কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প বা একশো দিনের কাজের বিকল্প কি?






দীপেন্দু চৌধুরী

বিগত দুটি দশকের দেশের প্রধান সমস্যা বিপুল সংখ্যক মানুষের চরম দারিদ্র।গরিব মানুষের কার্যকর ক্ষমতা বলতে আর কিছু নেই। উন্নয়নের নামে যে অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে, সেই নীতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোনও আলোর দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা। বর্তমান মোদী সরকারের আমলে গালভরা প্রতিশ্রুতির কথা বলা হলেও ‘মর্যাদার সঙ্গে উন্নয়ন’-র নামে গ্রামীণ গরিব মানুষকে কি আরও সমস্যার মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ভারতে চালু হয়েছিল কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প বা একশো দিনের কাজের প্রকল্প। যে প্রকল্পের পোশাকী নাম বা সরকারি নাম মহাত্মা গাঁধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প(এমজিএনআরইজিএ)।ইউপিএ সরকারের আমলে এই প্রকল্পকে ‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি’-ও বলা হত। ২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের  প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদী জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পকে ‘গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প’ বলেছিলেন।অথচ লকডাউনের পরে একশো দিনের কাজের প্রকল্পই গ্রামে ফিরতে বাধ্য হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ভরসা হয়ে উঠেছিল।তবুও গত কয়েক বছর ধরে মোদী সরকার এই প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষত বাজেট বরাদ্দ ঘোষণার সময় মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রীরা উল্লেখিত প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে গ্রামীণ মানুষের হাত থেকে কাজের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে এই কাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দলের সাংসদরা।গ্রামীণ আর্থসামাজিক কাঠামোয় অশনি সংকেত দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।   

মহাত্মা গাঁধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টী প্রকল্পের শোড়শতম জন্মদিন ছিল ২ ফেব্রুয়ারি। ২০০৬ সালের ওই দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনসিংহ অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলায় জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পকে বিশ্বের বৃহত্তম দারিদ্র বিমোচন প্রকল্প হিসেবে আগেই চিহ্নিত করেছে।একটি সূত্র দাবি করছে, জাতীয় কর্মসংস্থান গ্যারান্টী প্রকল্প ভারতীয় জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করে।অন্যান্য কল্যাণ প্রকল্পের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রকল্প।গরিব মানুষের হাতে কাজ তুলে দেওয়ার স্বার্থে এই প্রকল্পের ভাবনা ছিল পূর্ববর্তী মনমোহন সরকারের। সাধারণ মানুষ তথা ভারতের দারিদ্রসীমার নীচের মানুষের ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে স্বীকৃত এই প্রকল্প।এই প্রকল্প চালু করা ছিল রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। মানুষের কাজের নিরাপত্তা তথা খাদ্যের নিরাপত্তাকে কখনই ‘রাষ্ট্রের উদারতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।এমজিএনআরইজিএ প্রকল্প অবশ্যই ভারতীয় নাগরিকদের কাজের অধিকার বিষয়ক একটি গ্যারান্টি।গ্রামীণ মানুষের হাতে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক তুলে দেওয়াকে রাষ্ট্রের মহানুভবতা বা সহানুভূতি বলে ভাবলে চলবে না। ভারতীয় জনগণের কাজের দাবি একটি বৈধ অধিকার। এবং অপরিহার্য ন্যায়বিচার হিসেবে অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 

ইউপিএ সরকারের আমলে জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের সরকারি স্বীকৃতি এলেও এর আগের একটা প্রস্তুতিপর্ব ছিল।১৯৬৪-৬৫ আর্থিক বছরে মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলায় খরা চলছিল।রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ভি এস পেজ একটি ত্রাণ প্রকপের অঙ্গ হিসেবে পরীক্ষামূলক ভাবে এই ধরণের একটি প্রকল্প শুরু করেছিলেন। তিনি কংগ্রেস নেতা হলেও আসলে ছিলেন একজন কট্টর সমাজবাদী নেতা।তিনি মানুষের হাতে কাজ তুলে দেওয়ার ‘গ্যারান্টি প্রকল্প’ হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করেন। ১৯৭০ সাল নাগাদ ১১ টি জেলায় এই প্রকল্প প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সরকারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসন্ত দাদা পাতিলের নেতৃত্বে ‘কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকপ’(ইজিএস)আইন পাস হয়। বলা যায় ভারতে প্রথম একটি রাজ্যে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প হিসেবে কাজের নিশ্চয়তা আইন পাস হয়। সমাজতত্ববিদরা বলছেন, গাঁধিবাদী ধারণা হিসাবে, মহারাষ্ট্রের গ্রামগুলিতে কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প এর অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।গাঁধির গ্রাম ভাবনার সঙ্গে যে চিন্তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গণমাধ্যমে সে সব প্রকল্প বা কাজের কথা হয়ত উঠে আসেনি। শেষপর্যন্ত ইজিএস বিল পাস হয় ১৯৭৭ সালে।

কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি মহারাষ্ট্র থেকেই শুরু হয়েছিল কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য এক পদক্ষেপ। পরবর্তীতে দেশব্যাপী এই প্রকল্প চালুর দাবিতে সমাজবাদী শিবিরের নেতৃত্বে সুশীল সমাজ জোরালো দাবি উত্থাপন করে।তারই ফলস্বরূপ প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়কালে জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্প নিশ্চয়তা প্রকল্প হিসেবে সারা দেশে চালু করা হয়। এবং এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের বৈশিষ্টের গুণেই উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাও মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সরকারের প্রকল্পের কথা মাথায় রেখে একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প শুরু করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাপ্রসূত প্রকল্পই পরবর্তীতে তাঁর আমলের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত করেন। সব রকমের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইউপিএ সরকারের চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধি নিজেও।    

২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার গঠনের আগে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছিল, দল সরকারে আসলে কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হবে।দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হিসেবে দেখা হয়েছিল জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পটিকে। কংগ্রেসের সে বছরের নির্বাচনী ইশতেহার কমিটিতে ছিলেন ভারতে উদার অর্থনীতির প্রবক্তা ডঃ মনমোহন সিংহ, জয়রাম রমেশ সহ আরও কয়েকজন। পুনেতে অরুণা রায়, নিখিল দে, জঁ দ্রঁজ সহ কয়েকজনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার লেখা হয়েছিল।২০০৪ সালে বামেদের সমর্থনে ইউপিএ সরকার গঠন হয়।দীর্ঘ চার দশকের লড়াইয়ের পরে প্রথম ইউপিএ জোট সরকারের আমলে সাধারণ ন্যুনতম কর্মসুচীর অংশ হিসেবে এই প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিল পাস হয় ২০০৫ সালের ২৩ অগস্ট। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প শুরুর পর থেকেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রামীণ মানুষের আয় নিশ্চিত করেছে এই প্রকপ। বিশেষত গ্রামীণ মহিলাদের জন্য আর্থসামাজিক প্রকল্প হিসেবে তাঁদের হাতে আরও বেশী ক্ষমতা তুলে দেয়।‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি’-র সাফল্য এখানেই নিহীত ছিল।                                                                  

চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন করোনাআবহে রুটিরুজি হারানো মানুষের জন্য শুধু শুকনো সহানুভূতিই প্রকাশ করেছেন।উল্টে ‘অমৃতকুম্ভ’-র সন্ধানে উন্নয়নের আলোয় ‘অমৃতকাল’-র রূপরেখা তৈরি করার বিষয়ে বেশী আগ্রহী মোদী সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী। বিরোধী দলের নেতৃত্বের অভিযোগ প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের কাজের বরাদ্দ ছেঁটে অর্থমন্ত্রী ২০৪৭ সালের ‘সেন্ট্রালভিস্টার’ প্রস্তুতি নিচ্ছেন।অর্থমন্ত্রী কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন। আগে যা ছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা, এখন কমে হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

মোদী সরকার একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে তুলে দিতে চাইলেও এই প্রকল্পকে দেড়শো দিনের কাজের প্রকল্প করার সম্প্রতি সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ৮ ফেব্রুয়ারি শিবসেনা সাংসদ প্রতাপরাও যাদবের নেতৃত্বাধীন স্থায়ী কমিটি তার রিপোর্টে বলেছে, কোভিড আর্থিকবছরে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ দিতে এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পে ১.১১ লক্ষ্য কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। তার পরেও কোন যুক্তিতে পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ আর্থিক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়? এটা বুঝতে কি কোনও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন আছে? সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন। বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন মজুরি না রেখে সব রাজ্যেই সমান মজুরির নীতি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তাঁদের অভিমতের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করা যাবে না। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পরিকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দিতে চাইছে। সেই নীতির অংশ হিসেবে একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রেও নতুন করে ভাবনাচিন্তা কেন করা হবে না?   

দেশের প্রথমসারির শিল্পপতিরা জানতে চেয়েছেন, একশো দিনের কাজের বিকল্প কি? ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে বণিকসভার বৈঠকে এ কথা জানতে চান তাঁরা। তাঁরা দাবি জানিয়েছেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে অর্থমন্ত্রী একশো দিনের কাজের প্রকল্পে আরও টাকা বরাদ্দ করুন। শিল্প মহলের যুক্তি, বেকারত্ব, অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির দাপটে গ্রামীণ অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থা। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে বাজারে চাহিদা বাড়বে কি করে? নতুন কল কারখানা তৈরি জন্য বিনিয়োগ করেও লাভ হবে না।                  

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?