জীবাশ্ম শক্তি ও সময়োপযোগী পরিবৃত্তকাল
দীপেন্দু চৌধুরী
রাতকে বিতাইলাম হো, দিনকে বিতাইলাম হো
তবুও আমার মনের মানুষ আইল না।
এই চাসনালা খনিতে মরদ আমার ডুবহা গেল গো!
মরদ আমার হারান গেল গো!
গণসঙ্গীতঃ
অজিত পান্ডে
সময়টা বিগত শতাব্দীর সত্তর-আশির দশক। আমরা সেই
সময়কালে বীরভূম জেলার একটি গঞ্জশহরে থাকতাম।সেখানেই শৈশব, কৈশোর, স্কুলবেলা, কলেজবেলা
ইত্যাদি কাটিয়েছি।সেই সময় অন্ডাল আজিমগঞ্জ রুটে একটি লোকাল ট্রেন চলত।নাম ছিল অন্ডাল
প্যাসেঞ্জার।ট্রেনের প্রায় প্রতিটি কামরায় চটের বস্তায়(তখনও প্ল্যাস্টিকের বস্তা আসেনি।)কয়লা
মজুত করে মহিলা পুরুষদের নিয়ে আসতে দেখেছি।অন্যান্য ট্রেনেও দেখা যেত।যারা কয়লা নিয়ে
আস্ত তাঁদের জামা, কাপড় এবং দেহে কয়লার আস্তরণ পড়ে থাকত। অনিয়মিত স্নান করার জন্য চামড়ায়
একটা কালো আস্তরণও দেখা গেছে। এই অভিঞ্জতার মানদন্ডে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম যারা বস্তা
বস্তা কয়লা নিয়ে আসেন, তাঁরা অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আসানসোল-রাণীগঞ্জ কয়লা অধ্যুষিত
অঞ্চল থেকে কয়লা নিয়ে আসে।এরা বৈধ নয়, অবৈধ ভাবে কয়লা সংগ্রহ করে বীরভূম-মুর্শিদাবাদের
বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করত। এক কথায় বলা যায়, কয়লা নির্ভর একটা সমান্তরাল অর্থনীতি
তখন চলত। বর্ধমান জেলার চাসনালা খনি দুর্ঘটনা ১৯৭৫ সালের। সেই দুর্ঘটনাকে নিয়ে ‘এই
চাসনালা খনিতে মরদ আমার ডুবহা গেল গো’ গানটি গেয়েছিলেন বিখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত
পান্ডে। সুর দিয়েছিলেন ভি বালসারা। গানটি আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
সূত্রের খবর, চাসনালা খনি দুর্ঘটনার আগে ও পরে
২০০০ সালে রাজ্যের পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বারাবনী এবং জামুরিয়া কমিউনিটি উন্নয়ন ব্লকের
প্রায় ৭০০ পরিবার তাঁদের বাসস্থান এবং চাষের জমি হারিয়েছেন।কয়লা খনি গড়ে ওঠার কারণে
তাঁরা উদ্বাস্তু ও কর্মহীন হয়েছিলেন আগেই। সম্প্রতি আইআইটি কানপুর আসামের মারঘেরিটা
কয়লা খনি বন্ধের উপর ‘লাইফ আফটার কোল মাইন ক্লোসার’ শিরোনামে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট
প্রকাশ করেছে। তাঁদের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, একমাত্র কয়লা শিল্প নির্ভর অর্থনৈতিক
অঞ্চলের ক্ষেত্রে কয়লা খনি বন্ধ ব্যপক প্রভাব ফেলতে পারে। সেই অঞ্চলের আর্থসামাজিক
ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। সেই অঞ্চলের কয়লা শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীরা জীবীকার প্রয়োজনে
স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়। কাজ হারিয়ে তাঁরা এক প্রকার উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। আইআইটি
কানপুরের ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ বিভাগ লিখছে, ‘গিভেন দ্য সিঙ্গুলার ইকনমিক ডিপেনডেন্স অন
কোল ইন কোল-রিচ রিজিয়নন্স, কোল মাইন ক্লোসারস ক্যান রেসাল্ট ইন সাবস্টেনসিয়াল জব লস
নট অনলি ইন কোল মাইনস বাট অলসো ইন রিলেটেড বিজনেস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।’
বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলনের কাজ আমাদের রাজ্যে
শুরু হয় ১৭৭৪ সালে। আসানসোল-রাণীগঞ্জ অঞ্চলে। আমাদের রাজ্যে কোল ইন্ডিয়ার সাবসিডাইজড
সংস্থা বা সহযোগী সংস্থা ইস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড ১০৭ টি কয়লা খনি পরিচালনা করে।সাম্প্রতিক
সময়ে কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও কয়লা নির্ভর অর্থনীতি আমাদের রাজ্য সহ
সারা ভারতে অনেকটাই দুর্বল।আইফরেস্ট(iFOREST)নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম সম্প্রতি
একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই সংস্থা পরিবেশের উপর কাজ করে। তাঁদের দাবি, ভারতে ৫০,০০০
মেগাওয়াট কয়লা নির্ভর শিল্প বা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে।তাঁদের
রিপোর্টকে এক কথায় ‘এনার্জি পভার্টি’ বলা হচ্ছে।এই রিপোর্টে তাঁরা আরও দাবি করেছে,
কেন্দ্র এবং রাজ্যের আইন এবং পরিচালন ব্যবস্থা পরিবেশ, শ্রমিক, জমি ও কয়লা নির্ভর অর্থনীতির
বিষয়ে পুরোপুরি নীরব।
ট্র্যাডিশনাল কয়লা নির্ভর আর্থসামাজিক ব্যবস্থায়
ভারতে আনুমানিক ১৩ মিলিয়ন মানুষ এখনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। এর মধ্যে
প্রায় ৪ লাখ কর্মচারী কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ভারতে বর্তমানে আনুমানিক ৫৮ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে ফসিল ফুয়েল
বা জীবাশ্ম শক্তি থেকে। তারমধ্যে ৫৬ শতাংশ শক্তির উৎস কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।ভারত
ও চিন এখনও কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের উপরই বেশি করে নির্ভরশীল। গত বছর গ্লাসগো জলবায়ু
সম্মেলনে ভারত এবং চিন যৌথভাবে জানিয়ে দেয়, তাঁরা এখনই কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা
থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। দুটি দেশই ‘ফেজ আউট নয় ‘ফেজ ডাউন’-র নীতি নিয়ে চলেছে।দু’টি
দেশের বক্তব্য ‘জাস্ট ট্রাঞ্জিশন’ উন্নত রাষ্ট্রের পরিকল্পনা। গত বছরের ২ ডিসেম্বর
রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে শক্তি ও পুনরনবীকরণ মন্ত্রক জানায়, ভারত যেহেতু কয়লা
নির্ভর বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল তাই আমরা ধাপে ধাপে জাস্ট ট্রাঞ্জিশনে যেতে চাইছি।
সম্প্রতি জি-৭ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির তরফে আবারও ভারতকে ‘জাস্ট এনার্জি ট্রাঞ্জিশন পার্টনারশিপ(JTEP)
গোষ্ঠীতে যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানান হয়েছে,
এই বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।আলোচনা চলছে।
আইআইটি কানপুরের জাস্ট ট্র্যান্সজিশন গবেষণা বিভাগ
বলছে, কয়লার অপ্রতুলতার জন্য আমদের পুনরুজ্জীবিত শক্তিতে ফিরতে গেলে প্রয়োজন হবে বৃহত্তর সামাজিক পরিকাঠামোর
পরিবর্তনের।ফসিল ফুয়েল কমে আসার জন্য সারা বিশ্ব ইতিমধ্যেই নতুন জ্বালানি শক্তির পরিকল্পনার
কথা ভাবতে শুরু করেছে। কানপুর আইআইটি এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে ওই রিপোর্টে আরও জানাচ্ছে,
আমাদের রাজ্যে কয়লা খনি পরিত্যক্ত হওয়া অথবা বন্ধ হওয়ার জন্য কয়লা নির্ভর অর্থনৈতিক
অঞ্চলগুলির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজন ‘সাস্টেনেবল উন্নয়ন’ এবং ‘ইনক্লুসিভ
গ্রোথ’।এই পরিকল্পনা করার সময় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে ‘গ্রীন ট্র্যান্সজিশন’-র কথা।
সরকারি অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া ভেঙে পড়া কয়লা নির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন
সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের এক সময়ের
কয়লা অধ্যুষিত অঞ্চল যেমন ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের জনজাতি বা আদিবাসীদের
আর্থসামাজিক ব্যবস্থার কথা নতুন করে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে উল্লেখিত
অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার কথা। তাই প্রয়োজন সোলার শক্তির। কয়লা খনি বন্ধ
হওয়ার কারণে এতদ অঞ্চলের বহু মানুষ ইতিমধ্যেই স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাঁরা
