বন ও মাটির অধিকার অরণ্যবাসীর

দীপেন্দু চৌধুরী

সংশোধিত বন সংরক্ষণ বিল ২০২৩ সম্প্রতি আইনসভায় পেশ হয়েছে। কিন্তু সেটা সংসদের বিঞ্জান, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও বন দফতরের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কেন স্ট্যান্ডিং কমিটিতে নয়? প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ সহ অন্যান্য বিরোধী দলের সাংসদরা১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ বিল সংশোধন করা হয়েছে। নতুন যে প্রস্তাবগুলি এই বিলে(২৯ মার্চ, ২০২৩)রাখা হয়েছে, সেই সব ধারায় দেশের বন সংরক্ষণ আদৌ কী সম্ভব?প্রস্তাবিত নতুন বন সংরক্ষণ বিল(২০২৩)বনাঞ্চলের আকরিক খনি শিল্প বা নির্মাণ পরিকাঠামো গড়ে তোলা আটকাতে পারবে না। কর্পোরেট সংস্থার থাবা বনাঞ্চলে যেমন ছিল তেমনি থাকবে। সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নতুন দিল্লির ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’-র আইনি গবেষক কাঞ্চি কোহলি। পাশাপাশি অনান্য বন সংরক্ষণ বিশেষঞ্জরা বলছেন, নতুন এই বিলে বনাঞ্চলে পরিবেশ বিধি ভেঙে উন্নয়নের নামে পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ফলে বনাঞ্চলের পরিবেশে আরও দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রশ্ন তোলার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কেন্দ্রের সরকার বলছে, দেশে বনাঞ্চলের এলাকা বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ‘নেট জিরো’-তে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত এই বিলে বনবাসীদের জমি অধিগ্রহণ করে গাছ কেটে কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি ভাবে করা হয়েছে। এবং বনাঞ্চলের গাছ কেটে শিল্পাঞ্চলের জন্য জমি ব্যবাহারের অনুমোদন দিতে সহায়ক হবে এই বিল। দাবী পরিবেশবিদ ও গবেষকদেরতাঁদের আরও দাবি, ভারত সরকার ২০১৫ সালের ‘ইন্ডিয়াস ইন্টেন্ডেড ন্যাশন্যাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন’ ব্যবস্থায় ফিরতে চাইছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত বনাঞ্চল তৈরি করে ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন কার্বন(সিও২)নিঃসরণ কমিয়ে আনবে। বিলের কাঠামো দেখে বিশেষঞ্জরা সন্দিহান। প্রস্তাবিত বন সংরক্ষণ বিল আদৌ কী এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারবে?

আলোচ্য বিলে তিনটে বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বন সংরক্ষণ বিশেষঞ্জরা।   এক) কিছু বনাঞ্চলের যে সব জমি আইনি ঝামেলায় পরিত্যাক্ত হয়ে আছে সে গুলি ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। ২)নতুন বৃক্ষ রোপণ করে বনাঞ্চলের এলাকা বাড়িয়ে বনাঞ্চলের ক্ষতিকে কমিয়ে আনা। ৩) জীববৈচিত্র তথা হিংস্র পশুদের(Wildlife)-মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের প্রয়োজন। সেই জন্য পুরনো বড় বড় গাছের পরিবর্তে দ্রুত বৃদ্ধি হয় এমন প্রজাতির গাছ রোপণ করতে হবে।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী বর্তমানে কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ বলছেন, গত দশকে ইউপিএ সরকার চেষ্টা করেছিল বনাঞ্চল বাড়াতে। সরকারের বক্তব্য ছিল প্রাইভেট সেক্টর ও পাবলিক সেক্টরের যারা জমির মালিক তাঁরা বনাঞ্চলের জন্য জমি ছেড়ে দিক। কিন্তু প্রস্তাবিত নতুন বিলে এই শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের বনসংরক্ষণ সংযোজিত নীতিতে প্রাইভেট এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থাগুলিকে ক্ষতিপূরণ প্রকল্পের আওতায় আগেই আনা হয়েছে। কংগ্রেস সাংসদের আরও বক্তব্য, ১৯৮০ সালের আইনে বলা আছে, গাছ কেটে বনাঞ্চল উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। প্রস্তাবিত নতুন বনাঞ্চল আইনে এই ধারাকে যুক্ত করা প্রয়োজন। যাতে প্রাইভেট এবং পাবলিক সেক্টরের আগ্রাসী থাবাকে আটকানো যায়। ১৯৯৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যা বলা হয়েছে। বনাঞ্চলের প্রাইভেট জমি ‘অভিধানিক’-ভাবেই বনাঞ্চল। এই জমি অ-বনাঞ্চল কাজে ব্যবহার করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে করতে হবে। বন বিশেষঞ্জ, পরিবেশ বিশেষঞ্জদের অভিযোগ, আলোচ্য প্রস্তাবিত বিল পাশ করে মোদী সরকার বনাঞ্চলের জমি উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে। ব্যক্তিগত মালিকানা এবং প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ গোষ্ঠীর প্রয়োজনে এই আইন আনা অন্যতম উদ্দেশ্য।                   

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব উষ্ণায়ণের আঙিনায় চ্যালেঞ্জ একটাই। গা-ছম ছম করা ঝিঁ ঝিঁ ডাকা জঙ্গল আমাদের ফিরে পেতে হবে। যে জঙ্গলে একটা সময় প্রখর গ্রীস্মে দুপুর দুটো-তিনটের সময় সূর্যের আলো হারিয়ে যেত। নেমে আসত ঘন অন্ধকার। উন্নয়নের নামে গাছ কেটে নগরায়ণ নতুন সভ্যতার অভিশাপ না আশীর্বাদ আজ ভেবে দেখার সময় এসেছে। বনবাসীদের মাটির অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যই ‘পরিবেশ বান্ধব’ ভৌগলিক ভারসাম্য টালমাটাল।

