একুশ শতাব্দীর নবনালন্দার আশা ও স্বপ্নের স্রোত
দীপেন্দু চৌধুরী
সামাজিক মানদণ্ডে বিচার করলে দেখতে পাব সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা
বর্তমান সময়েও অত্যন্ত জটিল অবস্থায় আছে।শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষঞ্জদের অভিমত এমনটাই।
ভারতবর্ষ এমনই একটি দেশ যে দেশে আজও জাতিভেদ প্রথার অনুভূতিশীল রঙিন বৈচিত্র রয়েছে।ভাষায়
সাজিয়ে বলতে হয় বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য।শুধু দলিত বা বহুজন সম্প্রদায় নয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ও
আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সব সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্বাধীনতার ৭৫ বছরের
পরেও ন্যায় বিচার হয়নি। বর্তমান ভারতের অবস্থা আরও জটিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর
নেতৃত্বে শিক্ষাকেও ধর্মীয় আঙিনায় এনে ফেলা হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে সরকারি বা বেসরকারি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত গৌরববর্ধক সম্মান চিহ্ন। পোশাকি নাম শংসাপত্র বা সার্টিফিকেট।
চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নামী অথবা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্র প্রতিযোগিতামূলক
চাকরির ক্ষেত্রে কতটা সাহায্যে আসে? প্রশ্নটা বিগত কয়েক দশক থেকে রয়েই গিয়েছে।সম্প্রতি
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি আমাদের চমকে দিয়েছে। বিহারের পাটনার গঙ্গার তীরে
সপ্তাহের শেষে জমায়েত হয় বহু যুবক।সরকারি বেসরকারি ক্ষেত্রের বিভিন্ন চাকরির জন্য সেই
সব যুবকরা আসছেন।নবনালন্দার এক তরুণ শিক্ষকের কাছে পেশাদারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে।
বিহারের পাটনা কলেজের পিছনে গঙ্গার পাড়ে বিনা পারশ্রমিকে কোচিং
সেন্টার খুলেছেন এস কে ঝা নামে এক তরতাজা তরুণ। প্রতি সপ্তাহের শেষে বিনামূল্যের এই
কোচিং কেন্দ্রে সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কয়েকশ শিক্ষিত বেকার যুবক সরকারি, বেসরকারি
চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে আসেন। এস কে ঝা প্রতি সপ্তাহের শেষে একদিন সন্ধ্যে
ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ‘ফ্রি কোচিং’ করে থাকেন। ছাত্রদল রেলওয়ে, ব্যাঙ্ক, সহ
বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার চাকরির প্রশিক্ষণ পায় নীল আকাশের নীচে মুক্ত এই শিক্ষাঙ্গন
থেকে। সম্প্রতি সর্বভারতীয় একটি ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘নবনালন্দার’
তরুণ শিক্ষক জানিয়েছেন, তাঁর টিমে ১৫-১৬ জন শিক্ষক আছেন। পুরো পাঠ্যক্রমে শিক্ষকদের
সাহায্য করার জন্য ১৫০ জন কর্মচারী আছেন। যারা ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্টাডি মেটিরিয়ালস
তৈরি করেন। এবং মক টেস্ট, ওএমআর শীট সম্পর্কে এই কেন্দ্র থেকে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া
হয়।।এছাড়াও চাকরি পেতে গেলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কি ভাবে উত্তর দিতে হয় সেটাও
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখানো হয়।
পাটনার কলেজ ঘাট, কালী ঘাট, কদম ঘাটে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ,
মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে তরুণ চাকরিপ্রাথীরা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে
ভাগ হয়ে কোচিং ক্লাশ করতে আসেন।সপ্তাহে একদিন আলাদা ভাবে পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষা
শেষে তাঁরা পরবর্তী প্রস্তুতির জন্য ঝা স্যারের কোচিং সেন্টার থেকে ‘স্টাডি মেটিরিয়ালস’
নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এস কে ঝার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তথা শিক্ষালয়কে আমাদের মনে হয়েছে,
বর্তমান ভারতের ‘নবনালন্দা’।বৌদ্ধ যুগের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উচ্চারণ।পাটনার
গঙ্গার ঘাটের ছবি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খবর প্রথম আমাদের সামনে আনেন শিল্পপতি হর্ষ
গোয়েঙ্কা। তিনি ৪ এপ্রিল একটি টুইট করেন, ‘’কিডস ইন পাটনা, বিহার আর প্রিপিয়ারিং ফর
কম্পিটিটিভ এক্সামস অন দ্য ব্যাঙ্কস অফ রিভার। ইট ইস এ পিকচার অফ হোপ অ্যান্ড ড্রিমস(সিক)।’’
সপ্তাহের শেষ শনিবার পাটনার গঙ্গার ঘাটে ঝা স্যারের কোচিং কেন্দ্রে
রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড(আরআরবি), নন টেকনিক্যাল পপুলার ক্যাটাগরি(এনটিপিসি)-র পরীক্ষা
