জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবাশ্মমুক্ত ভারত!




দীপেন্দু চৌধুরী 

যারা দিল্লিতে থাকেন তাঁরা দীপাবলির সময়টা বেশ দুশ্চিন্তায় থাকেন।কারণ এই সময়টা সারা দেশের সঙ্গে দূষণের মাত্রা দিল্লিতে বেশি বাড়ে।এই বছর দীপাবলির সময় রাজধানীর কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের বসানো ৩৩টি মনিটরের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালের তুলনায় দূষণের মাত্রা দেশের রাজধানীতে কম ছিল। দীপাবলির সময় দিল্লির বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার(পিএম ২.৫)মাত্রা কম হলেও সহনশীল ছিল বলা যাবে না।ওই দিন দিল্লির বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণার মাত্রা(প্রতি ঘনমিটারে ৬০ মাইক্রোগ্রাম)নিরাপদ মাত্রার থেকে বেশি ছিল।বহু আলোচিত বিষয়টা হচ্ছে, প্রাক শীতের মরসুমে দীপাবলির বাজি এবং দেশের রাজধানীর নিকটবর্তী রাজ্যগুলিতে ফসলের গোড়া পোড়ানোর ধোঁয়ায় তাপমাত্রা বাড়ে। উত্তর ভারতের ঠাণ্ডা হাওয়াও এই দূষণ কমাতে পারে না।পরিবেশ বিশেষঞ্জদের অভিমত দিল্লির পুসা অঞ্চলের বাতাসে পিএম ২.৫-র পরিমাণ অত্যন্ত বিপজ্জনক।এতদঞ্চলে দূষণের পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৪৪৮.৮ মাইক্রোগ্রাম মাত্রায় ছিল।বায়ুদূষণের সূচক(একিউআই)২৫১ থেকে ৩৫০-র মধ্যে অবস্থান করলে বাতাসের মান পরিবেশবান্ধব বলা হয় না।অক্টোব্রের হৈমন্তীবেলায় দিল্লিতে বায়ুদূষণের সূচক চলতি বছরেও ঊর্ধ্বগামী ছিল।

দিল্লির উৎসবকালীন দূষণের প্রসঙ্গকে আলোচনায় রেখে আমাদের উল্লেখ করতে হবে সামগ্রীক ভারতের তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণ। পরিবেশবিদরা বলছেন নগরায়ণ আধুনিক সভ্যতার কারণেই প্রয়োজন। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ সবুজ ধ্বংস করে হচ্ছে।তৈরি হচ্ছে বহুতল বাড়ি, অপরিকল্পিত শিল্প এবং শিল্পনগরী।এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দু’ধরণের তাপপ্রবাহ কবলিত শহর ‘আরবান হিট আইসল্যান্ড’(UHIs)। ১)‘সারফেস ইউএইচআই’(Surface UHI), ২)‘অ্যাটমসফেরিক ইউএইচআই’(Atmospheric UHI)।এই ধরণের প্রযুক্তি নির্ভর নগরায়ণ শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপালসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শহরে তাপপ্রবাহ বাড়তে সহায়ক হয়ে উঠছে। পাশাপাশি রয়েছে ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম বিদ্যুৎ।‘ক্লাইমেট ট্রেন্ডস’ নামে একটি ভারতীয় সংস্থার গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়া ১০টি দেশের সর্বচ্চো তালিকায় রয়েছে ভারত এবং বাংলাদেশ। চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়ার ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। যেমন পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যা, বাংলাদেশ সহ উত্তরপূর্ব ভারতের অসময়ের তথা অযাচিত বন্যা। এবং বছরের শুরুতেই পাকিস্তান এবং আমাদের দেশে অসহনীয় তাপপ্রবাহ।বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ ভারত, যেখানে একজন মানুষের গড়েপড়তা আয় মাত্র ২ ডলার। জলবায়ু পরিবর্তন এই শ্রেণির বহু মানুষকে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আরও চ্যলেঞ্জের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।‘ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’(IPCC)-র ষষ্ঠ আনুমানিক রিপোর্ট(AR6)বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বের মানুষকে আকস্মিকভাবে প্ররোচিত এবং প্রভাবিত করতে পারে।

