চিকিৎসাবিঞ্জানের উপেক্ষা ও পঙ্গুত্ব!




দীপেন্দু চৌধুরী

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। চিরন্তন সত্য। সব দেশের সব সম্প্রদায়ের মা-বাবা এটা চেয়ে থাকেন। কিন্তু সন্তান যদি চিকিৎসা বিঞ্জানের উপেক্ষা তথা সামাজিক অসচেতনতার কারণে পঙ্গু হয়ে জন্মগ্রহণ করে? সে ক্ষেত্রে অসচেতন গর্ভদায়ী মা হিসাবে তাঁর আর করার কী থাকে? এমনই এক কঠিন বাস্তবের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম। একুশ শতকের নির্মম সত্য হলেও আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। শুনলে যে কেউ অবাক হতে পারেন। আমাদের দেশ ভারতে প্রতি দশ হাজার নবজাতকের মধ্যে গড়ে ১৫ জন মেরুদন্ডের গঠন সংক্রান্ত অসুখ ‘স্পাইনা বিফিডায়’’ আক্রান্ত হয়। এবং এই সব শিশুদের অনেকেরই জন্ম হয় মস্তিস্ক(ব্রেন)বাদ দিয়ে। ডাক্তারদের অভিমত এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশু চিকিৎসক এবং স্নায়ু চিকিৎসকদের বক্তব্য, ‘স্পাইনা বিফিডায়’ আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিক জীবনও ব্যহত হয়। তাই এই রোগ আটকাতে নবজাতকদের পৃথিবীতে আসার আগেই বিঞ্জানসম্মত ভাবে অন্তঃসত্বা মায়েদের ঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো উচিত।

বিশেষঞ্জ শিশু চিকিৎসকদের অভিমত, বিকলাঙ্গ ৯০ শতাংশ শিশু জন্মগ্রহণের আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভ সঞ্চারের আগে থেকেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো যায়। এই তথ্য জেনে চমকে উঠতে হয়েছে আমাদের যে জি২০(G20) গোষ্ঠীভুক্ত দেশের মধ্যে মাত্র ৮টা দেশে চাল, আটা, নুন ইত্যাদি খাদ্য শস্যে যথাযথ পরিমাণ ফলিক অ্যসিড মেশাচ্ছে। একুশ শতকের অত্যাধুনিক উন্নত গণতন্ত্রের বিশ্বে এ কোন বিস্ময়? আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে খাবারে ফলিক অ্যাসিড মেশানো হয়। থাইরয়েডের মতো রোগ প্রতিরোধে নুনে আয়রন মিশিয়ে বিক্রি করা যেমন আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক। ঠিক তেমনি চাল, আটা, নুনে নির্দিষ্ট পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড মেশানো হোক। চিকিৎসকদের দাবি, ভারতেও ফলিক অ্যাসিড ব্যবহারে এই বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি করা উচিত। 


এই বিষয়ে অভিঞ্জ চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভারতে অন্তঃসত্বাদের সরকার আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের ট্যাবলেট দিয়ে থাকে ঠিকই। তবে ফলিক অ্যাসিড একজন অন্তঃসত্বাকে যে সময় দেওয়া হয় সেটা সঠিক সময় নয়।একজন মায়ের গর্ভাবস্থা সুনিশ্চিত হওয়ার ছ’সপ্তাহের পরে ওই ট্যাবলেট দেওয়া হয়ে থাকে। অভিঞ্জ শিশু চিকিৎসকদের আপত্তি এখানেই। যেহেতু গর্ভসঞ্চারের তিন থেকে চার সপ্তাহেই তৈরি হয়ে যায় গর্ভস্থ শিশুর মেরুদন্ড। তাই গর্ভাবস্থা সুনিশ্চিত হওয়ার পরে ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো হলেও ভ্রুণের মেরুদণ্ড গঠনে তার কোনও উপযোগিতাই থাকবেনা।এই ট্যাবলেট শুধুমাত্র রক্তাল্পতা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে থাকে।‘ইন্টারন্যশন্যাল সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জারি’-র ভারতের প্রতিনিধি তথা কলকাতা শহরের প্রথম সারির শিশু চিকিৎসক সব্দীপ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘’স্পাইনা বিফিডা’য় আক্রান্ত শিশুর মস্তিষ্কে জল জমে সেটির বিকাশ ব্যহত হয়। মল-মূত্র ত্যাগে নিয়ন্ত্রণ থাকে না।শরীরের নিম্নাঙ্গ অসাড় হয়ে যায়। পা, মেরুদন্ড, কিডনি এবং মস্তিষ্কে একাধিক ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার করেও তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায় না। রোগের প্রকোপ বেশি হলে কিছু সদ্যোজাত জন্মের কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়। সেই জন্যই এই রোগ প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি।‘’

সারা বিশ্বে ফলিক অ্যাসিডের ডোজ কম হওয়ার জন্য প্রতি ৫০০ জন নবজাতকের মধ্যে ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়। ৮০ শতাংশের মূত্রাশয় ঘটিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। একজন মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগে নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড পরিমাণমত না খাওয়ানোর জন্য সেই মহিলার রক্তে ফলিক অ্যাসিড কাজ নাও করতে পারে। সেই কারণেই একজন নবজাতকের ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। ভারত সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে একজন মহিলা গর্ভবতী হয়ে থাকেন অপরিকল্পিত ভাবে। অবাস্তব এই পরিস্থিতির জন্য নবজাতকের মস্তিস্ক সহ বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব হছে না।আমেরিকার স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শস্য উৎপাদনে ফলিক অ্যাসিড ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। ২০০১-২০১০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনস্বাস্থ্যে সব থেকে বেশি সাফল্য পাওয়া গেছে এই ক্ষেত্রে।   


