জলবায়ু পরিবর্তন ও উপেক্ষিত মানবতা



দীপেন্দু চৌধুরী

একুশ শতকের উন্নয়নের গরিমায় গর্বিত সারা বিশ্বে রোজ রাতে প্রায় ৮২ কোটির বেশি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান! কথাটা আমাদের বিশ্বাস করতে হচ্ছে? রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-র পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছে গা হিম করা এই তথ্য।আরও তথ্য উঠে এসেছে উল্লেখিতপরি সংখ্যান থেকে। ৪৯টি দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সারা বিশ্বের এই অনাহারের কারণ সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ক্ষুধার কারণ গুলি হচ্ছে, প্রথমটি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অশান্তি। দ্বিতীয়টি বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিষয়টা আর কোনও গোপন বিষয় নয়। জলবায়ু পরিবর্তন সমাজ ব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে প্রভাবিত করে ফেলছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি অকস্মাৎ আমাদের সামনে দেখা দিচ্ছে।এবং এই সব ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি মানবজীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই ঘটনার অন্যতম কারণ উন্নয়নের নামে সবুজ ধ্বংস করা। যে বিষয়টা ৬ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর মিশরের শর্ম এল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত সিওপি২৭ জলবায়ু সম্মেলনে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একই সুরে সম্প্রতি আমাদের দেশের জাতীয় পরিবেশ আদালত দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছে।বড় বড় পুকুর, জলাশয় ভরাট করে আকাশ ছোঁয়া বহুতল আবাসন, প্রশস্ত রাস্তা গড়ে উঠছে নগরায়নের নামে। দেশের বিভিন্ন শহরে একের পর এক উড়ালপুল গড়ে উঠছে সবুজ ধ্বংস করে। পোশাকি নাম ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলার উদ্যোগে আধুনিক সভ্যতা বা প্রগতির ছাপ থাকলেও ক্রমশঃ সবুজ সাফ হয়ে যাচ্ছে।

এই তথ্য বা পরিসংখ্যা উঠে এসেছে ভারতের দুই পরিবেশ গবেষক অশ্বিনী সাঙখালা এবং ভাস্বতী রায়চৌধুরীর একটি রিপোর্ট থেকে।পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যশন্যাল ‘ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’(আইইইউসিএন)-র কাছে সম্প্রতি ‘আর্বান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হিডিন ডিমলিশন’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট তাঁরা যৌথ ভাবে পেশ করেছে। এই রিপোর্টের মোদ্দা কথা রাজ্যে রাজ্যে ‘স্মার্ট সিটি’ বা উন্নয়নের নামে কর্মযঞ্জ চলছে। দেশের বিভিন্ন শহরে যে সব গাছ লাগানো হয়েছে তা নিছকই নয়নবাহারি গাছ। এই জাতীয় গাছকে বনায়নের পরিভাষায় বড় গাছ বা ‘টল ট্রি’ বলা যাচ্ছে না। নগর সভ্যতার সৌন্দর্যায়নের  প্রায় ৮০ শতাংশ গাছই ‘টল ট্রি’ বা শাল, সেগুন, বট-অশ্বত্থ গাছের প্রজাতির নয়। পরিবেশ বিঞ্জানীরা বলছেন, নয়নবাহারি এই জাতীয় গাছের দূষণ প্রতিরোধী ক্ষমতা থাকে না। বাতাসে ধূলিকণা বা ডাস্ট পার্টিকল ধরে রাখার ক্ষমতা এই সব প্রজাতির গাছের প্রায় একদমই নেই।

