ব্যহত জলতরঙ্গ -একটু জল পাই কোথায়?
দীপেন্দু চৌধুরী
‘একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে
আসছি......। পথিক এক ঝুড়িওয়ালাকে জিগ্যেস করে, মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে
পারেন?’ সুকুমার রায়ের লেখা ‘অবাক জলপান’ রম্যরচনার কথাটা মনে পড়ছে? একুশ শতাব্দীর
তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে আমাদেরও উচারণ করতে হবে হয়ত, ‘একটু জল পাই’ কোথায় বলতে পারেন?
২০১৯ সালের ‘নীতি আয়োগ’-র রিপোর্ট দাবি করছে, ভারত ‘জল-স্বল্পতায়’ ভুগছে। আমাদের
দেশে জল ব্যবহারের ইতিহাসে এই অবস্থা আগে দেখা যায়নি। ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ওয়াটার রিসোর্স
গ্রুপ’-র অনুমান যে হারে ভারতে জল ব্যবহার করা হয় এটা এক ধরণের অপচয়। একই হারে জল
ব্যবহার করা হলে আমাদের দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে জল সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
‘জল সঞ্চয়’ এবং নিরাপত্তা বর্তমান সভ্যতার কাছে একটি
চ্যালেঞ্জ। জল সঞ্চয় না করতে পারলে আগামী ভবিষ্যতে ‘জল-স্বল্পতা’ থেকে আমাদের
বেরিয়ে আসার পথ নেই। জল ব্যবহার সব থেকে বেশি হয় কৃষি, সেচ, সরকারি সংস্থা,
বিভিন্ন কল কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এবং গ্রাম
শহরের কলোনি-বস্তির মানুষ যে হারে জল ব্যবহার করে। এই খানেই রয়েছে
জল অপচয়ের উৎস। একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ভারতের
কৃষিক্ষেত্র থেকে জিডিপির মাত্র ১৫% আসে। কিন্তু এই জিডিপির জন্য ৮০% জল ব্যবহার
করা হয়। বিশেষঞ্জদের অভিমত, এই অপচয় বন্ধ করা যায়। পরিকল্পিত এবং বিঞ্জানসম্মত
ভাবে যদি জল ব্যবহারের প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়। আমাদের দেশের পঞ্চাশ শতাংশ
নাগরিক কৃষি এবং কৃষি সংক্রান্ত কাজের উপর নির্ভরশীল। অথচ দেশের কর্ষণযোগ্য ৫৪%
অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অত্যন্ত কম। বাকী অংশ সেচ উপযোগী হলেও ব্যক্তিগত বড় বড় বেসরকারি কৃষি ফার্ম অতিরিক্ত জল বোরিং
করে জল তুলে নেয়। ভূগর্ভস্থ জল বিগত কয়েক দশক ধরে উত্তোলনের ফলে
জলস্তর নেমে যাচ্ছে। যে ধাক্কা এসে পড়ছে দেশের সামগ্রিক জল মানচিত্রে।
বিশেষঞ্জ সংস্থা বলছে, গত ২০ বছর ধরে উন্নয়নের প্রয়োজনে
ভূগর্ভস্থ জল যে হারে তোলা হয়েছে, সেই পরিমাণে বৃষ্টির জল মাটির নীচে যেতে পারেনি।
কারণ প্রকৃতির আশীর্বাদ বৃষ্টির জলকে পরিকল্পিত ভাবে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সেচের
প্রয়োজনে এবং কল-কারখানার কাজে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃত্রিম জলাধার(ড্যাম) তৈরি করে
বৃষ্টির জলের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যহত করা হয়েছে। বড় বড় কৃষি ফার্ম পুকুর কেটে
বৃষ্টির জল ধরে রাখে। এই ধরণের পরিকল্পনা কতটা বিঞ্জানসম্মত সেটা ভেবে দেখার সময়
এসেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের তির তির করে বয়ে যাওয়া পাহড়ি ঝর্নার জলতরঙ্গও ব্যহত হয়েছে
উন্নয়নের কারণে। ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমান্বয়ে নেমেই চলেছে। সামাজিক প্রয়োজন
অনুযায়ী মাটির নীচের জল পাওয়া যাচ্ছে না। যে টুকু জল উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে, সেই
