বাংলার আকাশ বাঙালির মল্লার
দীপেন্দু চৌধুরী
রবীন্দ্র জয়ন্তী আসে চলে যায়।আমরা রবীন্দ্র চর্চায় বুঁদ হয়ে
থাকি। হুজুগে বাঙালি খড় বৈশাখের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষে ভর পেট খাই।ঢেঁকুর তুলি।বাঙালি
পোশাকে সাজুগুজু করে পোশাকি বাঙালির প্রদর্শন করতে নেমে পড়ি। তারপর সারা বাংলা রাবিন্দ্রীক
আঙিনায় নিজেদের বাঙালি প্রমাণ করার ইঁদুর দৌড়ে ছুটতে থাকি। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য থেকে
আমরা বহু যোজন দূরে থেকে যাই। সম্প্রতি একটি নিবন্ধে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক
বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, আমি নিজেও বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে লিখি বেশি।তিনি নিজের লেখায়
ব্যাখ্যা করেছেন, ‘অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে কথাটা ঠিক, জাতির জীবনে বাঙালির যে অবস্থান
ছিল, একশো বছর আগে, তা পড়ে গিয়েছে। ২০২২ সালের বাংলা ভারতের দরিদ্রতর রাজ্যের অন্যতম।
ম্যাড্রাস, বম্বে, দিল্লি, আমদাবাদ সব এখন কলকাতার থেকে এগিয়ে গিয়েছে। বাঙালি ছেলেমেয়েরা
বেঙ্গালুরু, গুড়গাঁও ছুটছে চাকরির খোঁজে।’ এই কথাটা কদিন আগে মনে করিয়ে দিলেন কলকাতা
থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম সারি বাংলা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় দফতরের এক মননশীল কর্মী।
তিনি প্রশ্ন তুলছেন, আমরা বাঙালি জাতি, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে হরবখত আলোচনা করছি। কিন্তু
বাংলা ভাষা কি সর্বজন স্বীকৃত ভাষা হিসাবে দক্ষতা অর্জন করেছে? বাংলা ভাষার মাধ্যমে
উপার্জন করা কি সম্ভব? এই প্রশ্নটা আমাদের সত্যি সত্যিই খুব ভাবাচ্ছে।
আজ বাংলা তথা বাঙালি প্রসঙ্গে লিখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ছে,
‘আত্মঘাতি বাঙালি’ শব্দ বন্ধের লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথা।খ্যাতনামা বাঙালি লেখক তথা অন্যতম চিন্তাবিদ নীরদ সি একটি সাক্ষাৎকারে
লেখিকা নবনীতা দেবসেনকে বলেছিলেন, ‘’আমার জীবনে ইচ্ছে ছিল একটি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ
লিখবার, কালচারাল হিস্ট্রি সেটা যখন বুঝলাম আর হবে না, তখন আমার বয়স পঞ্চাশ। নাইন্টিন
ফর্টি সেভেন। তখন আমি আত্মজীবনী লেখায় হাত দিলাম।‘’ বাঙালি আত্মঘাতী কিনা জানি না।
তবে বর্তমান সময়ের নিরিখে আমরা নিজেদের আত্মবিস্মৃত বলতেই পারি।গতিশীল সময়ের অলঙ্ঘনীয়
প্রভাব আমদের বর্তমান প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে ফেলেছে।গত এক দশক বা তার কিছুটা বেশী
সময়কাল সচেতন ভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, প্রযুক্তি এবং সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে
আমরা অসতর্ক হলেও আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছি। বাঙালি নিজের সত্তা বিষয়ে পরিসর ছেড়ে দিয়ে
অন্য কোথাও গাঁটছাড়া বাঁধতে চাইছে।সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রাসী এক সংস্কৃতি