উল্লেখিত আলোচ্য ঘটনাগুলি এই প্রথম ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’-র কারণে ক্ষয়ক্ষতি(Loss &Damage)-র প্রসঙ্গ মনে করাচ্ছে,   সারা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের।এবিষয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কও শুরু হয়ে গেছে। উন্নত এবং উন্নয়ণশীল রাষ্ট্রের মধ্যে দায়দায়িত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। গত বছর গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত জলনায়ু সম্মেলন(COP26)-এ দাবি উঠেছিল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফেসিলিটি’-র। এই খাতে বরাদ্দ অর্থ কারিগরী এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ প্রভাবিত দেশগুলিকে।বিগত বছরের জলবায়ু সম্মেলনে(COP26)’লস এবং ড্যমেজ ফেসিলিটি’ বিষয়ক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। চলতি বছরে ৬ নভেম্বর থেকে সিওপি২৭(COP27)জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে মিশরের শর্ম এল-শেখ শহরে। এই অধিবেশন চলবে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। ভারতের তরফে যোগ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব।‘লস অ্যান্ড  ড্যামেজ ফেসিলিটি’-র প্রস্তাব চলতি সম্মেলনে পেশ করা হবে। ২৯ অক্টোবর কলকাতা প্রেস ক্লাবে ছিল ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন’ বিষয়ক একটি মতবিনিময় সভা।সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ডঃ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভারত-বাংলাদেশ দু’টি দেশেই পড়েছে। বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলে। কিছুদিন আগে চিত্রাং ঘূর্ণিঝড়ের কথা আপনাদের মনে থাকবে। তাই আমরা জলবায়ু সম্মেলন(COP27)-‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফেসিলিটির’-র প্রস্তাব আবারও তুলব।‘ ওই একই দিনে কলকাতায় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফেডারেশন অফ ইউনাইটেড নেশনস অ্যান্ড গৌড়ীয় মিশনের ‘’সেন্টার ফর ইউএন পিস স্টাডিস অ্যান্ড ফাউন্ডেড ইটস লাইব্রেরী উদ্বোধন হয়। ২৯ অক্টোব্র ‘গোড়ীয় মিশন’-র এই অনুষ্ঠানে ‘’চ্যালেঞ্জ অফ ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড রোল অফ দ্য ইউনাইটেড নেশন ইন কলকাতা’’ বিষয়ক আলোচনাসভায় এসে মার্কিন কনসাল জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক বলেন, ‘’এই বছর ভারত আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫ বছরে পড়েছে।বিশ্বের দু’টি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ যৌথভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ফসিল ফুয়েল’ মুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাইছে।এই খাতে প্রেসিডেন্ট ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করার কথা ঘোষণা করেছেন।‘’ ফসিল মুক্ত ভারত গড়ে তুলতে আমাদের দেশের শক্তি ও পুনরনবীকরণ মন্ত্রকের  অবস্থান হল, ভারত যেহেতু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল, তাই দেশের নীতি হবে ধীরে ধীরে ‘জাস্ট টাঞ্জিশন’-র পথে এগনো। সম্প্রতি দেশের ‘ইন্টার-মিনিস্টার কমিটি অন জাস্ট ট্রাঞ্জিশন ফর্ম কোল’ ক্ষয়ক্ষতিহীন ‘গ্রীন এনার্জি ইন্ডিয়া ফান্ড’-র জন্য প্রস্তাব করেছে।প্রস্তবিত এই ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়লা খনি অঞ্চলে ‘থ্রী টায়ার’ পরিকাঠামো গড়ে তুলবে। অর্থাৎ জীবাশ্ম মুক্ত অঞ্চলে সোলার বিদ্যুতের প্রস্তুতি শুরু করতে চাইছে ভারত সরকার। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ওই অঞ্চলের উচ্ছেদ হওয়া শ্রমিক-কর্মচারীদের পুনর্বাসনের কী হবে?                                                                         

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?