ভারতে সবুজ অর্থনীতি ও জি ২০ প্রেসিডেন্সির চ্যালেঞ্জ


 দীপেন্দু চৌধুরী 

বিগত কয়েক দশকে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটার পর একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করছেন। দিস্তা দিস্তা কাগজ পড়তে পড়তে থুরি কম্পিউটারের কী বোর্ডের টরে টক্কা আওয়াজ শুনতে শুনতে পরিবেশকর্মী-বিঞ্জানীরা ক্লান্ত।আমরা বারে বারে লিখছি, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একমাত্র এবং অন্যতম কারণ জ্বালানি সমস্যা।বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন মাধ্যমের কথা আলোচনা হচ্ছে সারা বিশ্বে। ফসিল ফুয়েল থেকে মুক্তি পেতে সবুজ জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতি নামক এক অর্থনৈতিক করিডরের কথা বলছেন আন্তর্জাতিকস্তরের অর্থনীতিবিদরা। এই অবসরে ভারতের অবস্থান কী? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত জি ২০(G20)গোষ্ঠীর প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব নিয়েছে।শ্লোগান রেখেছে ‘এক পৃথিবী-এক পরিবার-এক ভবিষ্যৎ’।এই শ্লোগান কৌশলী প্রচারে জনপ্রিয়তা পেতে পারে কিন্তু চ্যালেঞ্জ কতটা নিতে পারবে সেটা দেখার অপেক্ষায় সারা বিশ্ব। এবং দায়িত্ব নিয়েই দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চ্যালেঞ্জ এক) নতুন জ্বালানির অনুসন্ধান(এনার্জি অ্যাকসেস) এবং দু’ই) জ্বালানি নিরাপত্তা। গত বছর জি ২০ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিল ইন্দোনেশিয়া।২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জি ২০ গোষ্ঠীর বালি নেতৃত্ব ঘোষণা করেছে, গোষ্ঠীভুক্ত দেশের সমস্ত সদস্য ফসিল ফুয়েল মুক্ত জ্বালানি শক্তির অনুসন্ধান করবে।



 এই বিষয়ে আজকাল পত্রিকায় একাধিকবার আমরা লিখেছি।ভারতের ‘ফেজ আউট’ নয় ‘ফেজ ডাউন’ জলবায়ু নীতির প্রসঙ্গ বারে বারে আলোচনায় উঠে এসেছে।গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রসংঘের ‘কোপ ২৬’ আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনেও একই মত উঠে এসেছিল। ভারত জি ২০ গোষ্ঠীর দায়িত্ব নিয়ে প্রথম ‘ডেভলপমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’(ডিডব্লুজি)-র বৈঠক করে মুম্বাইয়ে। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এই বৈঠকে মূলত দু’টি বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রথমটি ছিল ‘’ডেটা ফর ডেভলপমেন্ট রোল অফ জি ২০ ইন অ্যাডভান্সিং দ্য ২০৩০ অ্যাজেন্ডা’’।দ্বিতীয় বিষয় ছিল ‘’ইনফিউসিং নিউ লাইফ ইন্টু গ্রীন ডেভেলপমেন্ট’’। যে বিষয়টির প্রসঙ্গ আমরা আলোচনার প্রথেমেই উল্লেখ করেছি। অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘সবুজ অর্থনীতি নির্ভর উন্নয়ন’-র কথা বলা হচ্ছে। ২০১৫ সালে সংযোজিত ‘সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট’ ঘোষণার পরে ভারত বর্তমানে ২০৩০ অ্যাজেন্ডার মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। যেটাকে আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জ বা এক কঠোর পরীক্ষামূলক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে চাইছি।

আমাদের দেশের জীবাশ্মমুক্ত জ্বালানি নীতিকে জি ২০ নেতৃত্বের অনুসরণ করার কথা বলছেন পরিবেশ বিঞ্জানীরা। ভারত সরকার ঘোষণা করেছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ পুনরনবীকরণ জ্বালানি ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারত ‘ইন্টারন্যাশন্যাল সোলার অ্যালিয়ান্স(আইএসএ)’–র প্রেসিডেন্সির দায়িত্বও সামলাচ্ছে। এই কারণে ভারত সরকারের উপর দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে, ভারতীয় উপমহাদেশে সৌরশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিকাঠামো করিডোর গড়ে তোলার। এই উদ্যোগে জি ২০ আরও বড় ভূমিকা নিতে পারবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনের জন্য। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবস্থান বিতর্কিত হলেও অত্যন্ত উজ্জ্বল।ভারতের পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের নেতৃত্বে জি ২০ গোষ্ঠীর ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট সাস্টেনাবিলিটি ওয়ার্কিং গ্রুপ(ECSWG)-র প্রথম বৈঠক হয় ৯-১১ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গালুরুতে।   