তথা জাতিসত্তার নিভৃত আগ্রাসন বাঙালির ঐতিহ্য ভেঙে খান খান করতে চাইছে।
বিশেষত সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার তাগিদ থেকে। একটা উদাহারণ দেওয়া
যাক, ডিজিটাল মাধ্যমে, সামাজিক পরিসরে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে একদল তথাকথিত সংস্কৃতিজীবী।তারই
পরম্পরায় বর্তমান সভ্যতা নতুন সংযোজিত এক ভাষালিপি আমাদের উপহার দিয়েছে।‘হিংলিশ’ নামক
এক শব্দদৈত্যের আবির্ভাব হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে এই ‘শব্দদৈত্য’-র প্রভাবে বাঙালি সহ
সারা ভারত আক্রান্ত।বাঙালি পরিবারের তরুণ প্রজন্মও এই ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলতে পারছে না।প্রশ্ন
উঠছে বাংলা ভাষা তথা বাঙালি কি আক্রান্ত? বাঙালি জাতির নিজস্ব সত্তা খুঁজতে কেউ কেউ
নতুন অধ্যায় রচনার কথা বলছেন। কেউ কেউ নতুন ভূখণ্ডের প্রয়োজনের কথা বলছেন। বিদগ্ধ বাঙালি
বিদ্বজ্জনেরা আছেন, তাঁরা অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের পথ দেখাবেন।
ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদরা তথ্য সহকারে দাবি করছেন, ভাষা হিসেবে
বাংলার প্রাচীনত্ব খ্রিস্টিয় দশম-একাদশ শতকের সমসাময়িক। এই সময়কালে বাংলা বলে কোনও
এলাকা ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে
বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা একত্রিত করে একটি অঞ্চল
ছিল। যে ভূখন্ডটি ভৌগলিক আয়তনে একুশ শতকের ফ্রান্সের চেয়ে বড় ছিল। ইতিহাসবিদদের আরও
দাবি ব্রিটিশ আমলের ‘বাংলা’ নামক প্রদেশের উৎপত্তি মুঘল আমলের বাংলা সুবা থেকে। লেখার
প্রয়োজনেই উল্লেখ করতে হচ্ছে, মুসলমান শাসকদের শাসনকালের আগে বাংলার অখণ্ড রূপের কথা
কোনও ইতিহাসবিদ বা সমাজবিঞ্জানী দাবি করেননি। সেই সময়ে বঙ্গভাষীরা বাংলার বিভিন্ন জনপদে
বাস করতেন। বঙ্গদেশের এক অংশের নামছিল বঙ্গাল।বাংলা ভাষাবিদ ও ইতিহাসবিদদের লেখায় পাওয়া
যাচ্ছে, ‘বঙ্গ’ নামক জনপদের সঙ্গে ‘আল’ শব্দটি যুক্ত করে বঙ্গাল শব্দের উৎপত্তি। অবিভক্ত
ভারতের সুবে বাংলা ছিল ভাটির দেশ। উদার প্রকৃতির প্রাচুর্যে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি
হত সে সময়।অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জলের ধারা বাঁধ দিয়ে আটকাতে আল দেওয়া হত।সেই কারণে আল
শব্দের বহুল পরিচিতি ছিল।‘আল’শব্দের বহুল
ব্যবহৃত করা হত। তার থেকেই বংগাল শব্দের উৎপত্তি। ইংরেজিতে বেঙ্গল ও অন্যান্য ইউরোপীয়
ভাষায় বেঙ্গালা বলা হত।
বঙ্গবাসীদের জনপদ বলতে যেমন দক্ষিণ ও পূর্বে ছিল বঙ্গ, সমতট,
হরিকেল, বঙ্গাল, উত্তরবঙ্গে ছিল পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, পশ্চিমের অংশে ছিল রাঢ়, সূক্ষ্ম
তাম্রলিপ্ত। এছাড়াও উত্তর এবং পশ্চিমের কিছুটা অংশ নিয়ে ছিল গৌড়বঙ্গ। অবিভক্ত বঙ্গ
প্রদেশের কোন কোন অংশকে নিয়ে গৌড় গড়ে উঠেছিল সেই বিষয়ে পরিষ্কার ছবি আমরা পাই না। কালের
নিয়মেই আমাদের অগচোরে রাষ্ট্রের সীমা পরিবর্তনশীল। ভাটির দেশের মতোই এক ভূখণ্ড ভেঙে
আর এক ভূখন্ডে মিলে মিশে যায়।যে কথা ‘বাঙ্গালির ইতিহাস’-র লেখক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন।
