নতুন প্রজন্মের ‘আত্মীয় সভা’-র নতুন আঙিনা খুঁজে নিতে হবে






 দীপেন্দু চৌধুরী

মাস খানেক আগে হুগলি জেলার খানাকুল ব্লকের রাধানগর গিয়েছিলাম। আমরা প্রায় সকলেই অগবত আছি যে, রাধানগর নামক এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়।যাকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক ভারতের ঋত্বিক। রামমোহনের জন্মভিটে রাধানগরে একটি মজার গল্প শুনলাম। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স হবে মণিকা কুণ্ডুর(নাম পরিবর্তিত)।তার যখন ১৩ বছর বয়স মানে আজ থেকে ৩২ বছর আগের ঘটনা।মণিকার দিদিমা কনকনে পৌষমাসের শীতের এক কাকভোরে মণিকাকে ঘুম থেকে তুলে বলছে, এই দিদি ওঠ ওঠ। চল আমার সঙ্গে চল। শীত ভোরে ঘুমকাতুরে মেয়ের লেপের ওম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে? কুয়াশায় ঢাকা আকাশে তখনও রাতভোরের অভিমান। টুপটাপ শিশিরের জলে সবুজ পাতায় রূপালি জল নূপুরের ছন্দ দেখতে দেখতে রাস্তায় চলে। দিদিমার কথায় সে গায়ে চাদর জড়িয়ে দিদিমার কাছে জানতে চায়, শীতের এই ভোরে কোথায় যাবে? দিদিম হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আজ সন্ধ্যেয় যখন বাড়ি আসছিলুম রামমোহনের গায়ে কোনও জামা সোয়েটার কিচ্ছু ছিলনি। চল একটা কম্বল দিয়ে আসি। মণিকা সেদিন তার দিদিমার সঙ্গে গিয়ে রাজা রামমোহন রায়ের স্ট্যাচুতে কম্বল পড়িয়ে দিয়ে এসেছিল।রামমোহন শীতে কষ্ট পাচ্ছিল যে।

ঘটনাটা অত্যন্ত সাদামাটা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হচ্ছে ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মশতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতকে ।২২মে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলা সহ সারা দেশে পালিত হয়ে গেল এই সার্ধ-দ্বিশতজন্মবর্ষ অনুষ্ঠান। শুধুমাত্র রাধানগর নয়, খানাকুলের দুটো ব্লকের মানুষের আবেগ হচ্ছেন রাজা রামমোহন। আরামবাগ মহকুমার মানুষ ১৮২৮ সালের আত্মপ্রকাশ করা ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-র কথা জানেন। কিন্তু রাজা রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’-র কথা হয়ত সকলে জানেন না। অথবা মনে রাখেননি। গত দু’মাসে আমাকে বার চারেক রাধানগর যেতে হয়েছে।রাজা রামমোহনের মাটিকে চিনতে এবং জানতে। সেই অভিঞ্জতার মানদন্ডে যেটা বিশ্বাস করতে হচ্ছে, রামমোহন রায় তাঁদের পরম আত্মীয়। আমরা সেই ‘আত্মীয় সভা’-র নতুন আঙিনা খুঁজে নিতে চাইছি। আমাদের দেশের এক টাল মাটাল অস্থির সময়ে সমাজ সমন্বয়ের পথিকৃৎ রামমোহন রায়কে অত্যন্ত অনুভব করছি।হয়ত এই বছর থেকে ‘ভারত পথিক’-কে নিয়ে বাংলায় একটা ঢেউ উঠবে। সেই ঢেউ প্লাবিত করবে সমাজকে। আবার হয়ত থেমে যাবে।আমাদের মনে হয়েছে সমাজ সমন্বয়ের কাজ তথা রাজা রামমোহনের ফেলে রাখা কাজ এক দিনের নয়। এক সপ্তাহের নয়। এক মাসের নয়। নতুন কলমে, নতুন ভাষায় মজে যাওয়া সুরাই নদীর কূলকে সাজাতে হবে আমাদের।

