লগ্নভাঙা ভোরের চেতনা


 দীপেন্দু চৌধুরী

আপনার মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছেন কেন? মাস্টারমশায়, ভালো পাত্র পাচ্ছি ছেড়ে দিলে হয়? পরে যদি এই পাত্র না পাই! কিন্তু আপনি কী জানেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হলে বিয়ে দেওয়া আইনি অপরাধ! অত আইন মেনে কী আমরা চলতে পারি? সংলাপ একুশ শতকের প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার একটি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক ও তার একজন ছাত্রীর মায়ের। খুব পরিচিত সংলাপ, আমরা কিছুটা ঘষেমেজে পালিশ করে নিয়ে সংবাদের বা প্রতিবেদনের জন্য কাজে লাগাতে পারি। সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা পালন করা হয়এই সংলাপ স্থান কাল পাত্র বিশেষে প্রায় একই রকমের হবে।কিন্তু বাস্তবটা অস্বীকার করবে কে? আজ থেকে ২৩০ বছর আগে স্ত্রী শিক্ষার কথা যে মহামানব ‘আত্মীয় সভা’-য় বসে ভেবেছিলেন তাঁর উত্তরসূরী আমরা। রাজার রাজা রামমোহন রায়ের গত বছরের ২২ মে ২৫০তম জন্মবর্ষের সূচনা হয়েছে। সমাপ্তি চলতি বছরের ২২ মে। রামমোহন ও তাঁর উত্তরসূরী পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিস্তর আনুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মবর্ষ আমরা ২০১৯ সালে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছি।

আজ থেকে ২৩০ বছর আগে স্ত্রী শিক্ষার কথা যে মহামানব ‘আত্মীয় সভা’-য় বসে ভেবেছিলেন তাঁর উত্তরসূরী আমরা। কিন্তু প্রায় ২৩০ বছর পরেও রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারের কাজের অবশিষ্টাংশ বর্তমান সমাজকেও বহন করতে হচ্ছে প্রশ্ন উঠছে কেন এই অবশেষ আমরা টানব? নারীদের সমানাধিকারের বিষয়টা আন্তর্জাতিক স্তরে বহু যুগ আগেই স্বীকৃত। অবিভক্ত ভারতে ‘সতীদাহ প্রথা’-র অবসানের মধ্যে দিয়ে নতুন সমাজের লগ্নভাঙা ভোরের চেতনা জাগান ভারত পথিক। রাজা রামমোহন তাঁর প্রাঞ্জতায় বুঝেছিলেন, স্ত্রী শিক্ষা ছাড়া ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার ভাঙা সম্ভব নয়। তবুও আমাদের একুশ শতকের আঙিনায় বাল্য বিবাহ, লিঙ্গ বৈষম্য, শিশু নির্যাতন এবং লিঙ্গ নির্ভর হিংসা তথা গার্হস্থ হিংসার কথা প্রতি নিয়ত শুনতে হয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিঞ্জতাও হয়।


 রাজা রামমোহন রায় যে কাজ শুরু করেছিলেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর সেই ব্রতকে সামনে রেখে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ বইয়ে লিখছেন, ‘আধুনিক পাশ্চাত্য ঞ্জানবিদ্যার সঙ্গে এদেশের ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত বিদ্যার যোগ সূত্র স্থাপন এবং বাংলা শিক্ষা প্রচলন শিক্ষাক্ষেত্রে এই দুটি হল বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। তাঁর অন্য কীর্তি হল, এ দেশে স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা১৮৪৯-৫০ সালে ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুনের অন্যতম সহযোগীরূপে তিনি বাংলাদেশে স্ত্রী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করেন। আগেকার অনেক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত চেষ্টা সত্বেও স্ত্রী শিক্ষার কোনো সামাজিক অন্তরায় তখনো দূর হয়নি। অথচ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর প্রায় দুই পুরুষ ধরে আধুনিক পাশ্চাত্য ঞ্জান-বিঞ্জান-সাহিত্যের নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা চলেছে।’ ১৮৪৯ থেকে চর্চা শুরু হয়ে পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৯ সালে বাল্য বিবাহ আইনের প্রচলন হয়। টোল নির্ভর দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আগোল ভাঙ্গর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। অনালোকিত ভারতে রামমোহন-বিদ্যাসাগরের আলোয় অবিভক্ত ভারত আলোকিত হয়েছিল। ১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ আইন স্বাধীন তথ্য বিশ্বায়ন উত্তর ভারতে ২০০৬ সালে নতুন ভাষায় সংযোজিত হয়। উদার অর্থনীতির দেশ ভারতে ‘দ্য প্রভিশন অব চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট’ আরও ব্জ্র আঁটুনির ধারা নিয়ে প্রচলন হয়েছে।     

