ভাষা সেতুর কারিগর তিনি

দীপেন্দু চৌধুরী

আমি আপনি যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সেটা পরিবর্তন হতে পারে। ভাষার একটা ধাবাহিক পরিবর্তন ঘটে। গুণগত পরিবর্তনও হয়। ভাষা যখন একটা যুগ থেকে একটা যুগে যায়, তখন কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটে।গুণগত পরিবর্তন হয়। আমরা যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সেটা পরিবর্তন হতে পারে। ভাষা যখন একটা যুগ থেকে একটা যুগে যায়, তখন কাঠামোরও পরিবর্তন হয়। সেই সন্ধিক্ষণে ধ্বনি বদলে যায়। শব্দ বদলে যায়। বাক্য বদলে যায়। এক একটা স্তরে এই বদল আসে। ভাষাতো আগে লিখিত ছিল না। এ কথা আমরা সবাই জানি। তাই ভাষার গুণগত পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। ভাষা বিঞ্জানীরা ভাগ করেছেন এমন ভাবে, ভাষা বৈদিক, ভাষা অবৈবিক। সামাজিক কারণেই ভাষার কাঠামোর পরিবর্তন হয়। কথাগুলি বলছিলেন ভাষা গবেষক অধ্যাপক মহীদাস ভট্টাচার্য।২৬ নভেম্বর ছিল আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ১৩২ তম জন্মদিন।সেই উপলক্ষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে ‘আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’-য় মহীদাসবাবু এই কথাগুলি বলেন।স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষার গুণগত পরিবর্তনঃ নবজাগরণের সুদৃঢ় বুনিয়াদ’ আমরা সেই সূত্র ধরেই দেশের ভাষা বিতর্কের সময়ে বাংলা ভাষার বিকাশের ধারা আলোচনা করতে চাইছি।  

ভাষা, চিন্তা ও সমাজ পরস্পরের পরিপূরক। উনিশশতকে বাংলাভাষার যে পরিবর্তন হয়, সেই পরিবর্তনের কারণেই আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের চিন্তা অতিদ্রুত নগর সভ্যতায় শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে সমাজ যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, সমান্তরাল ভাবে বাংলা ভাষারও গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। বলা যেতে পারে ১৮০০ থেকে ১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ভাষার কাঠামোর যে পরিবর্তন তা এদেশে মাতৃভাষাগুলি বিকাশের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করেছিল। যেটি মূলত ফোর্ট উইলিয়ামে রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারদের হাত ধরে শুরু হলেও রামমোহন ও তার পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের দূরদৃষ্টি ছিল তাই তাঁরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে মানব কেন্দ্রিক একটি নতুন সমাজ গড়ে তোলার কর্মযোগে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছিলেন। বাংলা ভাষাকে সমস্ত বিষয়ে সকলের গ্রহণযোগ্য রুপে গড়ে তোলার জন্য প্রয়াসী হয়েছিলেন তাঁরা। গার্হস্থ জীবনে বাংলার যে রুপ ছিল সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ভাষায় পাশ্চাত্যের নতুন নতুন বিষয়বস্তুর সংযোজন ঘটিয়ে ভাষার মর্যাদাকে যেমন বাড়িয়েছিলেন তাঁরা, পাশাপাশি ভাষার অঙ্গসজ্জাকে একটি নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছিলেন।বিস্ময়ের বিষয় বাংলায় গদ্য উদ্ভবের পরে মাত্র চার পাঁচটি দশকের মধ্যে বিশেষ করে ১৮৪৭-এর পর দুটি দশকেই ভাষা তার নিজস্ব রুপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় মর্যাদায় ও অঙ্গসজ্জায়। এরই পরিণতিতে বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন ও বঙ্কিমের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে।মাইকেল মধুসূদন দত্তের দ্বিশতবর্ষের উদযাপনের ভাষা উদ্যানে বাংলা ভাষা আজ স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে। বিশ্বের দরবারে তার অস্তিত্বও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করতে গেলে এবং অন্যান্য মাতৃভাষাগুলিকেও বিকশিত হতে গেলে ভাষা পরিকল্পনায় এই অবদানগুলি বিবেচনায় আনা প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে করেন অধ্যাপক মহীদাস ভট্টাচার্য। 

বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে বাংলা ভাষা আপন বৈশিষ্টে কল্লোলিত হয়ে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।পরবর্তীতে বাংলাভাষার মেদ ঝরিয়ে ‘বাংলাভাষা’ স্বকীয়তার দাবিতে বৈঠকি আড্ডা থেকে গবেষকের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।এ কথা আজ আর বিতর্কের বৈঠকখানায় আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। কারণ আঠার শতকের বাংলা গদ্যের উত্তরসূরি উনিশ শতককে ধরা হয়। যদিও উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকের গদ্য-সাহিত্য ছিল বিতর্কে জর্জরিত।কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন যে সেই সময়ের গদ্য আদৌ সাহিত্যপদবাচ্য ছিল কী? ভাষাবিদরা বিতর্কের কথা স্বীকার করেও অভিমত প্রকাশ করেছেন, তৎকালের দুর্বল গদ্যসাহিত্য পরবর্তী কালের বলিষ্ঠ কথাসাহিত্য নির্মাণে সহায়ক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বৈচিত্রের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আধুমিক গদ্যের কাঠামোকে সুদৃঢ় করে গড়ে তোলেন আধুনিক ভাষা শিল্পীরা। বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সময়কাল নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। পণ্ডিত গবেষকরা অনুসন্ধান করেছেন এবং বর্তমান সময়েও করে চলেছেন। গবেষকদের সুদৃঢ় অভিমত, আধুমিক বাংলা গদ্যের জনক বহু ভাষাবিদ রাজা রামমোহন রায়।ভাষাবিদদের কেউ কেউ এই অভিমতও পোষণ করেন যে, রামমোহনের পূর্ববর্তী যুগে সাহিত্য-পদবাচ্য কোনও গদ্য সাহিত্য রচনা হয়নি। বিপরীত অভিমতও রয়েছে, রামমোহন রায়ের সমকালীন উইলিয়াম কেরী বা ফোর্টউইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের রচনাকেও আধুনিক বাংলা গদ্য-সাহিত্যের বিকাশের ধারায় রাখার কথা বলছেন। প্রসঙ্গটি আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