রাজা রামমোহনের মতো বুদ্ধিমান মানুষ সম্ভবত সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি জন্মগ্রহণ করেননি। বলছেন রামমোহন বিশেষঞ্জরা। একটা সময় চার্বাকরা যে কাজ করে গেছেন, বর্তমান সময়ে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ না থাকলেও আমাদের নতুন আঙিনা খুঁজে নিতে হবে।দলিত নিগ্রহ, নারী নিগ্রহের কথা মাথায় রেখে ধর্ম এবং সমাজ সমন্বয়ের দায়িত্ব আমাদের তুলে নিতে হবে। ইতিহাস হচ্ছে সেই সত্য বলে, আমরা যদি পিছনের দিকে পাঁচ হাত পিছিয়ে যাই, পরে দেখতে পাব সামনে আরও অতিরিক্ত পাঁচ হাত এগিয়ে যাবার রাস্তা। এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়  উল্লেখ করতে হচ্ছে, রাজা রামমোহন রায় ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রাধানগর থেকে ধর্ম সমন্বয়ের কাজ শুরু করেছিলেন।রাজা রামমোহন নিয়ে আলোচনা করা মানেই সেই সময়কালের গোঁড়া হিন্দুদের প্রসঙ্গ আসবেই।তথ্য সুত্র থেকে জানতে পারছি, রামমোহন তৎকালে নিজের উদ্যোগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্কুল তৈরি করেছিলেন।তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিত তথা সমাজপতিরা এই স্কুল নিয়ে ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন। না তিনি পিছিয়ে আসেননি।১১ টি ভাষায় ব্যুৎপত্তি ছিল তাঁর।বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।রামমোহনের সমালোচনা করে সে যুগের সমাজপতিরা একটি ছড়া রচনা করেন।‘সুরাই নদীর কূলে/ বেটার বাড়ি খানাকূলে/ ব্যাটা সব নষ্টের মূল/ ওঁ তৎ সৎ বলে ব্যাটা খুলেছে স্কুল/ তিন দফা করলে রফা/ ডুবালে দুই কূল।’ এই ছড়া এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সেই যুগে আবাল বৃদ্ধ-বণিতার মুখে মুখে ফিরত। এতটা আক্রমণ করা সত্বেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক পা সরে আসেননি সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইনের পথিকৃৎ। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মুজমদার লিখেছেন, ‘রামমোহন হিন্দু কলেজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ের হিন্দু ব্রাহ্মণরা বলেন, রামমোহন থাকলে আমরা এই কলেজে থাকব না।’ ভারত পথিক ভারতীয় সাংস্কৃতিক সৌজন্য, ঔদার্য বজায় রেখেই জানিয়েছিলেন, হিন্দু কলেজ যদি করতেই হয় সবাইকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।রামমোহনের লেখায় পাচ্ছি, ‘’স্থির বুদ্ধিযুক্ত মননশক্তি মানুষকে চিনিয়ে দিতে পারে ধর্মতত্বের কোনটি ভ্রান্ত আর কোনটি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।‘’ আধুনিক ভারতের জনক, ভারতীয় ধর্ম সমন্বয়ের পথিকৃৎ, সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন।এবং তাঁর চেতনার মান এতটাই উন্নত ছিল একটি উদাহারন দিলেই বোঝা যাবে। ফরাসিরা স্বাধীনতা পেতে চলেছে জানার পরে তিনি তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার অর্থ তাঁর নিজের ভাষায়, ‘’যে সম্মান হ্রদয়ের শত রক্তবিন্দুর দামে কেনা হয়েছে, কোনো অনুগ্রহের আশায় তাকে দারোয়ানের কাছে বিক্রি করো না।‘’                       

অথচ বর্তমানে তাঁর জন্মভিটে রাধানগর  গ্রামে আনুমানিক ২৫০০ হিন্দু পরিবারের বসবাস হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন মানুষও নেই।সমাজব্যবস্থা, সামাজিক অনুশাসন কতটা নিষ্ঠুর পরিহাস করতে পারে আমাদের সঙ্গে।রামমোহন বিশেষঞ্জরা বলছেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। সেই কারণে সম্ভবত একটিও মুসলিম পরিবার রাধানগর অঞ্চলে নেই। অথচ ইতিহাস শোনাচ্ছে অন্য কথা। মুসলমান নবাবের জামাই কালা পাহাড় খানাকুলে জন্মেছিলেন।কালা পাহাড় নিজে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং এটাও ইতিহাস স্বীকৃত যে, কালা পাহাড় কবি ভরতচন্দ্রের আত্মীয় ছিলেন।এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯১৬ সালে রাজা রামমোহন রায়ের জন্মভিটেতেই তৈরি হয়েছিল রামমোহন স্মৃতি মন্দির। ধর্ম সমন্বয়ের কথা মাথায় রেখে মন্দিরের নকশা এঁকে দিয়েছিলেন আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির অভিভাবক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে।এই মন্দিরের নকশায় আছে হিন্দু, ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মের সমন্বয়। ভারতীয় সামাজিক সম্প্রীতির চিরন্তনী মূর্ছনা এঁকে দিয়ে গিয়েছেন আমাদের হ্রদয়ের কবি রবীন্দ্রনাথ।       

সভ্যতার শুরু থেকেই ভারতীয় উপ-মহাদেশের আপামর মানুষ ধর্মীয় বৈচিত্রকে আপন স্বজন অনুভবে গড়ে তুলেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের সূচনা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অবিভক্ত বর্ধমান জেলা থেকেই শুরু হয়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজা রামমোহন রায় এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। হয়ত এটাও সত্য যে ব্রিটিশ শাসনের আগে থেকেই সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনের কাজ শুরু হয়েছিল। নবাবী আমলেও মুসলিম নবাবদের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথা বিলোপের চেষ্টা হয়েছিল। বলছেন, রাজা রামমোহন বিশেষঞ্জ তথা সুলেখক ডঃ জি সি মণ্ডল। হুগলি জেলার তিন মনীষী রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিয়ে ডঃ মণ্ডল ইংরেজি ভাষায় একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে তিনি ভারতীয় নবজাগরণের প্রসঙ্গ এনেছেন।এবং বহু অনালোচিত বিষয় তুলে ধরেছেন।তিনি বলছিলেন একান্ত আলাপচারিতায়।সময় থেমে থাকে না। ইতিহাসও নতুন করে লেখা হয়। ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্ম সমাজ দ্বিখণ্ডিত হয়। নবীনপন্থীরা গড়লেন ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’।ধর্ম সমন্বয়ের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের চিন্তায় দর্শনে এতটাই ব্যাপ্তি। সত্য উত্তর সামাজিকতায় ফ্ল্যাট বাড়ির চাতালে, গ্রামের আঙিনার ‘আত্মীয় সভা’-য় রামমোহন চর্চা হোক সামাজিক সমন্বয়ের চিরন্তন বিশ্বাসযোগ্যতায়।   

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?