‘সৌরমুকুট’ উত্তর আরোহণী সম্মেলন


 দীপেন্দু চৌধুরী 

গত বছর অতিমারির অভিঘাতে বিপর্যস্ত জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবে ঢেউ উঠেছে।বাঙালি নতুন আঙ্গিকে সামাজিক মেলা-খেলা, আড্ডায় ভিড় করছে।বাবু-বিবিরা রেস্তঁরায় ছুটছেন, ক্লান্ত মনে রঙের উৎসবে ভাস্তে। ছেলে-ছোকরার দল   অঘোষিত মহামারির অচেনা ভয়-ভীতি কাটিয়ে চায়ের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে।এই অবকাশে সামাজিকমাধ্যমে আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আলাপ হল। আলাপের পরে বুঝলাম আমি ‘কেউকেটা’ না হলেও তিনি আমাকে সাংবাদিক হিসেবে ভালোই চেনেন। এবং কিছুটা ঈর্ষাও করেন সম্ভবত।করতেই পারেন, তবে কিছুটা উন্নাসকিতায় থাকেন তিনি।ভদ্রলোকের চেহারায় ঞ্জানলব্ধ প্রতিষ্ঠার একটা প্রাচুর্য আছে।সেই সঙ্গে আছে মধ্যবিত্তসুলভ এক অপ্রয়োজনীয় অহংকার।মধ্যবিত্তের আনুষ্ঠানিকতায় যারা অভ্যস্ত। ভদ্রলোক নাকি সত্যজিৎ বিশেষঞ্জ। দেশে-বিদেশে চর্চিত ঞ্জানের জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন।

না তিনি আমায় সামাজিক আড্ডায় বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই তথ্য দেননি।দেওয়ার মত উদারতা আদৌ কী আছে? এরা আদৌ কী সবান্ধব জীবন চর্চার কথা ভাবেন? সম্ভবত নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলে থাকতে অভ্যস্ত।আমি ভদ্রলোকের সমাজমাধ্যমের লেখায় এই সত্য খুঁজে পেয়েছি।ভদ্রলোক গত বছর কেন জানি না, সত্যজিৎ রায় বিষয়ক একটি আলোচনাসভায় আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায় নিয়ে বক্তব্য রাখলেন সেদিন। আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হল। সেদিন আমার প্রশ্ন ছিল, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন অথচ সত্যজিৎ রায় রামমোহন বা ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে কোনও ছবি করলেন না কেন? শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রশ্নটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরও দিলেন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার প্রশ্নের সঙ্গে আমি একমত। তবে সত্যজিৎ নিয়ে গবেষণা করে যেটা জানা যায়, সত্যজিৎ রায় ‘রাজা রামমোহন’ নামে ছবি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি করতে পারেননি। তবে ‘চারুলতা’ ছবিতে সত্যজিৎ ব্রাহ্ম সমাজকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এই ছবির দু’একটা দৃশ্যে ব্রাহ্ম সমাজের প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়।


 গত বছর মোলালী যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সত্যজিৎ রায় বিষয়ক আলোচনাসভাটি একটি বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠনের  অনুষ্ঠান ছিল।সেখানেই সমাজমাধ্যমে আলাপ হওয়া ভদ্রলোককে প্রথম দেখেছিলাম। মাথায় বহু রঙে বর্ণিত কাপড়ের এক ধরণের ফেজ টুপি। পরনে লাল পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা।কাঁধে লাল কাপড়ের ছোট ব্যাগ। বোঝাই যায় ‘আমি বামপন্থী’ বলার এক উচ্চকিত বিঞ্জাপন।সেটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচি বা পছন্দ। এই বিষয়টা নিয়ে আমার বা আমদের কিছু বলার নেই। ভদ্রলোক বয়সে আমার সমসাময়িক। আমরা কৈশোর থেকে প্রখর যৌবনের প্রান্তিকতায় পৌঁছেও এমনতর বিঞ্জাপনের প্রয়োজন অনুভব করিনি। পৌঢ় বয়েসে পৌঁছেও অনুভব করি না। পোশাকী বিঞ্জাপন বলাটা কী অসৌজন্য হবে? আধুনিক ভারতের ‘সত্য উত্তর’ সমাজে বামপন্থীদের মেধাকে দুর্বল ভাবাটা হবে এক ধরণের উন্নাসিকতা। তবুও বামপন্থীদের আত্মভিরুতা অবলোকন করে কেন জানিনা থমকে দাঁড়াতে হয়। গত সপ্তাহে এক তরুণ লেখকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে ‘এবিটিএ’ শিক্ষক সংগঠনের সদস্য প্রণব(নাম পরিবর্তিত)।ফোনে কথা বলতে বলতে আক্ষেপ করছিল, ‘’হিন্দু সম্রাট, রাজাদের অত্যাচারের ইতিহাস নিয়ে লিখলে হিন্দু অতিদক্ষিণপন্থীরা আক্রমণ করে। আবার মুসলিম সম্রাট-রাজাদের সময়ের অত্যাচার নিয়ে লিখলে মোলবাদী মুসলিমরা আমাকে গেরুয়া বলে চিহ্নিত করতে চায়।‘’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, সম্প্রতি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ‘কে হলুদ জামা পরল আর কে লাল জামা পরল সেটা দেখে বিচার করাটা আমাদের কাজ নয়।’ এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তিনি মানবতায় বিশ্বাস করেন যারা তাঁদের কথা বলছেন।নীতি কৌশল আলাদা হতেই পারে।