বাংলা সাহিত্যের গবেষকরা বলছেন, বাংলা গদ্যের ব্যবহার ঠিক কোন সময়কাল থেকে শুরু হয়েছে তা জানা যায় না। বাংলা ভাষা বিশেষঞ্জরা আরও দাবি করছেন, সংস্কৃত প্রাকৃত ও মাগধী বাংলা ভাষা মৌখিক ভাষারূপে ব্যবহার শুরু হয় নবম শতাব্দী থেকে। এই সময়কার কথ্য ভাষা পূর্ণতা লাভ করে ত্রয়োদশ শতকে। এ কথা প্রমাণিত সত্য মুখের ভাষা সাবলিল ভাবে লিখে গেলেই সহজ গদ্য হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি প্রয়োজন হয়, ব্যাপক ব্যহারের সুযোগ, অর্থাৎ লেখার মাধ্যম। একটি ভাষার উন্নতির জন্য আরও প্রয়োজন হয় পৃষ্ঠপোষকের। এই সূত্র ধরেই বলা যায়, প্রাচীনকালে সংস্কৃত, মুসলমান যুগে ফার্সি আর ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজি। উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের আগে দেশীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের কাছে বাংলা ভাষার কোনও মর্যাদা ছিল এমনটা বলা যাবে না। সেই সময়ে শিক্ষা-সাহিত্যের আঙিনা বাংলা সাহিত্যের জন্য উপেক্ষিত ছিল। গোঁড়াপন্থীদের অহেতুক আনুষ্ঠানিক উপেক্ষা কাটিয়ে তবেই বাংলা গদ্য-সাহিত্যের বহতা খরস্রোতা নদীর মত প্রবাহিত হতে পেরেছে। এই লড়াই দীর্ঘ দিনের লড়াই ছিল। ১৫৫৫ সালের আগে বাংলার গদ্যরূপ পাওয়া  যায়নি। উনিশ শতক পর্যন্তও মৌখিক ভাষার মধ্যে অসংস্কৃত ও বিদেশী শব্দ স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহার হত। বর্তমান সময়ের  বাংলা ভাষাভাষী তরুণ প্রজন্মের ‘হিন্দি’ এবং ‘ইংরেজি’ শব্দ ব্যবহারের মতই। উনিশ শতকে মৌখিক ভাষায় অসংস্কৃত ও বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশ সংস্কৃত পণ্ডিতরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা বাধা দিয়েছিলেন, ফলে বাংলা ভাষার বিকাশে এক আড়ষ্টতা দেখা দেয়। যেটা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা আনন্দের ছিল না। এতদ সত্বেও ভাষাবিদরা দাবি করছেন, উনিশ শতকের অনেক আগেই বাংলা গদ্য একটা সুস্পষ্ট রূপ পেয়ে যায়। এর পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে উত্তরণ হয় বাংলা ভাষার। তার অন্যতম কারণ হিসাবে বলা হয় বাংলার বহুসংখ্যক মানুষ অকৃত্রিম ভাবে সাহিত্য অনুরাগী ছিল। এই সব পাঠকদের দরদী আগ্রহের জন্যই বাংলা গদ্য সাহিত্য অনুপ্রেরণা পায়।


বাংলা ভাষার বিকাশের ক্রমপর্যায়ে রাজা রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্যাসাগরের নাম আমাদের উচ্চারণ করতেই হবে। নাম আসবে গদ্য লেখক রবীন্দ্রনাথের। এবং সেই সঙ্গে চলিত ভাষার জন্য অবশ্যই প্রমথ চৌধুরীর কথা বলতে হবে।বাংলা ভাষার সুপণ্ডিতদের অভিমত অক্ষয়কুমার দত্ত এবং বিদ্যাসাগর দুজনেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থেকেও তাঁরা স্বতন্ত্র ছিলেন। বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আমরা আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ বলেছি।ভারতীয় প্রাচীন যুগ যেখানে শেষ হয়েছে, সুনীতিবাবু সেখান থেকে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। ভাষা সেতুর কারিগর ছিলেন তিনি। সুনীতিবাবু তাঁর গবেষণার তথ্য বিভিন্ন ফাইলে অগোছাল ভাবে রাখতেন বলে জানা গেছে। ওই সব পুঁথি ও তথ্যসমৃদ্ধ ফাইলগুলি গুছিয়ে রাখার কাজ করেছেন অধ্যাপক মহীদাস ভট্টাচার্য। ৬৫টা আলমারিতে আনুমানিক ২০ থেকে ২২ হাজার বই ছিল। তাঁর পরিবার দিল্লির একটি পাঠাগারে বইগুলি  দান করে দিয়েছেন।                                                              


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?