প্রকৃতির আশ্রয়ে ফিরবে কী জোশীমঠ !


 দীপেন্দু চৌধুরী

সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে একটা বিতর্ক উন্নত জীব হিসাবে আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে বিঞ্জান ও প্রযুক্তির দ্বন্দ চিরকালীন। এই দ্বন্দের সঙ্গে ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, সম্প্রদায় বিশেষে কোনও ফারাক করা যাবে না।প্রকৃতি ‘ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে’। ‘উন্নয়ন’ নামক গালভরা শব্দের আড়ালে এক ভয়ানক সামাজিক উদাসীনতা আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক তথা রাজনীতিবিদদের গ্রাস করে ফেলছে।জোশীমঠ বিপর্যয় সেই বাস্তব ছবি আমাদের সামনে এনে দিয়েছে।‘উন্নয়ন’-এর নামে পাহাড়ে আবাসন, ঘরবাড়ি, অভিজাত পাঁচতারা হোটেল তৈরির খেসারত দিতে হচ্ছে একটা প্রাচীন জনপদকে। সবুজ শ্যামলিমায় তির তির করে বয়ে যেত নদী।কুল কুল করে ছলাৎ ছল নদীর শব্দে ঘুম ভাঙত শান্ত নিবিড় এই পাহাড়তলি। গত কয়েক বছর নিঃশব্দ জনপদে শোনা যাচ্ছিল বোল্ডার ভাঙা ভারী হাতুড়ির শব্দ।ড্রিলিং যন্ত্রের দানবীয় শব্দ। অলকানন্দা ও সংলগ্ন নদীগুলিতে একের পর এক বাঁধ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।তৈরি হয়েছে জলাধার।স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদীর স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে প্রকৃতির আদিম গতিকে একরকম থমকে দেওয়া হয়েছে।   

নতুন পুরনো গাছ কেটে বোল্ডার সরিয়ে, পাহাড় সভ্যতা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুঁড়ে চওড়া করা হয়েছে, ‘চারধাম’ নামক ধর্মীয় পর্যটনের নতুন সভ্যতার রাস্তাঘাট। জোশীমঠের আয়ু খুব বেশি হলে ১০০ বছর। পাহাড়ি জোশীমঠের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৮৭৫ মিটার। উত্তরাখন্ডের চামোলি জেলার এই ছোট শহরটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই শহর থেকেই যেতে হয় বদ্রীনাথ, কেদারনাথ-সহ চারধাম তীর্থযাত্রা। আবার জোশীমঠের ১০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ভারত-চীন আন্তর্জাতিক সীমান্ত। নগরায়নের চাপে জোশীমঠের নাভিশ্বাস অবস্থা। ভারসাম্যহীন নগরায়নের কারণে একটু একটু করে তলিয়ে মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন শহর।ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র উপগ্রহ দ্রুত ভূমিধসের কথা জানিয়েছে। ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি, মাত্র ১২ দিনের মধ্যে জোশীমঠের প্রায় সাড়ে পাঁচ সেন্টিমিটার বসে গিয়েছে।                

বিরোধী দল কংগ্রেস সহ বিভিন্ন দলের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চারধাম জাতীয় সড়ক প্রকল্প, এনটিপিসি-র তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং কেদারনাথ-বদ্রীনাথ রেললাইন প্রকল্পের নামে পাথর কেটে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ধারণক্ষমতাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের আরও অভিযোগ, হিন্দু ধর্মের ‘স্বঘোষিত ঠিকাদার’-বিজেপির উদাসীনতার কারণেই মাটিতে ফাটল ধরে জোশীমঠের তলিয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।চারধাম পর্যটন মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছে প্রকৃতি বনাম সভ্যতার সংঘাত।জোশীমঠের রাতজাগা মানুষের আর্তনাদ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী-আমলারা আজ হয়ত শুনছেন বাধ্য হয়ে। প্রশাসন আগে শুনলে কয়েকশো পরিবারকে ঠাঁইনাড়া উদ্বাস্তু হতে হত না। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, জোশীমঠে ৩৮০০টি পরিবার থাকত। বহুবচনে লিখতে হচ্ছে। এঁদের মধ্যে প্রায় ১০০০ পরিবারকে ধসের কারণে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে উত্তরাখন্ডের রাজ্য প্রশাসন।