সবুজ ধ্বংস পরিকল্পিত হোক বা অপরিকল্পিত একই তথ্য উঠে আসে আমাজনের অরণ্য ধ্বংসের ঘটনাতেও। যা নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যপক আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। মিশরের শার্ম এল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত ‘সিওপি২৭’-জলবায়ু স্মমেলনের আগে থেকেই আমাজন অরণ্য ধ্বংস নিয়ে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা সোচ্চার হয়েছেন। পরিবেশ বিশেষঞ্জরা দাবি করছেন, বৃষ্টিচ্ছায় গভীর অরণ্য আমাজন ধ্বংসের কারণে সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের টালমাটাল অবস্থা। ব্রাজিলের ট্রাডিশনাল এই অরণ্য ধবংসের জন্য বিশ্বের উষ্ণায়ন আরও বেড়েছে।ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর আমলে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে আমাজন অরণ্য।পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ প্রধানত কৃষিজমি, মাংস উৎপাদন এবং খননের নামে এই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে  ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর।গত আর্থিক বছরে সরকারি সিদ্ধান্তে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমি। তার ফলে তৈরি হয়েছে প্রলয়কালের পরিস্থিতি।

পরিবেশ বিঞ্জানীরা আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত আমাজন অরণ্য, ধ্বংস কবলিত সেই অরণ্য বর্তমানে যতটা কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি করে তার থেকে শুষে নেয় আরও কম। বনচ্ছায় অরণ্য ধ্বংসের কারণে অক্সিজেন যোগান ব্যহত হচ্ছে। যে অক্সিজেন ব্যতীত আমরা বেঁচে থাকতে পারব না। এই অক্সিজেন বাতাসকে যোগান দেয় নানান ‘মনুষ্যেতর’ প্রাণী ও এই পৃথিবী নামক এই গ্রহটির নানান প্রক্রিয়া। প্রাকৃতিক ভারসাম্য কী ভাবে ব্যহত হচ্ছে সেটা আমরা এই অভিঞ্জতা থেকে বুঝে নিতে পারি। প্রকৃতি ধ্বংসের বিষয়টা এবারের জলবায়ু সম্মেলনে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কী এই কারণেই?

এবারের জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় বলা হয়েছে, গ্যাস নিঃসরণ ক্রমশঃ বাড়বে। ‘নেট জিরো’ তে নামিয়ে আনা অনেক অনেক দূরের কথা। ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউস গ্যস নিঃসরণ ১৬ শতাংশ বাড়বে। সিওপি২৭ সম্মেলনের আলোচনায় এমনটা উঠে এসেছে। এই তুলনা ২০১০ সালের হিসেব মত করা হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারন জ্বালানি সমস্যা। সেই সঙ্গে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ গ্যাসের বদলে কয়লা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এশিয়ার অন্যতম দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চিন ও ভারতকে জ্বলন্ত এই সমস্যার সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে। সিওপি২৭ সম্মেলনের তথ্য দাবি করছে চিনের ৬৩ শতাংশ আর ভারতের ৭২ শতাংশ জ্বালানী আসে ‘ফসিল ফুয়েল’ তথা কয়লা থেকে। কয়লা থেকে উৎপন্ন ফসিল ফুয়েল নির্ভর আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আস্তে চায় উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ খাতে ফান্ডের যে দাবি করেছিল সেই দাবি এই সম্মেলন মেনে নিয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলিও এই বিষয়ে তাঁদের অবস্থানও জানিয়ে দিয়েছে। যেমন আমেরিকা নিজেদের অভিঞ্জতায় এই ফান্ডের প্রয়োজন মেনে নিয়েছে। কয়েক মাস আগে আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই অঞ্চলে একই সঙ্গে ঘটেছিল দাবানল, খরা এবং তাপপ্রবাহ। ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বা সারা বিশ্বে ন’মাস ধরে গরমের কবলে পড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে সবুজ ধ্বংস এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

