প্রাথমিক শিক্ষার মানস গঠনে নতুন প্রয়াস
দীপেন্দু চৌধুরী
এটা সত্য। আড়াল করার উপায় আমরা ভাবতেও পারি না।
কোভিড-১৯ কর্মক্ষেত্রে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কাজের ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে।যেমন
অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা এবং হাইব্রিড শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু দেশের শিক্ষা
ব্যবস্থার কতটা পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে? বিগত ২০-৩০ বছরে ভারতীয় শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন
পরিবর্তন এসেছে। যার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত শ্রেণী, সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা স্কুলে
আসবে। এই ভাবনা থেকেই ‘সর্বশিক্ষা মিশন’(২০০১)প্রকল্পের ভাবনা।কেন্দ্রীয় সরকারগুলিও
বিভিন্ন সময়ে এই প্রকল্পের সাফল্য চেয়ে শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়িয়েছে। সে কমবেশি যাই হোক।
নব্বইয়ের দশকে সরকারি বিঞ্জাপনের কথা আমাদের মনে পড়তে পারে। ‘স্কুল চলে হাম’। সারা
দেশে সরকারি রেডিওতে এই বিঞ্জাপন শোনা যেত। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের
দাবি ছিল জনপ্রিয় এই বিঞ্জাপন দেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে স্কুলে আনতে সাহায্য করেছিল।
বর্তমান সময়ে দেশের ৯৫ শতাংশ স্তরের শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এমনটাই দাবি মোদী
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিকস্তরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে
আসলেও আর্থসামাজিক ও আর্থরাজনৈতিক কারণে তাঁরা কিছু শিখছে না। এক কথায় দারিদ্রতা তাঁদের
মানসিক বিকাশের পরিপন্থী হচ্ছে। সমাজবিঞ্জানীদের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, মধ্যবিত্ত,
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ততটা বিতর্ক
না থাকলেও বিতর্ক রয়েছে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে। যাদের ‘ফার্স্ট
লার্নার’ বলা হয়।তাঁদের জন্য নতুন করে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর কথা ভাবা উচিত কেন্দ্র
ও রাজ্ সরকারগুলির।
সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে উঠে আসছে, বর্তমান ভারতের
শিক্ষাব্যবস্থা দলিত, অন্ত্যজ তথা দারিদ্রসীমার নীচে থাকা শিক্ষার্থীদের আদৌ কী কোনও
সাহাজ্যে আসছে? প্রশ্নটা উঠেছে বেশ কিছু দিন যাবৎ। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণীর ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী
টেক্সট বই পড়তে পারে না। প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় আইনের সংযোজিত অধ্যায় ‘রাইট টু এডুকেশন
অ্যাক্ট’ বা ‘শিক্ষার অধিকার আইন’(২০০৯) কতটা সফল আমাদের দেশে? শিক্ষা বিশেষঞ্জরা আরও
একটা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। পাশ-ফেল তুলে দেওয়ায় ‘ফার্স্ট লার্নার’ শিক্ষার্থীদের ব্যপক
ক্ষতি হয়েছে। বছরের পর বছর এই সব শিক্ষার্থীদের পাশ নম্বর দিয়ে উঁচু শ্রেণীতে তুলে
দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষা ব্যর্থ হলেও তাঁদের প্রোমোট করা হচ্ছে। অথচ সারা বছর তারা কিছু
শিখছে না। প্রথম প্রজন্মের এই সব শিক্ষার্থীরা যখন ক্লাশ নাইনে উঠছে দেখা যাচ্ছে তারা
প্রাথমিক শিক্ষার কিছুই শেখেনি। ৮ থেকে ১০ বছর কিছু না শেখার জন্য তারা যে কোনও পরীক্ষায়
ফেল করছে। এবং এখানেই ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ও ব্যর্থ হচ্ছে।সেই সঙ্গে সঙ্গে স্কুল ছুটের
সংখ্যাও বাড়ছে। সম্প্রতি আইডিআর নামক একটি সংস্থার করা ওড়িষার কটক অঞ্চলের একটি সমীক্ষা
থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারি শহরে বস্তিতে থাকা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মা ও ছাত্রদের
মুখোমুখী সমীক্ষকরা বসিয়ে কথা বলেছিলেন। এই অভিঞ্জতা দারিদ্র সীমার নীচে থাকা শিক্ষার্থীদের
পাঠ্যক্রমে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা দাবি করছে। সরকারি আধিকারিকরা দেখেছেন বস্তি অঞ্চলের
