ভারতে তাপপ্রবাহ ও আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ!
দীপেন্দু চৌধুরী
সম্প্রতি একটানা সারা দেশে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রশ্নটা উঠেই গেল।
ভারত কী ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরোতে পৌঁছেতে পারবে? কোপ২৭ জলবায়ু সম্মেলনের আগেই
ভারত সরকার এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ‘ন্যাশনাল ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন’(NDCs) নামে একটি
ঘোষণাপত্রে কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। প্রাথমিক ভাবে ভারত নেট জিরোতে পৌঁছনোর সময়সীমা বেঁধে দিলেও পরিবেশ বিঞ্জানীরা সন্দিহান। তার অন্যতম
কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। ভারত সহ সারা বিশ্বে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বেড়েই চলেছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মুখে আমাদের পড়তে হচ্ছে। সম্প্রতি
‘মোকা’-র মতো খামখেয়ালি ঘূর্ণিঝড় আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র পরিবর্তনের অন্যতম কারণ
হিসাবে বিঞ্জানীরা ক্রমবর্ধমান বিশ্বজনীন গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন।
বিশেষ করে ভারত মহাসাগরের উপর গর্ভজাত ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে।
জলবায়ু
পরিবর্তনের অন্যতম কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। মে মাসে এক সপ্তাহ টানা তাপমাত্রা
বৃদ্ধির আগে চলতি বছরে এক টানা দশদিন বাংলা সহ দেশের একটা বিরাট অংশ তাপপ্রবাহের
কবলে পড়েছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, দেশের ৯০ শতাংশ অঞ্চলই
তাপপ্রবাহ প্রবণ হতে চলেছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে অতিমাত্রায়
বিপদপ্রবণ এলাকা হিসাবে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করছেন
ভারতীয় দুই বিঞ্জানী। রমিত দেবনাথ এবং রণিতা বর্ধন। তাঁদের বক্তব্য,
বিদেশি শক্তির রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক হামলা নয়। অতিমারির প্রকোপও নয়, দেশের
দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে তাপপ্রবাহ। রাষ্ট্রপুঞ্জের
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে দারিদ্র দূরীকরণ,
সুস্বাস্থ্য, সার্বিক জনকল্যাণ, স্থায়ী রোজগার ও অর্থনৈতিক উন্নতির কথা। এ
ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের চিহ্নিত এই ১৭টি বিষয়ই
একমাত্র নির্ধারক নয়। গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের
দুই ভারতীয় গবেষক বলছেন, আমাদের দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে স্থায়ী এবং টেকসই
উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ। কারণ তাপপ্রবাহের ফলে খোলা আকাশের নিচেই
হোক অথবা এক ছাদের তলায় আমাদের কাজ করার দৈহিক ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
কেমব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিঞ্জানের দু’ই বাঙালি গবেষকের সতর্কবার্তার সঙ্গে মিলে
যাচ্ছে ভারতের আবহমন্ত্রকের রিপোর্ট। রমিত দেবনাথ ও রণিতা বর্ধন যৌথ ভাবে
জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহের কারণে ভারতে শ্রমিকের কর্মক্ষমতা কমবে। তার ফলে দেশের
আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যহত হবে। আবহমন্ত্রকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘন ঘন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কৃষি ও
বিদ্যুৎ শিল্পে শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা কমে যায়। শ্রমিক কর্মীদের কম হাজিরার জন্য
উৎপাদন ব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়ে। এই রিপোর্ট থেকেই জানা গেল, ১৯০১ সালের পরে
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সব থেকে বেশি তাপপ্রবাহ বা
তীব্র গরম অনুভূত হয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশবাসীক অস্বাভাবিক দহনের সঙ্গে
যাপন করতে হবে রিপোর্টে এই সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হচ্ছে যে তীব্র
তাপপ্রবাহের কারণে ধান ও ফসল উৎপাদন এবং প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদনও কম হওয়ার
ঝুঁকি রয়েছে। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশে ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ ফল ও
সবজি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানাচ্ছেন বেঙ্গালুরুর ডাইরেক্টর অব ইন্ডিয়ান
