ফসিল ফুয়েলঃ যুগান্তের অবসান
দীপেন্দু চৌধুরী
সংবাদে প্রকাশ বিশ্বের প্রায় সাড়ে ছ’হাজার শহরের উপর একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, কলকাতার পিএম ২.৫-এর মাত্রা ২০২১ সালে ছিল ৫৯ মাইক্রোগ্রাম। তুলনামূলক হিসাবে দাঁড়াচ্ছে বিগত বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার প্রায় ২৬ শতাংশ।দিল্লির থেকে এই মাত্রা কম হলেও দেশের অন্যান্য মেট্রো শহরগুলির থেকে চোখে পড়ার মতো বেশি। আবার কলকাতায় দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির হার দেশের রাজধানী সহ সমস্ত মেট্রো শহরকেই পিছনে ফেলে দিয়েছে। বিষয়টা চিকিৎসক, পরিবেশ বিঞ্জানী, পরিবেশবিদ সহ সকলকেই গভীর উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে। চিকিৎসকদের অভিমত বাতাসে থাকা অতি সূক্ষ্ম কণা পিএম ২.৫ মানবদেহের ফুসফুসে অনায়াসে প্রবেশ করতে সহায়ক ভূমিকা নেয়।এই ধূলি কণা থেকে ক্যানসার সহ বিভিন্ন ধরণের জটিল রোগ হতে পারে। মাতৃগর্ভে থাকা একজন শিশুর শরীরকেও দূষিত এই ধূলি কণা প্রভাবিত করতে পারে। এবং চিকিৎসকরা আরও দাবি করছেন, বাতাসে এই কণার সোচ্চার উপস্থিতি মানবশরীরে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কণার বার্ষিক সর্বচ্চো সীমা ৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছে। এই হিসেব মেনে চললে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি সচেতন শহর কলকাতার বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তঃসরকার সংগঠন ‘আইপিসিসি’-র ২০২১ সালের অগস্ট মাসের একটি সমীক্ষা রিপোর্টে সারা বিশ্বে বিপর্যয়ের আভাস দেওয়া হয়েছিল। দাবানল, অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির আভাস ছিল এই রিপোর্টে। ২৩৪ জন বিঞ্জানী তিন হাজার পৃষ্ঠার বেশি গবেষণামূলক দীর্ঘ এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন। তাঁদের লব্ধ সমীক্ষা রিপোর্ট সারা বিশ্বকে ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ তথা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নতুন করে ভাবতে বলে। চলতি বছরে ৬ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত COP27 জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেল মিশরের শর্ম এল-শেখ শহরে।
১৮ নভেম্বর শেষ হওয়া জলবায়ু সম্মেলনে ২০২১ সালে আইপিসিসি-র করা সমীক্ষা রিপোর্টকে সামনে রেখেই সারা বিশ্বের নেতৃত্ব পরবর্তী বছরের অ্যাজেন্ডা ঠিক করেছে।ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ২০১৫ সালের জলবায়ু সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল উন্নত রাষ্ট্রগুলি বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখবে।যে চুক্তিকে জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় ‘প্যারিস চুক্তি’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সাত-আট বছর পর দেখা যাচ্ছে সামান্য দু’একটি রাষ্ট্র এই শর্ত পূরণ করতে পারলেও বেশির ভাগ উন্নত রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ব নেতৃত্ব এই সম্মেলনে উল্লেখিত বিষয়ে সহমত হয়েছেন এবং পরবর্তী বছরের জন্য নতুন রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে। মিশরে অনুষ্ঠিত Cop27 সম্মেলনে।জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়-ক্ষতির(Loss & Danage)প্রসঙ্গে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছিল। উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পার্থক্য ও সীমারেখা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এই ইস্যুতে গত বছরে গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত Cop26 সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’-র প্রসঙ্গ উঠলেও সিদ্ধান্ত হয়নি।এই বছরের অধিবেশনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফেসিলিটি’-র প্রস্তাব নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব আলোচনা করে।গ্লাসগো সম্মেলনে যে সিধান্ত ঝুলে ছিল মিশরের শর্ম এল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেই খাতে উন্নত রাষ্ট্রগুলি একটি আন্তর্জাতিক ফান্ড গড়ে তুলবে। সংগৃহীত ওই ফান্ড থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রকে আর্থিক সাহায্য করা হবে।COP27 সম্মেলনে বিশেষ ভাবে আলোচনায় উঠে আসে ফসিল ফুয়েল থেকে ‘জাস্ট ট্রানজিশন’-নামক নতুন অধ্যায়।যাকে বলা হচ্ছে সবুজায়নের অর্থনীতি।যেখানে উন্নয়নও থাকবে, কিন্তু অপচয় ঘটবে অত্যন্ত ন্যুনতম।
এই বিষয়ে ভারতেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশের ‘ইন্টার
মিনিস্টার কমিটি অন জাস্ট ট্রানজিশন ফর্ম কোল’ ক্ষয়ক্ষতিহীন ‘গ্রিন এনার্জি ইন্ডিয়া’
ফান্ডের জন্য সম্প্রতি প্রস্তাব করেছে। ফসিল ফুয়েল নির্ভর অঞ্চল তথা কয়লা খনি অঞ্চলে
‘থ্রি টায়ার’ পরিকাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহী কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ ভারতের ‘ফসিল ফুয়েল’-র
উৎস প্রায় শেষ হওয়ার প্রহর গুণছে।ভারত যেহেতু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল,
তাই ভারত সরকার আস্তে আস্তে ‘জাস্ট ট্রানজিশন’-র পথে এগতে চাইছে।আগামী এক দশকের মধ্যে
আমাদের দেশে কয়লার মজুত ভান্ডার শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারের নীতি হল
জীবাশ্ম-মুক্ত অঞ্চলে সোলার বিদ্যুতের পরিকাঠামো গড়ে তোলা।
Comments
Post a Comment