মায়েরা নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বিভিন্ন বিষয়ে শেখাচ্ছেন। তাঁদের সীমাবদ্ধ
শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে। যদিও এই মডেল ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে চালু আছে। কিন্তু
সে সুযোগ ‘মার্জানালাইজড’ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পায় না। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকেও
এই মডেলের কথা ভাবতে হবে।
২০১৪ সালে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক
বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য যৌথভাবে একটি নিবন্ধে দাবি করেছেন, বিশ্ব
ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকার এবং পরিবার আগের চাইতে ঢের
বেশি খরচ করছে স্কুলের পড়াশোনার জন্য। স্কুলে যাচ্ছেও অনেক বেশি ছেলেমেয়ে। কিন্তু শিখছে
অনেক কম।তাঁরা আরও লিখছেন, ‘’শিক্ষকরা যখন
তাঁদের পড়ানোর বিষয়টি সম্পর্কে জানেন(অনেকই জানেন না- বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে মাত্র
৪৭ শতাংশ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক প্রাথমিকের অঙ্ক ঠিক কষতে পেরেছেন।), তখনও তারা অনেকেই
বিষয়টি ছাত্রদের বোঝাতে পারছেন না।‘’ এমতবস্থায় ২০১৪ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট
‘স্কুল লার্নিং ইন সাউথ এশিয়া’ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ২০০১ সালে
প্রাথমিক স্কুলে নাম লেখাত ৭৫ শতাংশ শিশু। সেকেন্ডারি স্কুলে ৪৪ শতাংশ। ২০১০ সালে তা
বেড়ে হয়েছে ৮৯ শতাংশ এবং ৫৮ শতাংশ। ওই সময়ে স্কুলছুট পড়ুয়াদের সংখ্যা সারে তিন কোটি
থেকে কমে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লক্ষ। কিন্তু প্রাথমিকের পড়ুয়াদের এক-চতুর্থাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ
পড়তে-লিখতে ও অঙ্ক কষতে শিখছে না। এতে আর্থিক উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে, কারণ দক্ষ কর্মী
না থাকলে শিল্পোদ্যোগীরা বিনিয়োগ করতে চান না।২০১৪ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের করা রিপোর্ট
থেকে পাওয়া ছবিটা একটুও বদলায়নি। ২০১৪ সালে প্রাক প্রাথমিকে শেখার মান যা করতে হবে
সেই বিষয়েও বিশ্বব্যাঙ্কের পরামর্শ ছিল। বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছিল, প্রাক-প্রাথমিক বয়সের
শিশুদের যথাযথ পুষ্টি যোগাতে হবে। শিক্ষকদের বোঝানোর দক্ষতা এবং দায়বদ্ধতা বাড়াতে
‘পারফর্মান্স’-ভিত্তিক পারিশ্রমিক। স্কুলের আর্থিক বরাদ্দকে প্রয়োজন এবং ‘পারফর্মান্স’-এর
সঙ্গে যুক্ত করা।সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলে ছাত্রদের উন্নতির মূল্যায়নের ব্যবস্থা
তৈরি করা এবং ক্রমাগত তার পরিমার্জন করা।
ভারতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির
ছবিটা একবার দেখে নেওয়া যাক। মিড মিলের বরাদ্দ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কিছুটা বাড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পোষণ প্রকল্পে ৭ অক্টোব্র বিঞ্জপ্তি দিয়ে কেন্দ্র জানায় যে চলতি শিক্ষাবর্ষের
অক্টোবর মাস থেকে প্রথম শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মিড ডে মিলের বরাদ্দ
মাথা পিছু ৪৮ পয়সা বাড়ানো হল। আগে এই বরাদ্দ ছিল ৪ টাকা ৯৭ পয়সা। এখন হল ৫ টাকা ৪৫
পয়সা। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মাথা পিছু মিড মিলের বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র
৭২ পয়সা। আগে ছিল ৭ টাকা ৪৫ পয়সা এখন বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ১৭ পয়সা। এই বরাদ্দের কেদ্রীয়
ও রাজ্য সরকারের আনুপাতিক হার যথাক্রমে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ।রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষক
সংগঠন ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে বরাদ্দকৃত ওই টাকায় রাজ্য সরকারের সাপ্তাহিক মেনু চার্ট
মেনে একদিন একটা গোটা ডিম সহ পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া কিভাবে সম্ভব?