বনজ পশুপাখি এবং বনাঞ্চলের সরল সাদা সিধে মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও এখনও প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে কথা বলে গান গায় নিজের অধিকারে। সম্প্রতি মারাঠি ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছবির পরিচালক বিজয় দত্তের নির্দেশে গভীর জঙ্গল থেকে পাখিদের গান রেকর্ড করেছেন। ছবির পরিচালক ধনঞ্জয় ধুমাল লোনাভালা, আরনালা, ট্রাম্ববাকেশ্বর এবং সাটারার গভীর জঙ্গলে ১৮০০ কিলোমিটার হেঁটে পাখিদের গান সংগ্রহ করেছেন। প্রকৃতি আকুল ভাবে মানবসভ্যতার কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছে। বন কেটে বসত নয়। বনও থাক বনবাসীদের বসতের অধিকারও থাক।

আমরা বনবুড়োদের আর দেখা পাচ্ছি না কেন? দেশের ‘অমৃতকাল’ সময়কালে দাঁড়িয়ে সংশয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করতে হচ্ছে, সংশোধিত বন সংরক্ষণ বিলে আদিবাসীদের জমি কতটা সংরক্ষিত? ‘বনবাবু’(পড়ুন ঠিকারাজ)দের আধিপত্য আধুনিক বিশ্বগুরুর ভারতে এখনও কেন বজায় থাকবে?    নতুন বিলের ‘রেস্ট্রিকশন অন অ্যাক্টিভিটিস ইন ফরেস্ট’ পরিচ্ছেদে আইনের পরিভাষায় কী বলা হয়েছে? বন ও বনের জমি রক্ষায় এই আইন সহায়ক হবে। ‘দ্য অ্যাক্ট রেস্ট্রিক্টস দ্য ডি-রিসারভেশন অফ ফরেস্ট অর ইউজ অফ ফরেস্ট ল্যান্ড ফর নন-ফরেস্ট পারপাস’। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনক্রমে কিছু বনাঞ্চলের জমি ব্যাহারের জন্য নিষেধাঞ্জা তুলে নেওয়া যেতে পারে। বনাঞ্চল প্রকল্প নয় এমন কার্যক্রম ও উদ্যানপালনের জন্য জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার কিছু নিষেধাঞ্জা শিথিল করতে পারে। আইনের কৌশলী এই ধারায় কর্পোরেট থাবা থেকে প্রকৃতির প্রতিবেশী গাছ ও বনবাসীকে বাঁচানো আদৌ কী সম্ভব হবে?

গাছ ও বনবাসীর পরম্পরা ভেঙে তছনছ করেইতো আমরা ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি ডেকে এনেছি! তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে হয়েছে আমাদের। অসমর্থিত খবরে প্রকাশ সাম্প্রতিক তীব্র তাপপ্রবাহে আমাদের দেশে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ওড়িষায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বালেশ্বরে ভয়াবহ গরম ও তাপপ্রবাহের কারণে একজনের মৃত্যু ওড়িষা সরকার শুধুমাত্র স্বীকারই করেনি। মৃত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপুরণের ঘোষণাও করেছে। 

তবুও কেন্দ্রীয় সরকার জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ ও উষ্ণায়ন নিয়ে কতটা সচেতন সে বিষয়ে আমরা অত্যন্ত সন্দিহান। সাম্প্রতিককালের উদাহারণ ২৩ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার মুম্বাই মেট্রো রেল প্রকল্প। এই প্রকল্পের প্রয়োজনে ২২৯৮টি গাছ কেটে ফেলার কথা মুম্বাই মেট্রো রেল কতৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। মুম্বাই মেট্রোরেল কর্পোরেশন লিমিটেড ভারত সরকার ও মহারাষ্ট্র সরকারের একটি যৌথ সংস্থা। মেট্রো রেলের কারশেড বা ডিপো তৈরির প্রয়োজনে গাছগুলি কেটে ফেলার কথা জানিয়েছিল কতৃপক্ষ। প্রাচীন গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন পরিবেশবিদ এবং অসরকারি সংগঠন(এনজিও)।

   উদাহারণ আরও আছে, গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ আন্দোলনে ওড়িষার জগৎসিংহপুর জেলায় দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি ‘পোহাং আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি(পসকো)’-র প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানা ও বন্দর গড়ার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। ১২০০ কোটি ডলারের এই প্রকল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনে ১২৫৩ হেক্টর বনভূমি অন্য কাজে লাগানোর জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করে পসকো। প্রকল্পটি হলে ওই বনভূমি অঞ্চলে প্রায় ২.৮ লক্ষ গাছ ধ্বংস হততাছাড়া প্রস্তাবিত ওই প্রকল্প গড়ে উঠলে ২২৫০ টি আদিবাসী পরিবার জীবিকাচ্যুত হয়ে স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হত। বনাঞ্চল অন্য কাজের জন্য দেওয়াটা বনাধিকার আইন ২০০৬-এর মৌলিক ভিত্তির বিরোধী।দীর্ঘ আন্দোলন বিতর্ক শেষে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তাবিত নতুন অরণ্য আইন পর্যালোচনার পরে অভিঞ্জ পরিবেশবিদরা বলছেন, সংযোজিত এই আইন বনাঞ্চলে খনি প্রকল্প নির্মাণশিল্পের পরিকাঠামো তৈরির কাজ আটকাতে পারবে না। কিন্তু বনাঞ্চলে নাগরিক বৈচিত্র এনে আইন সম্মতভাবে নগরায়নে রূপান্তরিত করতে পারবে।     


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?