চিকিসা বিঞ্জানের উদাসীনতার কারণে সারা বিশ্বে ফলিক অ্যাসিড ব্যবাহারের প্রচার এবং সচেতনতা অত্যন্ত কম।কোন দেশের অবস্থান কোথায় এই বিষয়ে তুলানামূলক একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করছি। জনসংখ্যা নিরিখে ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো হয় প্রতি দশ লক্ষ্যে যথাক্রমে ভারতে মাত্র ৫৫৩জনকে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের ১৭টি রাজ্যে আলোচ্য বিষয়ে ব্যবস্থা চালু আছে।চিন ১২৮৫, বাংলাদেশ ১৪৫, নাইজেরিয়া ১০৯, ইজিপ্ট ৮৯, ইথিয়োপিয়া ৮৫, ফিলিপিন্স ৮১, অ্যাঙ্গোলা ৯, মরক্কো ৩২, ঘানা ২০ বেনিন ১০, ইন্দোনেশিয়া ২৫। অপুষ্টির কারণে প্রসবকালীন মায়েদের আনেমিয়া আক্রান্তের পরিসংখ্যান, ভারত ২৪,৯৫০১০৭, চিন ২,৮৮,৩১৮১০, বাংলাদেশ ৩,১৯,৪৬০৫, নাইজেরিয়া ৫৩,৭৪,৫৩০, ইজিপ্ট ১,৮৯,৬৯৫৫, ইথিয়োপিয়া ১,৬৯,৫৫৩১, ফিলিপিন্স ৮০,৯৬৫৭, অ্যাঙ্গোলা ৩৬,৫৬৯৮, মরক্কো ১০,১৬২২৬, ঘানা ৭,২২,৪৬৮, বেনিন ৫,০৩২০২ ইন্দোনেশিয়া ৫৪,০৮৪০, নিউট্রাল টিইউব(NTD)সমস্যা ভারত ২২,০০৬, চিন ১৪,০৩৭, বাংলাদেশ ৪,১৫৪, নাইজেরিয়া ৩,৭৩১, ইজিপ্ট ২,০৭৭,  ইথিয়োপিয়া ১৩৯৭, ফিলিপিন্স ১,০৮৯, অ্যাঙ্গোলা ৮১৬, মরক্কো ৫৪৭, ঘানা ৫৩১, বেনিন ৩৭৫, ইন্দোনেশিয়া ৩১২, ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগে আক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি দশ লক্ষ্যে যথাক্রমে ভারত ২০,৪১০, চিন ১১,৬৮১, বাংলাদেশ ৩৮৫৭, নাইজেরিয়া ৩৫১৯, ইজিপ্ট ১৭৮৩, ইথিয়োপিয়া ১৩১৫, ফিলিপিন্স ৯৫৪, অ্যাঙ্গোলা ৭৬৯, মরক্কো ৪৫৪, ঘানা ৪৯৯, বেনিন ৩৫৪, ইন্দোনেশিয়া ২৭৪। পঙ্গুত্ব থাকা সত্বেও বেঁচে থাকার হার (DALYs= disability-adjusted life years)ভারত ২,১৯,৮১০৩, চিন ১,৭০,১৩৯৬, বাংলাদেশ ৩,৬২,৫৬৪, নাইজেরিয়া ৩,৬২,৫৬৪, ইজিপ্ট ১,৬১,৩৫২ ইথিয়োপিয়া ১,৪০,০৮৮, ফিলিপিন্স ১,০২,৫১৭ অ্যাঙ্গোলা ৫৭,৫২২ মরক্কো ৬৬,১৯৩ ঘানা ৫৪,০০৮, বেনিন ৩৮,৯৯৮, ইন্দোনেশিয়া ৩৫,০১৭। ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আর্থিক মূল্য মার্কিন ডলারের হিসাবে ভারত ৫৫৩২, চিন ২০,২৯৮, বাংলাদেশ ৫৯৪, নাইজেরিয়া ২,৩৬৪, ইজিপ্ট ৬৯৯, ইথিয়োপিয়া ১৪১, ফিলিপিন্স ৫৩৭, অ্যাঙ্গোলা ৩৮৩, মরক্কো ৩১০, ঘানা ১৪৭, বেনিন ৬৪, ইন্দোনেশিয়া ১৯৬।  


নবজাতকদের ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগ বা শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করতে সারা বিশ্বে অন্তঃসত্ত্বাদের সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড খাওয়ানো উচিত। এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রথম সারির তিনটি চিকিৎসক সংগঠন উদ্যোগী হয়েছে। কলকাতার নিউরো সার্জেন্ট কৌশিক শীল জানাচ্ছেন, ৩ মার্চ ছিল বিশ্ব প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ দিবস। ওইদিন  ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জারি’, ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর প্রিভেনশন অব স্পাইনা বিফিডা’ এবং ভারতের ‘স্পাইনা বিফিডা ফাউন্ডেশন’ এর সঙ্গে যৌথভাবে ‘ইন্টারন্যশন্যাল সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো সার্জারি’ রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে। চিকিৎসকদের প্রস্তাব ছিল ফলিক অ্যাসিডের ডোজ বাড়ানোর। ‘স্পাইনা বিফিডা’ রোগ প্রতিরোধে গর্ভবতী হওয়ার আগে একজন মহিলাকে প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম করে ফলিক অ্যসিড খাওয়াতে হবে। কেন্দ্র এবং রাজ্য দুটি সরকারের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ‘স্পাইনা বিফিডা’ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একটা সমস্যা। জি২০ গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।                                  






 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?