কিন্তু তবুও আমাদের দেশের অভিশপ্ত বাল্য বিবাহের ছবিটা খুব কিছু বদলায়নি। সম্প্রতি একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য দাবি করছে, ভারতে ১০৩ মিলিয়ন বা ১০.৩০ কোটি নাবালিকার বিয়ে হয় ১৮ বছরের কম বয়সে। এই পরিসংখ্যান ছাড়াও আমাদের সামনে রয়েছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। ৮৫ মিলিয়ন বা ৮৩ শতাংশ বাল্য বিবাহ হয় আমাদের দেশে। ইউনিসেফ রিপোর্ট দাবি করছে, তিনজন শিশুকন্যার মধ্যে একজনকে অভিভাবকদের অন্যায় জুলুম মেনে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হয়।ভারতের ‘অ্যাকশন এইড অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট দাবি করছে, আমাদের দেশে ‘অমৃতকাল’ পরম্পরা সময়েও ২০-২৪ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে হয় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই। অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রবণতা গ্রাম এবং শহরের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। মূলত বাড়ির অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে সামাজিক অবক্ষয় আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। বিগত দুই দশকে ২০.৬ শতাংশ ‘লাজে রাঙা’ বালিকা বধূর খোঁজ পেয়েছে ‘অ্যাকশন এইড’ নামক সমীক্ষক সংস্থাটি। ১৯৯২-২০১২ এই সময়ের মধ্যেই আমরা বিশ্বায়ন, উদার অর্থনীতি এবং অমৃতকাল সময়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিঞ্জানী এবং রাজনীতিবিদরা এমনটাই দাবি করে থাকেন। বারে বারে আমাদের উচ্চারণ করতে হচ্ছে, ভারতে ক্ষুধার নিরসন এবং প্রাথমিক শিক্ষা তথা স্ত্রীশিক্ষার ব্যপক প্রচার প্রসার করতে না পারলে ‘বাল্য বিবাহ’-র মতো  শতাব্দী প্রাচীন অভিশাপ থেকে আমাদের সভ্যতা মুক্ত হতে পারবে না।     


 

আমাদের দেশে অপুষ্টি এবং ক্ষুধা নিয়ে মহামান্য আদালতের রোষে পড়তে হয়েছে মোদী সরকারকে। গত বছর প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দেখা গেছে ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ স্থানে র‍য়েছে ভারত। এ ক্ষেত্রে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশও ভারতের থেকে এগিয়ে। অপুষ্টিজনিত সমস্যা, অনাহার, শিশু মৃত্যুর হারের মতো বিষয়ের উপরে নির্ভর করে হওয়া এই রিপোর্ট ভারত সরকার মানতে চায়নি। কিন্তু ‘বাল্য বিবাহ’ নামক অভিশাপ এবং ‘নারী পাচার’ আজও আমাদের সভ্যতার অন্যতম কলঙ্ক। যে সূত্র আমরা নিবন্ধের সংলাপে ধরতে চেষ্টা করেছি। ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর একটি মামলার শুনানিতে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এন ভি রমণা মন্তব্য করেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক সূচক নিয়ে ভাবিত নয় আদালত। বরং তার লক্ষ্য, ক্ষুধার নিবৃত্তি। অনাহারে কারও মৃত্যু না হয়, তা নিশ্চিত করাটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব।’ ওই একই বছরের ১১ অগস্ট শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা বলেছিলেন অর্থনীতি আর জনকল্যাণে ভারসাম্য চাই। সমাজ বিঞ্জানীদের পর্যবেক্ষণও একই দাবি করছে। ক্ষুধা তথা অনাহার না মেটাতে পারলে ‘বাল্য বিবাহ’ বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর্থসামাজিক বিষয়ক সমস্যার আন্তরিক এবং সমষ্টিগত সমস্যা সমাধান না করতে পারলে বাল্য বিবাহ আইন করে বন্ধ করা যাবে না। এই সত্য ভারতপথিক রাজা রামমোহন, দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর এবং মানবতাবাদী দার্শনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন।      

