‘মাতৃ ভাষা রুপে খনি, পূর্ণ মণিজালে’

দীপেন্দু চৌধুরী

বেলা শেষের গান লিখতে বসেছি বলা যাবে না। বছর শেষের সংলাপ আবৃত্তি করছি সেটাও বলতে পারছি না। কারণ এই দিনে আমরা প্রতি বছর উচ্চারণ করব আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা নিয়ে বিতর্ক আজকের বিষয় নয়। ভাষাবিদরা টানা লম্বা এক বিতর্ক বাঁধিয়ে দিতে পারেন। ২০১৯ সালের কলকাতা বইমেলায় এসে বাংলা ভাষার বৈচিত্রের কথা বলেছিলেন, ‘হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি’-র লেখক গুলাম মুর্শিদ। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই বাংলা ভাষার কত বৈচিত্রের প্রসঙ্গে তিনি আলোচনা করে গেলেন। বললেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার পার্থক্যের কথা। শব্দ চয়নের পার্থক্য, বাক্য গঠনের বৈচিত্র। আঞ্চলিক প্রকারভেদের প্রসঙ্গে তিনি বলে গেলেন। তার কথার বাস্তবতা পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখায়। পূর্ববঙ্গ নামক একটি ভূখণ্ডের বৈচিত্রের একটি খন্ড ছবি উল্লেখ করা যাক। ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’-এ যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখছেন, ‘’ ‘বাইদা’ বা বেদে নামক একশ্রেণীর পাবর্বত্য অসভ্য জাতীয় লোক বিক্রমপুরের বাণিজ্য-বন্দর সমূহের নিকটে নৌকা যোগে বসবাস করিয়া থাকে, ইহাদের স্ত্রী পুরুষ উভয় সম্প্রদায়ই ব্যাবসায়ে বিশেষ দক্ষ। ...ইহারা নদী, খাল, বিল হইতে অপর্যাপ্ত পরিমাণ ঝিনুক সংগ্রহ করিয়া বিক্রয় করে, ধোপাগন এই ঝিনুক দ্বারা চূণ প্রস্তুত করে এবং শিল্পীগণ ইহার দ্বারা বোতাম, চেইন ও নানাবিধ সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া বিক্রয় করে‘’।।(বিক্রমপুরের ইতিহাস, প্রকাশক, সুধাংশু গুপ্ত, প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৪৬,পৃষ্ঠা- ৩৮-৩৯)



 

এই সূত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে এপার বাংলার ভাষা প্রসঙ্গ। বাঙালি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা। একই অঙ্গে কত রূপ। দীর্ঘ দিনের অভ্যেস আমাদের। দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গ হিসেবে আমাদের রাজ্যকে আমরা বলতে অভ্যস্ত।একই রাজ্যের দুটি ভূখণ্ড এক রাজ্য প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ভাষার নিয়ন্ত্রণ কে বা কারা করবে? দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষার পার্থক্য বিস্তর। আবার পাহাড়ের বাংলার সঙ্গে সুন্দরবনের কথ্য ভাষার স্টাইল আলাদা। ভাষাবিদরা দাবি করছেন, পশ্চিমবঙ্গের অঞ্চলভেদে কথ্য বাংলা ভাষার উচ্চারণ এবং সুরের বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা কলকাতা শহরে এসে নিজস্ব চরিত্র পায়। যাকে ‘কলকাত্তাই বুলি’ উপ শিরোনামে চিহ্নিত করেছেন ভাষাবিদরা। তবুও অঞ্চল ভেদে পশ্চিমবঙ্গ নামক সত্য উত্তর জনপদে রাজ্যের উপভাষা আলাদা আলাদা ‘মাতৃভাষা’ নিয়ে বেঁচে আছে। যাকে আমরা আদর্শ বাংলা বা ‘Standard Colloqual Bangali Language’ বলতে পারি। ভাষার এই বৈচিত্রই  ১৯৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে।  

