প্রান্তিকতায় স্পর্শকাতর উচ্চারণ



 দীপেন্দু চৌধুরী

এই সেই অবসন্ন সকালবেলা। কম্পিউটার বেলা কি বলা যায়? বা ‘এরা অব সোশ্যাল মিডিয়া’-র ঘুমক্লান্ত একটা মেদুর   সকাল।স্বার্থ চেনা সামাজিকতায় ইংরেজি নতুন বছরের ‘আত্মচিত্র’ আঁকা নাগরিক শুভেচ্ছা।চেনা কন্ঠশ্বর মুঠো ফোনেও আর শোনা যায় না। আজ সবাই লেখক, সকলে কবি, সকলে সেলিব্রেটি।একুশ শতকী প্রযুক্তির আমন্ত্রণ! কে আপত্তি করবে? করলেই বা কার কি এসে যায়? স্মার্ট ফোনের পাতায়, ওয়ালে রোমান হরফে শব্দাক্রন্ত হতে সবাই অভ্যস্ত। তাতেও আমাদের আপত্তি নেই। প্রযুক্তি এই সমাজকে টানছে ভোগ, বিলাস, স্বাচ্ছন্দে। ‘খাও পিও জিও’-র সভ্যতা জানান দিচ্ছে কর্পোরেট সংস্কৃতি সর্বস্ব সামাজিকতায় খাগের কলম লাগে না। অক্ষর, বাক্য, ব্যকরণ, সাহিত্য জানার বা নিবিড় অনুশীলনের প্রয়োজন নেই।ভুল বানান আর স্বঘোষিত লেখক-সাংবাদিকদের একুশ শতকীয় ভাষা-আচার্যের ভাষা? না থাক আমরা বিশ্বজনীনতায় ‘উঠোন সভা’ চিনি।চর্বিত দেহ নিয়ে উবু হয়ে যদিও আর বসতে পারি না। বা বসতে চাই না।গার্হস্থ জীবন আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত হলেও বাহ্যিক জীবনে নাগরিক সংস্কৃতির চর্চিত পরিবেশন।আজ ১৬ পৌষ, ১৪২৯।১ জানুয়ারি ২০২৩।

কতবার উচ্চারিত হয়েছে। নাগরিক ফুটপাথ, নাগরিক সাংবাদিকতা। নাগরিক সাহিত্য। নাগরিক ফুটপাথে শক্তি চট্টোপাধ্যায় মাঝে মাঝে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন বা লিখতেন।তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আমার কাছে এখনো পড়ে আছে/ তোমার প্রিয় হারিয়ে-যাওয়া চাবি/ কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো?’’ আচ্ছা তোরঙ্গ আজ কি কেউ আর খোলে? তোরঙ্গে কত কি থাকত।পূর্ববঙ্গের বাড়িতে আমার মায়ের তোরঙ্গে একটা আমের আঁটি রাখা ছিল।ভাঙা মন নিয়ে দ্বি-জাতি তত্বের কৌশলী কূটনীতি টপকে আমার মা কূল ভাঙা এই বঙ্গে এসেছিলেন এক মধ্য রাতে। আমার মায়ের প্রথম মেয়ে আম খেতে গিয়ে ওই আঁটি গলায় আটকে মারা যায়। মায়ের প্রথম মেয়ে বেঁচে থাকলে প্রায় নব্বই বছর বয়স হত।মায়ের তের বছর বয়সের প্রথম মেয়ে। আমার মা ‘আম আঁটি’ নিজের তোরঙ্গে লুকিয়ে রাখতেন। আমিই মোটা পুরু কাঠের তোরঙ্গ থেকে আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কী সাহিত্যের উপসর্গ খুঁজছ? আমার কাছে পাশের বাড়ির ঘুঘুটা জানতে চাইছে। এই সাত সকালে উদাস সুরে সে মনমাতানো উদাসীনতায় ডেকে চলেছে ‘ঘুঘু সই পুতু কই’?আমার মায়ের প্রথম মেয়ের নাম ছিল ‘পুতুল’।‘চাবি’ কবিতায় শক্তি আরও শব্দে ছব্দে বলছেন, ‘থুৎনি-পরে তিল তো তোমার আছে/ এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি? চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো।’

