প্রান্তজ্যোতির ঠিকানা রাধানগর
দীপেন্দু চৌধুরী
মানুষ?
মানুষ কে চায়? কে-বা চেয়েছে কখনও!
আমরা শুধু সংখ্যা চাই, সংখ্যাতীত সংখ্যা জানি কীভাবে
রচনা করা যায়।
রাজধর্মে, ন্যায়ধর্ম সত্যধর্ম নেই ফুয়েরার
শুধু জয়ধর্ম আছে----
শঙ্খ
ঘোষ, শারদীয় দেশ, ১৪২২
উৎসব কাকে বলে? ভুলে বসে আছি! না করোনাকালে নয়।
প্রায় তিন দশক আপনার বলয়ে বিচ্যুত সামাজিকতায় আমরা থাকি। থাকি বলব না থাকতে বাধ্য হই?
কোনটা বললে প্রচলিত সংস্কৃতির অনুমোদন পাওয়া যাবে তাও জানি না। এই ভাবে ঠিক এই ভাবে
বলতে বলতে, পরতে পরতে আবৃত্তি করতে করতে আবারও এক যুগ কেটে গেল। মোচড় একটা লেগেছিল
ঠিক দশ দশটা বছর আগে।পায়ে হেঁটে পায়ে হেঁটে। এক বাও মেলে না, দো বাও মেলে না গুণতে
গুণতে এতটা পথ আসা। তবু বৌদ্ধিক ব্রাহ্মাণ্যতন্ত্রের কঠোর থেকে কঠোরতম নিদান ভাঙতে
পারা যায়নি। সম্ভবত এই বছর করোনা উত্তরকালে শুক্লপক্ষে দেবীর বোধনে উত্তরণের আলো ছুঁয়ে
যেতে চাইল।টাপুর টুপুর জ্যোৎস্না মাখা শিশিরে ভিজলাম। কৃষ্ণপক্ষেও জোনাকিরা অবগুণ্ঠন
খুলে পথের দিশা চিনতে বলল। দিনটা পঞ্চমীর দিন। রাধানগর সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির
মঞ্চে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়েছে।অঘোষিত আপ্যায়ন পেয়ে আমার থতমত অবস্থা। এমনটা জানাও ছিল
না। পূর্বে ঘোষণাও কখনও শুনিনি। ২২ মে ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ের জন্মবর্ষের দিন
আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এই বছর দুর্গা পুজোয় সপরিবার হুগলির রাধানগরে যেতে হবে।কিন্তু
রাধানগর সার্বজনীন দুর্গাপুজোর উদ্বোধন আমাকে করতে হবে আরও অনেকের সঙ্গে, আমি জানতাম
না!
প্রখর বৈশাখীবেলার স্বপ্নে যেমন ভাবিনি। আবার শিউলি
ভেজা শরতেও কল্পনা করতে পারিনি।এই আমন্ত্রণ পাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে কি? কথা ছিল আমরা
ষষ্ঠীর দিন বিকেলে কলকাতা থেকে রাধানগর যাব। আগের পরিকল্পনা বাতিল করে আমাদের নিয়ে
যাওয়া হল চতুর্থীতে। আর তাই ঝলমলে এলইডি আলোর প্লাবনে আমার স্মৃতি আমাকে আবার প্রখর
গ্রীষ্মের আঙিনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেল।কৃষ্ণপক্ষের এক বারবেলায় আমার কম্পিউটার নবতরঙ্গে
ভাষা পেয়েছে। আত্মীয়সভার আত্মীয়তায়। পঞ্চমীর আনুষ্ঠানিকতায় শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্না ভেজা
কুশকাঠির আত্মীয়সভায় আমি তখন বসে। মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন রাজা রামমোহন রায়ের জীবনীকার
ডঃ পরেশচন্দ্র দাস, শিক্ষাবিদ বাসুদেব বসু এবং আরও দু’জন খ্যাতনামা তরুণ শিক্ষক।আমি
আলোকিত আলোয় দশকের পর দশকের স্মৃতির পাতা খুঁজছি। কানে এলো সঞ্চালক আমাকে কিছু বলার
জন্য ডাকছেন। প্রস্তুত হয়েতো আসিনি। তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিতে হবে। ভুল হতে পারে, তবু