১৯৭৬ সালের সমীক্ষা রিপোর্ট কেন্দ্রের পরিবেশ, বিঞ্জান-প্রযুক্তি দফতরগুলিতে আগে থেকেই ছিল। যে রিপোর্ট ‘মিশ্র কমিটি’ রিপোর্ট নামে পরিচিত।গঢ়ওয়ালের কমিশনার মহেশচন্দ্র মিশ্র কমিটির ৪৭ বছর আগে করা এই সমীক্ষা রিপোর্টের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, জোশীমঠের আয়ু খুব বেশিদিন হলে ১০০ বছর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই সতর্কবার্তার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বিপর্যয় নেমে এল। এই রিপোর্টে বৈঞ্জানিক যুক্তি দিয়ে আরও বলা হয়েছিল, জোশীমঠের মাটি কাঠামোগত ভাবেই অত্যন্ত দুর্বল।জোশীমঠের উপর চাপ পড়লে শহরটি একদিন তলিয়ে যাবে।এই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হলেও সাম্প্রতিক কালের একটি রিপোর্টের কথা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। জোশী মঠের সহদরা রেইনী(Raini)গ্রাম মাত্র দু’বছর আগে ভাঙনের কবলে পড়ে।জোশীমঠ-মালারি রোডে অবস্থিত চামোলির কাছে রেইনী গ্রাম। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাহাড়ি বন্যা এবং ধসের কারণে চিপকো আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত গ্রাম রেইনির ব্যপক ক্ষতি হয়।  

এই গ্রামে ধস নামা নিয়ে ‘জিয়োলজিক্যাল অ্যান্ড জিয়ো টেকনিক্যাল রিপোর্ট ওভার রেইনী ভিলেজ’-এ বলা হয়েছিল, চড়াই-উতরাই বেস্টিত রেইনী গ্রামের সমস্ত বাসিন্দারা ঢালুপ্রবণ প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ পাহাড়ি ঝর্ণার চোরা স্রোত ‘উন্নয়ন’-এর ভুলভুলাইয়ায় পথভ্রান্ত নবকুমারের মত থমকে যায়। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পথভ্রান্ত, ক্লান্ত পাহাড়ি ঝর্ণার জলপ্লাবন বন্যায় পরিণত হয়। নন্দাদেবী পাহাড়ের একটা অংশের বহতা জল আধুনিক সভ্যতার কংক্রিটে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘর বাড়িতে আছড়ে পড়ে।এবং স্বতন্ত্রতা হারিয়ে ফেলা পাহাড়ি স্রোতের বন্যা গর্জন করতে করতে ঋষি গঙ্গায় আছড়ে পড়ে।ফলে পাহাড়ি বোল্ডার গড়িয়ে এসে নিচু জমিতে থাকা বাড়ি-ঘরগুলিতে ধাক্কা মারে।গঙ্গার প্রধান শাখা নদী ধৌলী গঙ্গা এবং অলকানন্দা নদী পাহাড়ি বস্তিতে আছড়ে পড়ার আগে ‘ঋষি গঙ্গা ড্যাম’ এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতি করে।সরকারি সমীক্ষক দল রিপোর্টে জানায়, আকস্মিক পাহাড়ি বন্যার কারণে অঞ্চলের অনেক বাড়ির ছাদ এবং মেঝেতে চওড়া ফাটল দেখা গেছে।তাই ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন প্রয়োজন।রিপোর্টের ভাষায় ‘ইট ইজ দেয়ারফোর অ্যাডভিসেবল টু রিহাবিলিটিটেট দ্য রেইনী ভিলেজ টু অ্যান অলটারনেট সেফ লোকশেন।‘’  