  

হুগলী জেলা নিবাসী আমার তরুণ শিক্ষক তথা ‘সাহিত্য বন্ধু’ সেদিন বলল, ‘আমি রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে এই বছরের ‘লিটল ম্যাগাজিন মেলা’-য় গিয়েছিলাম। দেখলাম লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, প্রচ্ছদ শিল্পীদের বেশীরভাগই বামপন্থী, তাই আপনার কথা ঠিক। ওদের মধ্যে মেধা আছে। লাল রঞ্জে রাঙিয়ে সেই মেধাকে উচ্চকিত করার কোনও প্রয়োজন নেই।’ আমারও একই মত।সাহিত্যবন্ধু, পাঠকবন্ধুদের পর্যবেক্ষণ এবং অভিমত জানার অপেক্ষায় রইলাম। ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে পছন্দ হোক বা না হোক।মেধাবী হওয়ার জন্য কোনও নির্দিষ্ট একটি দল বা ধর্মের গোষ্ঠিভুক্ত হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতার খুব কিছু প্রয়োজন থাকে কী? বাঙালি মেধা রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, হুতোমের লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহ, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, সত্যজিৎ রায়কে কোনও দলগত মঞ্চে বেঁধে রাখা যাবে? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর, গণেশ পাইন সহ ধ্রুপদী চিত্রশিল্পীদের কোন মঞ্চে রাখব আমরা? লালন সাঁই বা বাউল-সুফিদের কোন ধর্মের সীমান্তে গিয়ে খুঁজে পাব? ‘রাশিদ খান সুর লাগালে ব্রজে চলেন শ্রী রাধা’। সকলেই নির্দিষ্ট মতবাদের উর্ধে মানবতার পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন।অশোক মিত্র তাঁর ‘আপিলা-চাপিলা’ বইয়ে লিখছেন, ‘’...............লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি জ্যোতিবাবু আদ্যপান্ত পড়েছেন, মার্কসীয় ধ্রুপদী সাহিত্যের আরণ্যক ভিড়ের মধ্যে এই গ্রন্থনার কথাই তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন। অথচ যা ঈষৎ হেঁয়ালি, রাজপুরুষদের স্বভাবচরিত্র বিচারে লেনিনের মন্তব্য অনেকটা পাশ কাটিয়ে জ্যোতিবাবু এ ব্যাপারে খাঁটি ব্রিটিশ ধাঁচের উদারনৈতক।‘’



 সুদীর্ঘ দিন রাজনীতির করার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন উপলব্ধি। ৪৬তম কলকাতা বইমেলায় তিনি বলছেন, ‘আমি খুব ক্ষুদ্র মানুষ। আমার সবটাই কুৎসার আঙিনায়, অপপ্রচারের আলিঙ্গনে। আমি তো সমালোচনার উর্ধ্বে নই। আমায় সমালোচনা করলে আমি বরং খুশী হই। কারও সমালোচনা থেকে যদি কিছু শিখতে পারি, তার থেকে বড় আর কী হতে পারে!’  

গুণিজন, পণ্ডিতজনেরা বলছেন, জীবনের প্রতিটি পলে, প্রতি পদক্ষেপে সভ্যতার সঙ্গী হিসেবে চরিত্ররা ভিড় করে এসে দাঁড়ায়। তাই বাংলা ভাষায়, ভাষার বৈশিষ্ট আমাদের চিনতে হয়। জানতে হয়। আহরণ করতে হয়। এবং বাংলা ভাষার কুশলী এই কৌশল বা ব্যকরণ জানবার এবং জানাবার দায় এবং দায়বদ্ধতা লেখক সমাজে গিয়ে বর্তায়।‘পণ্ডিতী ভাষা’, ‘আলালী ভাষা’, ‘অক্ষয়ী গদ্য’, ‘বীরবলীয় ভাষা’, ‘রবীন্দ্র-ভাষা’ টপকে আধুনিক বাংলা ‘বই-ঘর’ তৈরি হয়েছে।বইয়ের   পড়ার জন্য কফি হাউস তৈরি হয়েছে। মানবসভ্যতায় হিংসার জয় হয় না। হিংসার সত্যিই কোনও দেশ নেই, জাতি নেই, সম্প্রদায় নেই। ক্রোধ আর শোকের ধারা কোনও সীমান্তের বেড়া মানে না।সাহিত্যের আড্ডায় তাই জাত-পাত, বর্ণ-ধর্ম, সম্প্রদায় থাকে না। ‘বইয়ের জন্য হাঁটুন’, ‘বইয়ের জন্য বইমেলায় আসুন’ স্লোগানে স্লোগানে বইমেলা আজ বহতা নদীর বহুগামী প্রবাহে প্রবাহিত। কলকাতা, তিলত্তমা কলকাতা, কলকাতা শহরতলীর অক্ষরপুরুষদের কাটুম কুটুম শব্দের মূর্ছনায় রঙিন উঠোনে বন্ধু মিলন। ‘সৌরমুকুট উত্তর মেলন, সমাগম’।সৌরমুকুট উত্তর আরোহণী কলকাতা বইমেলা।                                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?