছে। নতুন শিল্পী কলা কুশলী উঠে আছে। বাঙলা রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর পেরিয়ে বাঙলা নাটক
আজ স্বনির্ভর।বর্তমান সময়ের নাটক সামাজিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকও
আছে। যে সামাজিক-রাজনৈতিক পথ ‘ব্যারিকেড’ ভেঙে উৎপল দত্ত আমাদের চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
Comments
Post a Comment