গুলাম মুর্শিদ লন্ডননিবাসী। আক্ষেপ করে বলছিলেন, দুই বাংলার বাঙালিদের কথা। লন্ডনে বা ব্রিটেনে বসবাস করেন যারা, সেই সব বাংলাদেশের বাঙালিরা নিজদের বাঙালি বলেই মনে করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যারা ব্রিটেনে আছেন তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে দাবি করেন। তাঁরা আগে ভারতীয় পরে বাঙালি। প্রবীণ অধ্যপক অমিয় দেব আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন, আপামর বিশ্বে যে সব বাঙালি আছেন তাঁদের সংখ্যাধিক্যের দাবি যে তাঁরা আগে বাঙালি পরে ভারতীয়। আলোচ্য প্রতিবেদক প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছিল। প্রশ্ন করেছিলাম সারা বিশ্বে ২৭-৩০ কোটি বাঙালি। ভাষায় কিছুটা বৈচিত্র থাকলেও খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, সংস্কৃতি এতটাই আত্মীয়তা দাবি করে আমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হব কোন দুঃসাহসে? বাংলা ভাষার দুই বিদগ্ধ পণ্ডিত আমার সঙ্গে সেদিন একমত হয়েছিলেন।

দুই প্রবীণ ভাষাবিদের কথার রেশ ধরেই বলতে হয় ভাষা নিয়ে বিতর্ক ছিল। বিতর্ক আছে বিতর্ক থাকবে। ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লাহ বলে গেছেন, ‘’আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি আমরা বাঙালিএটি কোনও আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। যা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।‘’      

দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের আগে বাংলা বলতে আমরা বুঝতাম, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা মিলিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল। এই ভূখন্ডটি ভৌগলিক অবস্থানে আয়তনে ফ্রান্স দেশটির তুলনায় কিছুটা বড়। ইতিহাসবিদরা দাবি করছেন ‘বাংলা’ নামক প্রদেশটির উদ্ভব (ব্রিটিশ আমলের ‘বাংলা’) মুঘলকালীন বাংলা সুবা থেকে। বিতর্ক আছে। বিতর্ক থাকতেই পারে। তারপর এতটা পথ আমরা অতিক্রম করেছি। স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের ভাষা বৈচিত্র এক সময়ের অখন্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হত। রাষ্ট্র ও জাতি সমস্যা বিষয়ক আস্ত একটা বই সে কালে লিখে ফেলেছিলেন সেই সময়ের শাসক জোসেফ স্তালিন। ভাষা আজও আমাদের দেশের প্রধান একটি সমস্যা। ‘ভারত’ রাষ্ট্র হিসেবে এখনও স্বনির্ভর হয়েছে কি? তারপরে ভারতীয় ভাষা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। অর্থনৈতিকভাবে, বৈদেশিক বাণিজ্যে, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ভারত আত্মপ্রকাশ করলে তবেই আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নিজেদের রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে ভাবব। যদিও বর্তমান ভারতে রাজ্য ভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষার সমান মর্যাদার দাবিতে লড়াই বজায় আছে। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের গর্ব অবশ্যই শুধুমাত্র একটি বিশেষ ভাষা নিয়ে নিশ্চয় নয়।

অনেক ব্যথা, বেদনা যন্ত্রণা বাংলা তথা বাঙালিকে সহ্য করতে হয়েছে একটি ভূখণ্ড ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা লিখছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত্রি ঘটিকায় ক্ষমতা হস্তান্তেরর শুভ সন্ধিক্ষণে কলিকাতায় গবর্ণমেন্ট হাউসে এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়া ভারতীয় ডোমিনিয়নের অন্যতম প্রদেশরূপে নতুন পশ্চিম-বঙ্গ প্রদেশ জন্মলাভ করে (বানান এক রাখা হল) একটি ভূখণ্ড দু'বার খণ্ডিত হয়েছে তবু আমাদের শব্দ এক, বাক্য এক, সাহিত্য এক শুধু দুই বঙ্গে কথ্য ভাষার স্টাইল আলাদা আমরা বৃহৎ ব্যপক অর্থে বাঙালি মাতৃভাষার অধিকার প্রত্যেকের আছে আন্তর্জাতিকতায় এবং আন্তরিকতায় ভাষাদিবস আমাদের আঙিনায় থাক, উৎসবের অধিকারে। ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছে। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। সারা বিশ্বের মানুষের মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তাই আমরাও মাতৃভাষা দিবসে মধু কবির দ্বিশতবর্ষের প্রাক্কালে তাঁর নবজাগরণের ভাষায় বলব ‘’মাতৃভাষা রূপেখনি,পূর্ণ মণিজালে!’’         



 



Comments

  1. সুন্দর একটি লেখা❣️
    Thanks for sharing this valuable information and really appreciate your hard work and good research that help us in for of your good valuable article. Keep updating us with your awesome content.

    Night Teer

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?