ওই বৈঠকে মূলত চারটি বিষয়ে আলোচনা হয়। ১)‘প্রোমোশন অফ ব্লু ইকোনমি অ্যালং উইথ কোস্টাল সাস্টেনাবিলিটি’ ২)‘রেস্টোরেশন অফ ডিগ্রেডেড ল্যান্ডস অ্যান্ড ইকোসিস্টেমস’ ৩) ‘এনহান্সমেন্ট অফ বাইয়োডাইভারসিটি’ এবং ৪) ‘স্ট্রেইংদেনিং অফ সার্কুলার ইকোনমি’।অন্যান্য রাষ্ট্রের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে জি ২০-র নেতৃত্বে ভারত সহনশীল ও টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবছে। এই ঘরানার উনয়নের জন্য দেশে ব্যবহারযোগ্য অপ্রচলিত মাধ্যম থেকে নতুন জ্বালানি শক্তির খোঁজ করবে। এই প্রস্তাব পরিবেশ বিঞ্জানী ও পরিবেশ কর্মীরা ইতিমধ্যে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অপ্রচলিত জ্বালানি(যেমন সোলার বিদ্যুৎ)মজুত করা বা সঞ্চয়ের জন্য বিঞ্জানসম্মত কারিগরি ব্যবস্থার কথাও ভাবতে হবে। গ্রীন হাইড্রোজেন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কার্বনমুক্ত সিমেন্ট ও স্টীল শিল্পকে পরিবেশ বান্ধব মানে নিয়ে যেতে হবে। জীবাশ্মমুক্ত জ্বালানিবিশ্ব গড়ে তোলার বৃহত্তর স্বার্থে জি ২০ প্রেসিডেন্সি দেশ হিসাবে ভারতকে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হবে। এই কারণে ভারতকে জি ২০ গোষ্ঠীভুক্ত অংশীদার দেশগুলিকে উৎসাহিত করতে হবে।তাঁরা বিভিন্ন দেশ কার্বনমুক্ত জ্বালানি কাঠামোর উন্নতি তথা জীবাশ্মমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী।অন্যান্য দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদাকে কাজে লাগানো এবং কারিগরি ব্যবস্থার দায়িত্ব আমাদের দেশকে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অন্তত ভারতের প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালে। ভারতের অভিঞ্জতাকে সামনে রেখে আগামীতে অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্র এবং উন্নয়নশীল দেশ কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার কথা ভাববে। ভবিষ্যতে কয়লা নির্ভর জ্বালানি থেকে বেড়িয়ে আস্তে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা এবং ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনসগুলিকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে পরিবেশ বিঞ্জানীরা।জি ৭ দেশগুলির নেতৃত্বে ‘জাস্ট এনার্জি ট্রান্সমিশন পার্টনারশিপ(JETP)’এমনই একটি অংশীদারি ব্যবস্থা।

আয়োজক দেশ ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বে গত বছর বালি শহরে অনুষ্ঠিত জি ২০ সম্মেলনে এই বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সম্মেলনে সারা বিশ্বে ফসিল ফুয়েল থেকে ‘লো কার্বন’ কারিগরি পরিকাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি করিডোর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে। উদাহারণ হিসেবে জি ৭ গোষ্ঠীর প্রসঙ্গ এসেছে। উল্লেখিত কারিগরি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০২১ সালে  দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ৮.৫ বিলিওন ডলার, ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ২০ বিলিয়ন ডলার এবং ওই একই বছরে ভিয়েতনামের সঙ্গে ১৫ বিলিয়ন ডলার চুক্তি করেছে জি ৭ নেতৃত্ব।‘জাস্ট এনার্জি ট্রান্সমিশন পার্টনারশিপ(JETP)’ শব্দগুচ্ছের সঙ্গে আমরা ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকারক ঝুঁকি কমাতে ‘জেইটিপি’-র সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে ভারতের নেতৃত্বে জি ২০ গোষ্ঠীকে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট উদোগকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এবং অবশ্যই উন্নত রাষ্ট্রগুলিকে ফসিল ফুয়েল থেকে ‘জাস্ট ট্রান্সিট’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ‘ক্লাইমেট ফাইনান্স’-র দায়িত্ব নিতে হবে।‘জেইটিপি’ চুক্তিবদ্ধ মঞ্চ সারা বিশ্বে সবুজ অর্থনীতি(গ্রিন ইকোনমি)-র অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।কোপ ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশেষ ভাবে আলোচনা হয়েছে ফসিল ফুয়েল থেকে ‘জাস্ট ট্রান্সিশন’ নামক নতুন অধ্যায়ে। যাকে বলা হচ্ছে সবুজায়নের অর্থনীতি। যেখানে উন্নয়ন থাকবে কিন্তু অপচয় ঘটবে অত্যন্ত কম।