জল কিছু বৃহৎ ভূস্বামী এবং শিল্পপতিদের প্রয়োজনে ব্যবহার হচ্ছে। এই ব্যবস্থাকে বলা
হছে, ‘এ জিরো সাম গেম’।
জল উত্তোলন, দৈনন্দিন প্রয়োজনে জল ব্যবহার, কৃষির প্রয়োজনে
জল ব্যবহার। ইত্যাদি কারণে যে চ্যালেঞ্জ দেশের সামনে এসেছে তার দায়িত্ব সরকার সহ
সবাইকে নিতে হবে। চাষের প্রয়োজনে জল বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সেই জল যদি সঠিক
পরিকল্পনা করে সঠিক স্থানে ব্যবহার করা যায় তা হলে জলের অপচয় কম হবে। সরকারের নীতি
একটা কাগজে কলমে আছে ঠিকই কিন্তু সেটার ব্যবহার অত্যন্ত দুর্বল। ‘অটল ভূজল যোজনা’ নামক
সেই প্রকল্প পঞ্চায়েত এলাকায় জল নিরাপত্তায় কাজে লাগতে পারে। বলছেন, দেশের জলবায়ু
এবং পরিবেশ বিশেষঞ্জরা।
সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র দাবী করছে,
ভূস্তরের জল যেমন পানীয় জল, কৃষির ব্যবহারের জন্য জল তুলতে তুলতে পৃথিবীর আবর্তনের
অক্ষ বদলে যাচ্ছে। ‘জিওলিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র
থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ২১৫০ গিগাটন ভূগর্ভস্থ জল
তুলে নেওয়া হয়েছে। ১ গিগাটনের অর্থ ১০০ কোটি কেজি। গবেষণাপত্রের বিঞ্জানীদের দাবী,
এই পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার জেরে পৃথিবীর অক্ষ প্রতিবছর পূর্বের দিকে ৪.৩৬
সেন্টিমিটার সরে যাচ্ছে। গবেষণাপত্রটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের বিঞ্জানীরা। যেমন সোল বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ কোরিয়ার কুং পং ন্যাশন্যাল
ইউনিভার্সিটি, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস।
এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বিঞ্জানীদলটি গবেষণাপত্রে
লিখছে, পৃথিবীর অক্ষের যে পরিমাণ স্থান বদল ঘটেছে, সেটা অত্যন্ত নগণ্য। মানব জীবনে
এর প্রভাব এখনই বোঝা সম্ভব নয়। তবে মাটির তলা থেকে এই বিপুল পরিমাণ জল তুলে নেওয়া
সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিঞ্জানীদের অভিমত, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে
হিমবাহ গলছে। সেই কারণে পৃথিবীর জলভাগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অক্ষের অবস্থান
বদলাচ্ছে। একই কথা ২০১৬ সালে একদল বিঞ্জানী জানিয়েছিলেন। গবেষণাপত্রটির প্রধান
বিঞ্জানী কি-এন সিও জানান, পৃথিবীর অক্ষের অবস্থান এক জায়গায় করে তাঁরা কম্পিউটার
মডেলের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছেন।
সোল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিঞ্জানী কি-ওন সিও বলেন,
‘’বায়ুমণ্ডলের চাপ, সমুদ্রের নীচে জলস্তরের চাপ, বাঁধের পার্শ্ববর্তী কৃত্রিম
জলাধার, মেরু বরফ, পর্বতের হিমবাহ, বাতাস ও ভূগর্ভস্থ জল এই সব তথ্য বিশ্লেষণ করে
দেখা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলের ‘অঙ্ক’ বাদ দিলেই অক্ষের অনুমান ছিল, তার সঙ্গে আর
পর্যবেক্ষণে পাওয়া তথ্য মিলছিল না। ভূগর্ভস্থ জল যোগ করতেই অঙ্ক মিলে গিয়েছে। সিও ও
তাঁর সহ-গবেষকরা নিশ্চিত ভাবে জানাচ্ছেন, পৃথিবীর অক্ষের পরিবর্তনের অন্যতম কারণ
ভূগর্ভস্থ জল সেচ ও সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি।
Comments
Post a Comment