বলতে হবে কয়েক দশকের ক্লান্তির অবসাদ থেকে মুক্তি নিয়ে।
শুরু করলাম বলতে, আমাদের কলকাতার উপকণ্ঠের পাড়াটা
ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর রাত, কেউ কী জেগে আছে? আমাদের বাড়ির বাইরে থেকে কে যেন
ডাকছে ‘অবনী বাড়ি আছো’? মধুমেহ রোগাক্রান্ত স্মৃতি আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রতারণা করে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মিথ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত কবিতার লাইন এটা।গভীর রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকার
ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। সে রাতে আমার ঘুম অত্যন্ত পাতলা ছিল। নলহাটির বাড়ি ছাড়ার পরে
এভাবে কেউ কী আগে ডেকেছে? কিছু কিছু কবিতার প্রথম ছত্রের তিনটে লাইন আমার মনে থাকে।
আবার মধুমেহ আবিলতায় ভুলেও যাই।পঞ্চমীর দিন আত্মীয়সভার মঞ্চে মনে পড়ল। সার্বজনীন দুর্গোৎসব
কমিটির মাঠে টাপুর টাপুর ভেজা শিশির পড়ছে। নিঃশব্দ হিমেল হাওয়ায় কয়েকশো মানুষ আমার
কথা শুনছে, আমি বলে যাচ্ছি। ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া/
‘অবনী বাড়ি আছো’? এক গভীর রাতে আমাদের ক্লান্ত পাড়াটায় বিশ্বজিৎ এসেছিল। সঙ্গে লাঠি
হাতে বাসুদেববাবু। এবং পরেশবাবু। আমি আহ্বান শুনলাম। তাই আজ এই আলোকিত মঞ্চে। আমার
নমস্কার গ্রহণ করুন আপনারা।রাধানগর তোমাকে নমস্কার। আমি ধন্য হলাম। আমি আজও অপেক্ষায়
আছি নতুন কবির জন্য, যে কবি, শিল্পী, খেলোয়াড় এগিয়ে আসবে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকতায়।
প্রত্যন্ত পাড়া থেকে ডেকে আনবে মীনা দলুইকে।
রাধানগর সার্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণ জমে গেল ষষ্ঠীর দুপুর থেকে। বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। বিষয় ছিল ‘করোনা সচেতনতা’। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত চামচ ও গুলি দৌড়, অক্ষর সাজানো, অঙ্ক দৌড়। যে কোনও বয়সের পুরুষের জন্য রিং থ্রো, বাস্কেট বল খেলা। যে কোনও বয়সের মহিলাদের জন্য ছিল শাঁখ বাজানো, হাঁড়ি ভাঙা এবং চোখ বেঁধে ছবিতে টিপ পরানো।বুদ্ধিদীপ্ত ক্যুইজ, অন্ত্যাক্ষরী প্রতিযোগিতা। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত ছিল মোট ৩৬ টা খেলা। রাজা রামমোহন রায়ের উপর প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা।বিষয় ছিল, ‘রাজা রামমোহন রায়েরর ২৫০ তম জন্মবর্ষে তৎকালীন সময়ে ভারতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান’।প্রবন্ধের মান নির্ণয় করে স্থানাধিকারীরদের নাম আমাকেই ঘোষণা করতে হয়। সপ্তমীর দিন ছিল মহিলাদের নাটক।বধূ নির্যাতনকে বিষয় করে নাটকের নাম ছিল ‘একালের নিরুপমা’। প্রায় আড়াই ঘণ্টার নাটক মঞ্চস্থ করেন বিভিন্ন বয়সের স্থানীয় মহিলারা। টান টান উত্তেজনা নিয়ে নাটক দেখেছেন মাঠ ভর্তি দর্শক। দশমীর দিন সন্ধ্যেয় দু’টি আকর্ষণীয় খেলা ছিল।