আলোচ্য বিষয়ে ভারতের কৌশলী কূটনৈতিক নেতৃত্ব কতটা সফল হতে পারে সেটাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ।কারণ এশিয়ায়          সবুজ অর্থনীতির স্বার্থে দেরিতে হলেও ভারত ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তি ‘ন্যশন্যাল ডেজিগনেটেড অথরিটি ফর দ্য ইমপ্লিমেনটেশন অব দ্য প্যারসি এগ্রিমেন্ট(NDAIAPA)’কার্যকর করেছে।চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬.২ পরিচ্ছেদের ধারা কার্যকর করবে। যে ধারায় বলা আছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে কার্বনমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।এই বিষয়কে সামনে রেখে গত মাসের ১৭ তারিখে ভারতের জি ২০ সচিবালয় এবং ভারতীয়স্থ রাষ্ট্রসংঘের শাখা অফিস যৌথ ভাবে একটি বৈঠক করে। ‘’জি ২০ মডেল মিটিং’’ শিরোনামে এই বৈঠকে ‘ইয়ুথ ফর লাইফ(Youth for LiFE)থিমের উপর গুরুত্ব  দিয়ে আলোচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে ‘লাইফ স্টাইল ফর এনভায়ারনমেন্ট(LiFE)’ আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষকে জি ২০ প্রেসিডেন্সির নেতৃত্ব যুক্ত করতে আগ্রহী। সামজে দৈনিক জীবনে পরিবর্তন এনে পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রার কথা বলা হচ্ছে আলোচ্য থিমে। LiFE নামক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পরিবেশ বিষয়ক সামাজিক রীতিনীতি। যার গালভরা নামকরণ করা হয়েছে ‘Pro-Planet-People(P3)’। এই প্রকল্প ‘পরিবেশ বান্ধব’ হিসাবে গ্লোবাল নেটওয়ার্কে কাজ করবে।

এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যায় ৯-১১ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গালুরুর বৈঠকে কর্ণাটক রাজ্যের বন ও বন্যপ্রাণ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই রাজ্যের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী লীনা নন্দন এবং রাজ্যের মুখ্যসচিব বন্দনা শর্মাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২১ ফেব্রুয়ারি আলাদা করে একটি বৈঠক করার। সুত্রের খবর, সবুজ অর্থনীতির স্বার্থে কর্ণাটক সরকার একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষ এবং পশুর মধ্যে সংঘাত কমিয়ে আনতে কর্ণাটক বন দফতর ‘ই-পরিহারা’(E-Parihara) নামে এক জানালা উদ্যোগ নিয়েছে।এই উদ্যোগের মধ্যেই আছে হিংস্র পশুর আক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা। শিকারির হাত থেকে বন্যপ্রাণকে বাঁচাতে ‘ই-গাস্টু’(E-Gastu) নামে আলাদা একটি ই-প্রক্লপও চালু করছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি রাজ্যটি।        

 সম্প্রতি কলকাতা প্রেস ক্লাবে ‘জি ২০ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জঃ ন্যাশন্যাল অ্যান্ড রিজিওন্যাল পারস্পেকটিভস’ শিরোনামে একটি আলোচনা সভা হয়। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় অধ্যাপক সুগত হাজরা বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলের জনপদ নিয়ে নতুন সমস্যার কথা বলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা জোশী মঠের অভিঞ্জতার কথা বলতে পারি। বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের রাজ্য বাংলাও। উত্তরে দার্জিলিং, দক্ষিণে সাগর এবং মাঝে রানিগঞ্জের মতো কয়লাখনি এলাকা আছে। যে কোনও জায়গাতেই বড় রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।ভারতের নেতৃত্বে জি২০ প্রেসিডেন্সির বিশেষ ভাবে নজর দেওয়ার দাবি ওঠে এদিনের আলোচনাসভায়।    

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?