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চিঠি আর কেউ লেখে? ওই বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তায় হয়ত লিখতে হয়।নাগিরক সামাজিকতায় হুড়মুড়িয়ে যখন এসে পড়েছিলাম, তখন আমাকে জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে কেউ চিনত না। নতুন দেশ অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতার নতুন দেশের নতুন মানুষ চিনতে কলকাতায় এসেছিলাম। কলকাতায় তখন ফুটপাথ ছিল। ঔপনিবেশিক ফুটপাথ। পানিপার ছিল। পুরু চামড়ার ব্যাগে পানি থুরি আমি হিন্দু ‘জল’ বলি, জল নিয়ে ভিস্তিওয়ালা রাস্তা ফুটপাথ ধুয়ে দিয়ে যেত।রাত ভোরে সাদা সফেদ হুতোম নাগরিক কাক-চিলদের থেকে বাঁচতে ‘বাবু বাড়ি’-র ঝুল বারান্দায় আড়াল খুঁজত।আমরা ভোরের আলোয় কুয়াশায় ঢাকা মেঘের নীচের ‘নাগরিক ফুটপাথ’-এ গঙ্গার জলে স্নিগ্ধ হতাম। সেই কলকাতা আজ আর নেই। প্রাচুর্যের আলো এসে কলকাতার জিশুরা টালমাটাল পায়ে পথ চলার অবকাশ পায় না। কলকাতার জিশুর অভিভাবকদের প্রান্তিকতায় বসে আমি আজও উচারণ করি, ‘রাজা তোমার কাপড় কোথায়’? আজ থেকে ১২ বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল ‘পেট ভর্তি ভাত জোটেনা, তল পেটের খিদে পায় কী করে’? তারপর আবারও এক পা মেলে না দু পা মেলে না।বসে বসে বাষট্টি, পায়ে পায়ে পয়ষট্টি, বসে বসে বাষট্টি। উচ্ছেদের আইনি নোটিশ আসে।আমি বই পড়ি।পাঠাগারে যাই। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘কেউ দেয় নি কো উলু/ কেউ বাজায় নি শাঁখ,/ কিছু মুখ কিছু ফুল/ দিয়েছিল পিছু ডাক।’(কবিতা- ছাপ)।আমি সর্বত্রগামী কবিতার খোঁজ করি।বইয়ের খোঁজ করি। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে উপন্যাসে বিমলা বলছে, ‘’পৃথিবীতে যারা কাপুরুষ তারাই স্ত্রীর পূজা দাবি করে থাকে।‘’ আমি আজও বইয়ের খোঁজ করি। ভাবুনতো কত শত ভাল ভাল বই লেখা হচ্ছে।সত্যিইতো বইয়ের জগৎটাঁকে কী নিরীহ বলা যায়? বই লেখা হবে, লিখবে নাগরিক সমাজ। তারপর টাকা দিয়ে নিজের বই নিজে ছাপবে।উলঙ্গ রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘তোলা দুধের পোলা’-দের নামে জয়ধ্বনি উঠবে।আর সৃষ্টিশীল লেখকের লেখা বই কে ছাপবে? সে বলেছিল একদিন, ......’কিন্তু হাসা টাকা কোথায়?’ এটা এক চাচা কাহিনীর চাচার কথা। গল্পটা জনান্তিকে বলব আর এক দিন। আমাকে বলেছে আমার তরুণ বন্ধু দেবজ্যোতি। ও আমাদের বিবেক হতে চায়। হ্যাঁ চেনেন, আপনারাও চেনেন। আমি আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছি না। মাস চারেক আগে একদিন মুঠো ফোনে বলল, ‘আচ্ছা তুমি কী আমার কাছে কোনদিন জানতে চেয়েছ? কত টাকা রোজগার করিস? কাজ থেকে বাড়ি ফিরলেই বলেছ, আজ কী বই কিনলি?’ আসলে নাগরিক সভ্যতা পৃষ্ঠা খোঁজে, প্রতিষ্ঠার পৃষ্ঠা, প্রতিষ্ঠার অধ্যায়। মধ্যবিত্তের আনুষ্ঠানিকতা। তবুও কেন জানি প্রান্তিকতায় থেকে আমাকেও উচ্চারন করতে হচ্ছে সামাজিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব দেবে মধ্যবিত সমাজ। মেট্রোপলিটন মন। যে কথা রাজা রামমোহন রায় বলে গেছেন। ‘চাল বাড়ন্ত ঘরে’-আজও খুঁজছি সেই মেট্রোপলিটন মধ্যবিত্ত নেতৃত্বকে।                             

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?