একটি ছেলেদের দড়ি টানাটানি। দু’টো গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা এই খেলায় অংশ নেয়। দড়ির দু’দিকেই জাতপাত, ধর্মবর্ণ মিলে মিশে একাকার। নকু-মাকু, ফেকু সব একটাই দড়ি টানছে। না কোনও ধর্মের বেড়াজাল নেই। কোনও সুচতুর রাজনীতির মসৃণ কৌশল নেই। শুধু আছে নব যৌবনের সম্মিলিত শক্তি।
‘ভারতে ধর্মের উদারতা’ শিরনামে ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, ‘’এই বিষয়ে ভারতের
ইতিহাসের একটি বিশেষত্ব আছে। যুগে যুগে কত যে জাত এসেছে, কত যে ধর্ম ও সংস্কৃতি একের
পর এক এখানে এসেছে, তা বলে শেষ করা যায় না।বৈদিক আর্যদের পূর্ব হতেই এখানে নানা ধরণের
সভ্যতা ছিল।আবার তাদেরও পূর্বেকার সংস্কৃতি ও ধর্ম এই দেশে ছিল। এখানে কেউ কাউকে নষ্ট
করে বা দাবিয়ে রেখে নিজের মত ও ধর্মকে জয়যুক্ত করতে চায়নি।সবারই ভাব, ‘’সবাই থাক, আমরাও
থাকি’’ (‘’Live and let live’’)।তাই এই
দেশে অতি প্রাচীন আদিমতার পাশে পাশেই অতি উচ্চ ধর্মভাব বিনা বিরোধে বিরাজ করচে।রবীন্দ্রনাথ
যখন শান্তিনিকেতনে বসে গীতাঞ্জলি লিখচেন, তখন তার পাশেই সাঁওতাল গ্রামে সাঁওতালেরা
বোঙ্গা(ভূত) পুজোয় মত্ত আছে।কিন্তু কেউ কাউকে তো বাধা দিতে উদ্যত হয়নি।
নদীর মুখে যেমন নানা স্তর পড়ে ক্রমশ নূতন দেশ তৈরি
হয়, তেমনি ভারতের ধর্ম সংস্কৃতি ও ধর্ম নানা জাতির দান নিয়ে সমৃদ্ধ। আর এখনও সেই সব
জাতি নির্বিরোধে আপন আপন সংস্কৃতির সাধনা করেই চলেছে। তাই তুলনামূলক ধর্মের যারা আলোচনা
করতে চান, তাঁদের পক্ষে এই দেশ অতি চমৎকার। এই একটি দেশেই তাঁরা পাশাপাশি বিরাজিত সব
রকমের মতবাদ দেখতে পাবেন।‘’ (দেশ, ১৪ বর্ষ, ৫ সংখ্যা, ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬)। এই হচ্ছে রাজা
রামমোহনের ভারতীয় সমাজ।
গণতন্ত্রের দড়ি টানাটানি।ধর্ম মুক্ত, বর্ণমুক্ত,
জাতপাতমুক্ত দড়ি টানা টানি খেলা চলছে। অনেকক্ষণ আগে বলি অথবা কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। চিনাসুরের কারণেই
হোক বা বঙ্গাসুরের নিম্নচাপে শারদোৎসবের চারদিন এক পশলা দু’পশলা পসরা সাজিয়ে বৃষ্টি
হয়েছে। শরতের মণ্ডপ প্রাঙ্গণের মাঠ ভিজে। ভেজা টাটকা ছোট্ট ছোট্ট ঘাসে ছোট্ট ছোট্ট
পায়ে দাঁড়িয়ে ও দড়ি টানাটানি খেলা দেখছে। খালি পা। পুরনো সবুজ রঙের একটি জামা।মুখে
বিকেলের পড়ন্ত সোনালী রোদের অম্লান হাসি।টানা টানা পটল চেরা উজ্জ্বল দু’টো চোখ। আমরা
আরও কিছুক্ষণ পরেই ওকে আবিষ্কার করব। কেউ যেন ওর কানে কানে বলে দেবে ফাইট মীনা, ফাইট।
ফাইট মীনা ফাইট! শুরু হবে ১৮ উর্ধ মেয়েদের ‘সুরের চেয়ার’(মিউজিক্যাল চেয়ার)-র খেলা।
মীনার পরিবারে সুর একটা আছে। সেটা বিষাদের সুর। কিন্তু মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা কী?