তাঁর লেখা বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি লিখছেন, ‘রাষ্ট্রীয় সীমা পরিবর্তনশীল; রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতার প্রসার ও সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে, কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রসীমা প্রসারিত
ও সংকুচিত হইতে পারে; প্রায়শ হইয়াও থাকে; প্রাচীনকালে হইত, এখনও হয়।’ সাম্প্রতিক কালের
একটা উদাহারণ দেওয়া যাক। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে বিংশ শতাব্দীর অভিশপ্ত ভারত ভাগের
কারণে দুই বাংলার মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল নতুন এক লড়াই। বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেমাটি
ছেড়ে নতুন ভূখণ্ডের খোঁজে এক অভিযাত্রা। পূর্ব বঙ্গ থেকে এই বাংলায় আছড়ে পড়েছিল বাঙালির
ঢল।শৈশব কৈশরের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া পূর্ববঙ্গ নামক বঙ্গভূমির সমস্ত উদ্বাস্তুদের
জায়গা দেওয়া গেল না পশ্চিমবঙ্গে।
এই বাংলার আঠার লাখ আঠাশ হাজার একর বাড়তি জমিতে এত লোকের জায়গা
দেওয়া সম্ভব হল না। অতএব তাঁদের ঠাঁই হল দন্ডাকারণ্য, আন্দামানে। ১৯৪৭ সালের পরে ৭৫
বছর ধরে পাথর বালির দেশ রুক্ষ দন্ডাকারণ্যকে বাঙালি উর্বর করে নিল আপন ভূখণ্ড ভেবে।বাঙালি
সত্তার আরও এক ট্র্যাজিক অধ্যায়ের সূচনা হল এই পর্বে।নিজে এবং পরিবারকে বাঁচাবার তাগিদে
যারা দণ্ডাকারণ্য নামক বাঙালির নতুন উপত্যকায় থাকতে বাধ্য হল, তাঁরা নিজেদের অজান্তে
হারিয়ে ফেলল বাঙালি সত্তা।নতুন প্রজন্ম ওড়িশার কোরাপুটের উমরকোট, রায়গড়, মালকানগিরি
মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায় পারলকোট, যামরি ফরাসগাঁও, কোন্ডাগাঁওয়ের একত্রিত অঞ্চলে
বড় হয়ে উঠল। তিরিশ হাজার বর্গ মাইলের জঙ্গল ঘেরা দণ্ডকারণ্যের নতুন বাঙালি প্রজন্ম
তাঁরা। বাংলার কৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতির সম্মিলিত ধারা ভুলে নিজেদের অগোচরে দন্ডাকারণ্যকেই
নিজেদের দেশ করে নিতে বাধ্য হল দন্ডাকারণ্যের বর্তমান প্রজন্ম।এখন প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান
প্রজন্মের দন্ডাকারণ্যের বাঙালি আর সাবেক পূর্ব বঙ্গ থেকে উৎখাত হওয়া বাঙালি কি এক?
সময়ের নিয়মেই দন্ডাকারণের বর্তমান বাঙালি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলা শব্দের সঙ্গে
হিন্দি শব্দ মিশিয়ে কথা বলতে শিখেছে।দন্ডাকারণ্যের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হিন্দি
ভাষায় লেখাপড়া শিখে সম্পূর্ণ অন্য ধারার মানুষ।বাঙালি সত্তার অধিকারের কথা যে সব বাঙালি
বিদ্বজ্জনেরা বলেন, তাঁরা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কবি কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণ লিখেছিলেন
বঙ্গের ভাষায় বা বাংলা ভাষায়। গোস্বামী তুলসী দাস রামায়ণ লিখেছিলেন ‘অওয়ধী’ ভাষায়।
অথচ গত কয়েক দশক ধরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তুলসীদাস ছিলেন হিন্দি
কবি।
Comments
Post a Comment