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা
গেল, মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলার তরুণ আইএএস আধিকারিক জিতেন্দ্র ডুডি লক্ষ্য করলেন, তাঁর
নিজের জেলায় এনএএস-তে ফলাফলে জাতীয় গড়ের তুলনায় মহারাষ্ট্র ভাল জায়গায় হয়ত আছে। অথচ
তাঁর নিজের জেলায় কিছু অঞ্চলের তৃতীয় শ্রেণীর পড়ুয়াদের প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন
ভাষা বা অঙ্কের সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। তিনি সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিলেন। শুরু
করলেন ‘লার্নিং ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’। এই প্রকল্পে জেলাপরিষদের অন্তর্ভুক্ত স্কুলগুলির
প্রতিটি ছাছাত্রীর মূল্যায়ন, রিপোর্ট কার্ড তৈরি করে স্কুলগুলির শিক্ষকদের হাতে তুলে
দেওয়ার পরামর্শ দিলেন তিনি। ভাষাশিক্ষা ও গণনার ক্লাসে সৃষ্টিশীল শিক্ষণের পরিকল্পনা
ও তার ব্যবস্থা করলেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়
শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবক বিশেষত মায়েদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করলেন তিনি। অভাবনীয়
সাফাল্য পাওয়া গেল। আমরা আমাদের লেখায় ওড়িষার কটক অঞ্চলের সাম্প্রতিক সময়ের একটি সমীক্ষা
রিপোর্টে মায়েদের যুক্ত করার প্রসঙ্গ পেয়েছি।
মহারাষ্ট্রের তরুণ আইএএস আধিকারিক জিতেন্দ্র ডুডির
প্রকল্প অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। মাত্র ছ’মাসের মধ্যে এই প্রকল্পে ইতি মধ্যেই এক
লক্ষেরও বেশি পড়ুয়া যুক্ত হয়েছেন। সারে পাঁচ হাজারেরও কিছু বেশি আগ্রহী শিক্ষক এই প্রকল্পের
সাফল্য মেনে নতুনবৃত্তে এসেছেন। সুত্রের খবরে জানা যাচ্ছে, এই প্রকল্পের আওতায় থাকা
পড়ুয়ারা বই পড়তে পারছে। অঙ্কের গুণ-ভাগ, খাতায় উত্তর লেখার মতো সাধারণ বিষয় অথচ অত্যন্ত
প্রয়োজনীয় এবং মৌলিক দক্ষতাগুলি শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সঙ্গে আয়ত্ত করতে পারছে।এই উদাহারণ
আমাদের শিখতে বলে গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে উদ্ভাবনী শিক্ষা পদ্ধতির
সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকদের পরিচয় করাতে হবে। এবং সফল ওই পাঠ্যক্রমকে সার্বজনীন পাঠ্যক্রম
হিসেবে সরকারি স্তরে গ্রহণ করা ও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলা মনে হয়।
Comments
Post a Comment