জাতীয় ক্ষেত্রের পরিসংখ্যানটা একবার দেখে নেওয়া যাক। ২০১১ সালে গ্রামীণ ভারতে ৭৫ শতাংশ বাল্য বিবাহের খবর জানতে পারা গেছে। উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, বিহার, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশে ৭০ শতাংশ বাল্য বিবাহ হয়েছে। ওই বছরেই ভারতের পাঁচটি জেলার গ্রামীণ এলাকায় ৫০ শতাংশ বাল্য বিবাহের খবর রয়েছে। এর মধ্যে চারটি জেলা রাজস্থান নামক রাজ্যের। জেলাগুলি হল ভিলওয়াড়া, চিত্তুরগড়, টঙ্ক এবং আজমেঢ়এবং ললিতপুর নামের জেলাটি হল উত্তর প্রদেশের। ‘অ্যাকশন এইড’ সংস্থার রিপোর্ট থেকে এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।সম্প্রতি আসামেও বাল্য বিবাহ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে খবর উঠে এসেছে।বর্তমান সময়ের পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে ‘বাল্য বিবাহ’ তথাকথিত সমাজ প্রভুদের অনুমোদন নিয়েই হয়ে থাকে। বহুবর্ণিত বৈচিত্রসম্পন্ন ঐতিহ্যময় ভারতে বয়ঃসন্ধিতে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই রীতি। উত্তর ভারতে বাল্য বিবাহের পরেও কন্যা পিতৃগৃহে থাকে। ওই অঞ্চলের রাজ্যগুলির এটাই রিচুয়াল কয়েক বছর পরে একটা সময় বালিকাবধূ শ্বশুর বাড়ি যায়। সেটাও আইনসিদ্ধ বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই। শিশুকন্যা বা বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনও খুঁজে পাওয়া যায়। যতক্ষণ না আইনি ঝামেলা বা থানা পুলিশ হচ্ছে, পঞ্চায়েতস্তরের বা ব্লকস্তরের নেতানেত্রীদের মুখ বুজে থাকতে দেখা যায়। বাল্য বিবাহ শুধু মাত্র খেটে খাওয়া গরিব দলিত পরিবার গুলিতে হচ্ছে এমনটা নয়। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে বাল্যকালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি(২০ মে ২০২৩)কলকাতার রামমোহন গ্রন্থাগারে রামমোহন রায় স্মারক বক্তৃতায় আক্ষেপ করে বলেন, ‘’উনিশ শতকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে এ দেশের মেয়ে কনোলিয়া সোরাবজির হেনস্থা হয়েছিলেন। পুরুষদের বাধার ফলেই ব্যারিস্টিরি পাশ করতে দশ বছর সময় লাগে অবিভক্ত ভারতের আধুনিক মনস্ক এক নারীর। নানা ধরনের বৈষম্যের বাধা কাটিয়ে ভারতীয় মেয়েরা এগিয়ে চলতে শিখেছে।‘’      

জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন আমাদের রাজ্যের কিছু তথ্য প্রকাশ করলেও উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের তথ্যের প্রসঙ্গে কিছু জানায়নি। নবান্ন সূত্রে খবর, রাজ্যে বাল্য বিবাহ রুখতে রাজ্য সরকারের ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে ‘স্টেট রুরাল লাইভলিহুড মিশন’। উল্লেখিত মিশনের দাবি, রাজ্যে প্রায় ১০.৪৫ লক্ষ স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী আছে। বাল্য বিবাহ রুখতে এই গোষ্ঠীর সদস্যদের সক্রিয় করে তোলা হচ্ছে। বাল্য বিবাহ নামক অভিশপ্ত তথাকথিত সংস্কৃতির অবসান তখনই সম্ভব, যদি আমরা লিঙ্গ সমতার কথা ভাবতে পার বা নারী-পুরুষের হাতে সমান ক্ষমতা তুলে দিতে পারিএবং প্রাথমিক শিক্ষার সময়ে ‘বাল্য বিবাহ’-র বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারি। তবেই হয়ত বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব।      

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?