ইনস্টিটিউট অব হর্টিকালচার রিসার্চ(IIHR)-এর ডাইরেক্টর এস
কে সিংহ। তাঁর আরও বক্তব্য, কৃষিক্ষেত্রে
উৎপাদন কম হওয়ার জন্য বহুজাতিক(FMCG)সংস্থার
পণ্যসামগ্রীর উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে
রেপোরেট বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে বিরতি দিতে হবে।
আবহ
মন্ত্রকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মূহু মূহু তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের
চাহিদাও অনেকে বেড়েছে। বাতানুকূল পরিবেশের প্রয়োজনে বাড়ি, অফিস, কারখানায় এয়ার
কন্ডিশনার, এয়ার কুলার প্রভৃতি যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। জল তোলার যন্ত্রের
ব্যবহারও তুলনামূলক ভাবে আগের থেকে বেড়েছে। এর ফলে জলস্তর নামছে। ভূগর্ভস্ত জলের
পরিমাণও এই জন্য কমে যাচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়লার উৎপাদনও
বাড়াতে হচ্ছে। কয়লা বা ফসিল ফুয়েল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ভারতে সব থেকে বেশি হয়।
ভারতের ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
আবহবিঞ্জানী
ও সমীক্ষক সংস্থার সতর্কবার্তা সম্পর্কে ভারতীয়রা কতটা সতর্ক? ‘ইয়েল প্রোগ্রাম অন
ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিউনিকেশন’ নামে একটি সমীক্ষায় ইয়েল স্কুল অব দ্য এনভায়রনমেন্ট
চারটি বিষয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে। চারটি বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট
(Concerned), সতর্ক(Cautious), বিযুক্তকরণ(Disengaged)এবং বিপদশঙ্কা(Alarmed)। ২৯ শতাংশ ভারতীয় তাপপ্রবাহের
সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। মাত্র ১১ শতাংশ সতর্ক, তাপপ্রবাহের কারণে ভারতে
কর্মপরিবর্তনের হার মাত্র ৭ শতাংশ। শিক্ষিত এবং কম শিক্ষিত ভারতীয় নাগরিকদের মাত্র
৫৪ শতাংশ বিশ্বউষ্ণায়ন সম্পর্কে সতর্ক। ওই রিপোর্টে এমনই দাবি করা হয়ছে।
চলতি
বছরের এপ্রিল মাসে ‘মোকা’ ঘূর্ণিঝড়ের আগে এবং পরে তীব্র আদ্রতাযুক্ত তাপপ্রবাহের
কবলে পড়তে হয়েছে ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের মানুষকে। আদ্রতা
সম্পর্কযুক্ত এই ধরণের তাপপ্রবাহ ৩০ বারের বেশি বয়ে গেছে ওই সময়ের মধ্যে। ভারত,
বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড এবং লাওসে তীব্র ‘হিট ওয়েভ’ লক্ষ্য করা গেছে। একটি
আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ থাইল্যান্ডে ৩০ বারের চেয়ে বেশি আদ্রতাযুক্ত
তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমাণ বেশি থাকায় মানুষের কষ্ট হয়েছে সব
থেকে বেশি। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাটরিবিউশন’ সংস্থার শীর্ষ বিঞ্জানীদের স্টাডি
দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি দেশে উচ্চ তাপপ্রবাহপ্রবণ অঞ্চল রয়েছে। এপ্রিল মাসে এশিয়া এবং
দক্ষিণ এশিয়ার রেকর্ড ব্রেকিং তাপপ্রবাহের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। সেই সময় তাপমাত্রা
ছিল ৪২-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। থাইল্যান্ডে ‘হিট স্ট্রোক’ আক্রান্ত রোগীকে
হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। তাপপ্রবাহের উচ্চচাপে রাস্তায় ভাঙ্গন ধরেছে। রাস্তায়
আগুনের ফুলকি দেখা গেছে। ভারত সহ চারটি দেশেই জরুরি ভিত্তিতে স্কুল বন্ধ রাখতে
হয়েছিল। তীব্র তাপপ্রবাহ মানবদেহে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে। দু’একটি দেশে ভয়াবহ
তাপপ্রবাহে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। তাপপ্রবাহ চলাকালীন ভারত এবং
বাংলাদেশের বাতাসে গড় আদ্রতা গত একশ বছরের মধ্যে দেখা যায়নি। তাপমাত্রা অস্বাভাবিক
ভাবে বৃদ্ধির অন্যতম কারণ গ্রীন হাউস গ্যাস।
শীর্ষ
বিঞ্জানীদের অভিমত গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের
অভিশাপ উচ্চ- তাপপ্রবাহ কমানো যাবে না। যদি
তাপমাত্রা গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তাহলে ভারত এবং বাংলাদেশ দু’বছরের মধ্যে
আবারও একই মাত্রায় তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে পারে। ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া,
ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, কেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইউকে এবং ইউএসের ২২ জন
বিঞ্জানীর গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
Comments
Post a Comment