এই রিপোর্টের সতর্কীকরণের পরেও ‘চারধাম প্রকল্প’-র রাজনৈতিক ঠিকাদারদের টনক নড়েনি। আরও তথ্য উঠে আসছে,   টানা ১৪ মাস ধরে স্থানীয় মানুষেরা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত ভাবে আবেদন জানাচ্ছিল।হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার গড়িমায় তবুও সরকারের হেলদোল ছিল না।পরিবেশ নিয়ে কাজ করে ‘ক্লাইমেট ট্রেন্ডস’ নামে একটি সর্বভারতীয়  সংস্থা।জোশীমঠের স্থানীয় পরিবেশ কর্মী অতুল সাট্টি ‘ক্লাইমেট ট্রেন্ডস’-কে বলেছে, ‘’আমরা কয়েক বছর আগেই  একাধিবার কতৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলাম।জোশীমঠের প্রাকৃতিক কাঠামো ধ্বংস করে পাহাড়ি উপত্যকায় যে ভাবে বিস্ফোরন করে টানেলের ক্ষতি করা হচ্ছে সেই বিষয়ে আমরা প্রশাসনকে সতর্ক করেছিলাম।‘’ এইচএনবি গঢ়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ওয়াই পি সুন্দরিয়াল ‘সেন্ট্রাল হিমালয়া’ বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছেন। এই বইটি যৌথভাবে লিখেছেন হেইম, অরনল্ড ও অগস্ট গন্সেরের। জিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘’চামোলী জেলার জোশীমঠ ধসপ্রবণ এবং ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। ১৯৭১ সালেই কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। প্রশাসনিক রিপোর্টে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। ১৯৭১ সালের রিপোর্টে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল পুরনো গাছের সংরক্ষণ, শিশুরমতো যত্ন নেওয়া, নতুন গাছ লাগান। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া সিমেন্টের কংক্রিটের পরিবর্তে জোশীমঠের চতুর্দিকে বোল্ডার দিয়ে সুরক্ষা প্রাচীর তৈরি করা।‘’

অধ্যাপক সুন্দরিয়াল জানাচ্ছেন, এই পরামর্শ আজ পর্যন্ত প্রশাসন শোনার প্রয়োজন মনে করেনি। প্রশাসনে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়াররা আছেন।যারা ভূমিকম্পপ্রবণ এবং ধসপ্রবণ পাহাড়ি উপত্যকায় কিভাবে কাজ করতে হয়ে সেটা ভাল ভাবেই জানেন। তবুও এই বিপর্যয়ের সামনে আজ তাঁদের পড়তে হল। কারণ ১৯৭১ সালের রিপোর্ট এবং ১৯৭৬ সালের রিপোর্টের পরামর্শ তাঁরা মেনে চলতে পারেননি। সেক্ষেত্রে কারণ যাই থাক না কেন! জোশীমঠের বর্তমান সমস্যাকে প্রাথমিক ভাবে বলা যেতে পারে, নৃবিঞ্জান বা ভূবিঞ্জান বিষয়ে অঞ্জানতা অথবা উদাসীনতা। তিনি আরও বলছেন সরকারের ২০১৩ সালের কেদারনাথ বন্যা এবং ২০২১ সালের জলপ্লাবন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল।রাজ্য প্রশাসন প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির লড়াই লাগিয়ে দিল।ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়সংলগ্ন জনবস্তিগুলি পলকা ইকোসিস্টেমের মধ্যে পরে।উত্তরাখন্ড নামক রাজ্যটি অবস্থিত নৃতত্ব বিঞ্জানের ভাষায় ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চলে।জলবায়ু পরিবর্তনও জোশীমঠ ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ বলে অধ্যাপক ওয়াই পি সুন্দরিয়াল মনে করেন।

‘ভারতী ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক পলিসি’-র রিসার্চ ডাইরেক্টর এবং আইপিসি রিপোর্টের প্রথমসারির লেখক অঞ্জল প্রকাশও একই মত পোষণ করেন।তাঁর কথায়, মানুষের তৈরি জোশীমঠের বিপর্যয় আমাদের মনে রাখতে হবে। এটা একটা সতর্কবার্তা, প্রকৃতির সহনাগরিক হতে না পারাটা আমাদের দুর্বলতা। হিমালয়ের পাদদেশে যত্রতত্র উন্নয়নের নামে প্রাচীন ‘তপবন’-র গাছ কেটে ফেলা এবং কংক্রিটের জঙ্গল নির্মাণই জোশীমঠ ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ।এই বিষয়ে আইপিসি-র সতর্কবার্তা ছিল। অঞ্জল প্রকাশ দুটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১৯ এবং ২০২২ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্টে আইপিসিসি সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে জানায়, জোশীমঠের বিস্তীর্ণ এলাকা বিপর্যয়প্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। সেই কারণে এই অঞ্চলে উন্নয়নমূলক যে কোনও কাজ করার আগে সুচিন্তিত প্ল্যান তৈরি করা জরুরী। একই কথা আমাদেরও  পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, রাজ্য বা কেন্দ্র এই সতর্কবার্তা কানে তোলেনি কেন? প্রকৃতির আশ্রয়ে আবার ফিরবে কী জোশীমঠ?             

 

 

               

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?