সিওপি২৭ সম্মেলনে কয়কেটি রাষ্ট্র গ্লোবাল ওয়ার্মিং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার আগ্রহ দেখায়নি। এই কথা সম্মেলন চলাকালীন সাংবাদিকদের উত্তরে ‘ইউএস স্পেশাল ক্লাইমেট’ দূত তথা প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক জন কেরি বলেন। তাঁর কথায়,  ‘’আপনারা সঠিক ভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, কিছু রাষ্ট্র এই বিষয়টি আলোচনা করলেও গ্রীন হাউস গ্যস নিঃসরণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বিষয়ে কোনও বাক্য ব্যবহার করেনি।‘’ অভিঞ্জ মার্কিন কূটনীতিক আরও বলেন, ‘’কিন্তু ঘটনা হচ্ছে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন সিওপি২৬-এ এতদ বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল।‘’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে বিশ্ব নেতৃত্ব ২০১৫ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে রাখতে হবে। যা 'প্যারিস চুক্তি' নামে পরিচিত। গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রসঙ্গে আমরা আগেই আমাজন ধ্বংসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি। উন্নত রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবারের সিওপি২৭ সম্মেলনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেলের আহ্বান মেনেই ‘সবুজ অর্থনীতি’র প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। 

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন বাইডেন ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেছেন। এই আইনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫০ মিলিয়ন সোলার প্যানেল বসানো হবে। এছাড়াও ১২০,০০০ উইন্ড টার্বাইন্স এবং ২৩,০০০ ব্যাটারি পরিচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বসানো হবে। ‘ফসিল ফুয়েল’-র বিকল্প হিসেবে উল্লেখিত প্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও গার্হস্থ কাজে ব্যাবহার করার জন্য বসানো হবে।     

সিওপি২৭ সম্মেলনে সেক্রেটারি জেনারেল আন্তেনিও গুতারেস বলছিলেন, ‘’জায়ান্ট লিপ অন ক্লাইমেট অ্যম্বিশন’’। তাঁর বক্তব্য ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’(কার্বন নিউট্রালিটি)রাষ্ট্রের হ্রদয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে ‘কার্বন নিরপেক্ষ’ শব্দগুচ্ছকে জুড়ে দিতে হবে। এবং অবশ্যই পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের যৌথ বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। তবেই একটি দেশের ‘সাসটেনেবল উন্নয়ন’ সম্ভব। মিশরের শার্ম এল-শেখ শহরে ২৭তম আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে ‘ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’  (ইএসসিএপি)একই মত পোষণ করে জানিয়েছে, আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্তরের অংশীদারদের(স্টেক হোল্ডার)যৌথ ভাবে কাজ করার জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে।‘ফসিল ফুয়েল’ নির্ভর রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আস্তে প্রথম চিন্তা করতে হবে পুনঃরনবিকরণ জ্বালানী তথা ‘সবুজ অরথনীতি’-র কথা। অর্থাৎ জ্বালানী নিরাপত্তাহীনতা কমাতে হবে। রিনিউবল বা পুনঃরনবীকরণ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ‘পরিবহণ পরিকাঠামো’(গ্রীড ইনফ্রাকস্ট্রাকচার)-র উন্নতি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশেষত বিভিন্ন দেশের আন্তঃরাষ্ট্র সীমান্ত গ্রীড গড়ে তোলার বিষয়ে জোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিওপি২৭ সম্মেলনের নেতৃত্ব।‘দ্য রিজিওনাল রোড ম্যাপ অন পাওয়ার সিস্টেম কানেক্টিভিটি’ যে প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারে তা হল এই গোষ্ঠীর দু’টি সদস্য দেশ পরস্পরের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কিত গ্রীন গ্রীড ব্যবহার করতে পারবে। ‘সবুজ অর্থনীতি’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা সহায়ক হয়ে উঠবে।

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ে চিন এবং ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন দুটি দেশের মোট জনসংখ্যা ২.৭ বিলিয়ন যা বিশ্বের জিডিপির ২০ শতাংশ। এবং ভারত-চিন যৌথ ভাবে বিশ্বের তৃতীয় গ্যস নিঃসরণের দেশ। চিনে ২৪.২৩ শতাংশ এবং ভারতে ৬.৭ শতাংশ গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। জলবায়ু সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এশিয়ার এই দু’ই বৃহৎ অর্থনীতির রাষ্ট্রের কৌশলী ভূমিকার কথা অবশ্যই আমাদের বলতে হবে।        

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?