মীনা দলুই জানে না।২২ জনের খেলা। ২১ জন মেয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মীনা কোচকে বলল, আমি খেলব।
ক্লাস সিক্সে পড়া দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মীনা অসম বয়সী দিদি, বৌদি কাকিমাদের সঙ্গে মিউজিক্যাল
চেয়ার খেলবে। সকলে মিলে আপত্তি করল। কেউ একজন বলল, এই তুই এত ছোট বড়দের সঙ্গে কী খেলবি?
কোচ প্রবীরবাবু মীনাকে খেলার সুযোগ করে দিলেন। খেলার নিয়মও বলে দিলেন।
খেলা শুরু হয়েছিল বিকেল চারটেয়। আমি দশ মিনিট পরে
এসেছিলাম। এসেই দেখলাম মীনার পায়ে কাদা। ছোট্ট দু’টো পায়ে কাদামাটি লেগে রয়েছে। খেলা
চলছে। বেশির ভাগ মেয়ে চেয়ারের কোল ঘেঁসে ছুটছে। কাদা মাখা মাঠের কাদা বাঁচিয়ে।মীনা
ছুটছে ওর দিদি, কাকিমাদের পাশে পাশে। দু’পায়ে কাদা মেখে। একটা করে চেয়ার পড়ছে একজন
করে খেলার বাইরে চলে যাচ্ছে। মীনা অক্লান্ত হাসি মুখে লড়ে যাচ্ছে। অবশেষে চূড়ান্ত পর্বের
খেলা। মাত্র তিনটে চেয়ার।চারজন প্রতিযোগী। তৃতীয় স্থানের খেলা। মীনাকে একজন ধাক্কা
দিয়ে ফেলে দিল। ।কবি শঙ্খ ঘোষ বলছেন। ফুয়েরার
আমাদের শিখিয়েছেন।আমাদের জিততে হবে।রাজধর্মে, ন্যায়ধর্ম সত্যধর্ম নেই ফুয়েরার। শুধু
জয়ধর্ম আছে।গোয়েবেলস ১৯৩৩।কিন্তু গোয়েবেলস সেদিনও জেতেনি।এদিনও জিততে পারবে না।ফুয়েরার
আপনাকে বলছি, এই বাংলায় সত্যের জয় আছে তথাকথিত বৌদ্ধিক বৃত্ত ভেঙে।আজও ন্যায় আছে, আজও
প্রাণ আছে।
মীনা আগে এসে চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়েছিল। কোচ এসে
মীনাকে বসিয়ে দিল। ওরা তিনজন আবার খেলা শুরু করল। এবার দ্বিতীয় স্থানের খেলা। মীনা
প্রতিযোগিতায় থেকে গেল। পরে পরেই সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তের খেলা। প্রথম স্থানের খেলা।
মিউজিক শেষ হবে। অভিজাত চেয়ারে হত দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বসবে। জিততে ওকে হবেই।তথাকথিত
আভিজাত্য ভেঙে পড়ছে, মীনা দৌড় শুরু করল। দুটো চেয়ারের মাঝ দিয়ে এসে প্রান্তজনের ঠিকানা
জানান দিল মীনা। এই চেয়ার আমারও, আমাকেও বসতে হবে। না মীনা মাঝ মাঠের প্রথম চেয়ারে
বসেনি। এসে দাঁড়িয়েছিল।এক রাশ দ্বিধা, সংকোচ।কোচ প্রবীরবাবু এসে বসিয়ে দিল মীনাকে।
একজন এসে মীনার দু’হাত ভরে চকলেট দিল। মীনা ছুটে গেল হেরে যাওয়া প্রতিযোগীদের কাছে।
প্রত্যেককে একটা করে চকলেট দিয়ে ছোটদের মধ্যেও বিলিয়ে দিল।আমার মনে পড়ে গেল সম্রাট
আলেকজান্দার-পুরুর ইতিহাস। আকাশ হাসছে, বাতাস হাসছে। মা দুর্গা হাসছে। মাঠের মধ্যে
একটা হৃষ্টপুষ্ট বেজি অবাধে চলে গেল। মীনা এসে তাঁর কোচ ‘ক্ষীতদা’ প্রবীরবাবুকে প্রণাম
করল। তখনও মীনা হাসছে। ওর ক্লান্তি নেই। দু’টো পায়ে গ্রাম বাংলার কাদামাটি। আমরা পৌঁছে
গেলাম প্রান্তজ্যোতির ঠিকানায়।
Comments
Post a Comment