উদ্বাস্তু হয়ে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করছে। তাঁদের আর্থসামাজিক মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
এই রিপোর্টে
তাঁরা আরও দাবি করেছে, কেন্দ্র এবং রাজ্যের আইন এবং পরিচালন ব্যবস্থা পরিবেশ, শ্রমিক,
জমি ও কয়লা নির্ভর অর্থনীতির বিষয়ে পুরোপুরি নীরব। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার ডিকমিশনিংয়ের
পরিকল্পনার কথাও কিছু জানাচ্ছে না বলে তাঁদের দাবি।
পরিবেশ নিয়ে গবেষণা মূলক কাজ করে ‘ওয়ার্ল্ড রিসোর্স
ইনিশিয়েটিভ’ নামে অপর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ভারতীয় শাখার ক্লাইমেট ডাইরেক্টর উল্কা
কেলকার বলছেন, ‘কয়লা খনি বন্ধের কারণে ৪ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারিয়েছেন ভারতে।কয়লা শিল্প
সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মচ্যুত বিশেষত মহিলা শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যা সব থেকে বেশি।
তাঁদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তাও অত্যন্ত দুর্বল।কর্মচ্যুত এবং প্রাক্তন কর্মীদের পেনশন
দেওয়ার কথা সরকারকে ভাবতে হবে।‘’ কোল ইন্ডিয়া সূত্রে খবর, ভারতে আনুমানিক ২৯০টি কয়লা
খনি পরিত্যাক্তি বা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোল ইন্ডিয়া বন্ধ থাকা বা পরিত্যাক্ত ২০টি কয়লা
খনি বিভিন্ন বে সরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিতে আগ্রহী।বন্ধ থাকা এই ২০টি কয়লা খনি বা
খাদান থেকে প্রায় ৩০-৪০ মিলিয়ন টন ব্যবহারযোগ্য কয়লা তোলা সম্ভব। কোল ইন্ডিয়ার হাতে
৪১৩টি কয়লা খনি আছে। ২০৭ টি ভূ গর্ভস্থ।১৭৬টি খোলামুখ খনি এবং ৩০টি মিশ্র।কোল ইন্ডিয়া
অলাভজনক ৩৭টি কয়লাখনি বন্ধ করে দিতে চায় বর্তমান আর্থিক বছরের শেষে।কোল ইন্ডিয়ার বৃহত্তর
ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা ‘ভারতীয় মজদুর সংঘ’(বিএমএস)-র সহসভাপতি বসন্ত কুমার রাই সংবাদ
সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘’আমরা অলাভজনক কয়লা খনি বন্ধ করার প্রস্তাব
কোল ইন্ডিয়াকে দিয়েছি। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, কর্মচ্যুত শ্রমিক কর্মচারীদের পুনর্বাসনের
ব্যবস্থা করতে হবে।‘’
ফসিল ফুয়েল বা জীবস্ম শক্তির বিকল্প কী? সারা বিশ্বে
বর্তমানে সোলার শক্তির কথা বলা হছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই খাতে ইতিমধ্যেই ৩৫৪ মিলিয়ন
ইউরো খরচ করার কথা ঘোষণা করেছে। ইইউ নেতৃত্ব সম্প্রতি জাস্ট ট্রানজিশন পরিকল্পনার কথা
জানিয়েছে।সোলার বিদ্যুতের পরিকল্পনা তারমধ্যে অন্যতম।আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশেও এই ক্ষেত্রে
পরিবেশ বান্ধব ‘সোলার বিদ্যুৎ’ পরিকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।জীবাস্মমুক্ত
জ্বালানি বিশ্ব গড়ে তুলতে বাস্তবসম্মত কী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত? কোনও কর্মী বা সম্প্রদায়কে
বঞ্চিত না করে এই পরিকল্পনার কথা বলছেন সারা বিশ্বের পরিবেশ বিঞ্জানী, পরিবেশ কর্মী,
আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়করা।আগামী
নভেম্বরে ইজিপ্টে প্রস্তাবিত Cop27
জলবায়ু সম্মেলনে এই সমস্যা নিয়ে আলচনা একটি প্রধান বিষয় হওয়া উচিত বলে মনে করেন তাঁদের
অনেকেই।ভারতে কোল ইন্ডিয়া, রেল সহ বিভিন্ন দফতরের হাতে যে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত জমি
আছে তাতে সোলার প্ল্যান্টের পরিকল্পনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে পাবলিক- প্রাইভেট(পিপিপি)যৌথ
উদ্যোগের কথা ভাবা যেতে পারে। এবং সেই সঙ্গে রুফ টপ সোলার শক্তির ব্যাপক প্রচার প্রসারের
কথা সবাই বলছেন।
Comments
Post a Comment