নেওয়া হয়। এস কে ঝা জানিয়েছেন, তিনি প্রশ্নপত্র ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন
বিষয়ের বইপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন।প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে আনুমানিক ৩,৫০০
জন ছাত্রছাত্রী ক্লাশ করতে আসেন দূর সূদূর থেকে। রবিবার এই সংখ্যাটা বেড়ে হয় প্রায়
৮,০০০ জনের। রবিবারের ছাছত্রীদের আরআরবির পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ, বি,
সি, ডি মোত চারটে ভাগে ভাগ করে শিক্ষার্থিদের শনিবার সন্ধ্যে ছ’টার সময় ওএমআর শীট দিয়ে
দেওয়া হয়। দেড় ঘণ্টা পরে অর্থাৎ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময় ওএমআর শীট নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের
উত্তর দেওয়ার সূত্র বলে দেওয়া হয়। এর বাইরে নব পর্যায়ের এই শিক্ষা ব্যবস্থায় মাত্র
৩০ বছরের তরুণ শিক্ষক ‘ইউ টিউব’ চ্যানেলে ক্লাশ করেন। তাঁর হিসেবে প্রায় ১০ লাখ ছাত্রছাত্রী
ইউ টিউব চ্যানেলে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে।
নবনালন্দার তরুণ আচার্য আরও জানাচ্ছেন, তিনি ছাত্রছাত্রীদের
পরীক্ষার ফলাফলের ‘স্কোর কার্ড’ অন্যতম সামাজিক মাধ্যম ‘টেলিগ্রাম’ মাধ্যমে প্রকাশ
করেন। তাঁর অভিঞ্জতার মানদণ্ডে তিনি বুঝতে পারেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কোন প্রশ্নটা
ছাত্রদের কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। সেই সূত্র ধরেই তরুণ শিক্ষক প্রশ্নপত্র তৈরি করে উত্তরের
চাবিকাঠিও জানিয়ে দিয়ে থাকেন। এস কে ঝাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তিনি গঙ্গার ঘাট বেছে
নিলেন? উত্তরে তরুণ শিক্ষক জানিয়েছেন, তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এক সঙ্গে এতজন ছাত্রের
প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।জায়গার অপ্রতুলতার জন্যই তিনি এই অভিনব পরিকল্পনা
নিয়েছেন।এত ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কোনও হলের ভাড়া দেওয়া তাঁর পক্ষে
সম্ভব নয়। তাই তিনি গঙ্গার ঘাটকেই বেছে নিয়েছেন। নবনালন্দার এই শিক্ষা কেন্দ্রে বিহারের
ছাপরা, হাজিপুর, বক্সার, রোহটস এবং গয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা
পড়তে আসেন। শনিবার এসে অনেকে গঙ্গার ঘাট, রেল স্টেশন সহ পাটনার বিভিন্ন জায়গায় রাত্রিবাস
করেন। ঝা স্যারের কথায়, তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণির ছাত্রদের সমান
চোখে দেখা হয়।বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে ক্লাশ করে।একুশ শতকের
এই নবনালন্দার অনেক ছাত্রছাত্রীও নিজেদের অভিঞ্জতা উল্লেখ করে একই কথা বলছেন।
সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশ্ন এবং ওনিদার নেট ওয়ার্ক নামক দু’টি সংস্থার
রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দেশের ৫০শতাংশ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি স্কুল কলেজে পড়ে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এসার
শিক্ষা রিপোর্ট(ASER Education Reports 2018)থেকে জানা গেছে, গ্রামভারতের বেসরকারি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৫ শতাংশ পঞ্চম গ্রেডের ছাত্রছাত্রী বেসিক টু গ্রেডের প্যারগ্রাফ
বা পরিচ্ছেদ পড়তে পারে না। আমাদের দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে তুলনা করলে
বলতেই হয় সার্বজনীন শিক্ষা তথা জনশিক্ষা অত্যন্ত জটিলতম অবস্থায় থেকেই গিয়েছে। বিগত
আট বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতাও এর অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমরা
আবারও মনে করতে পারি আম্বেডকারকে। সংবিধানসভা বা কন্সটিটিউশনাল অ্যাসেম্বলিতে বক্তব্য
রাখার সময় তিনি বলেছিলেন, আগামী কাল আমরা নতুন বিশ্বে প্রবেশ করব। যেখানে রাজনৈতিক
ভাবে আমরা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হব। সেই গণতন্ত্রে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের একটি
ভোট থাকবে। কিন্তু সামাজিক ন্যায় বিচারে আমাদের ফারাকটা থেকেই যাবে। কারণ একজন নারী
ভারতে পুরুষের মতো শক্তিশালী নয়। দলিত শ্রেণি বা নীচু জাতের মানুষ উঁচু জাতের মানুষের
মতো শক্তিশালী নয়। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যাগুরুদের মতো শক্তিশালী নয়।
পাটনার গঙ্গার ঘাটের দৃশ্য বা অভিঞ্জতা আমাদের যেমন প্রাচীন
‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’-র শিক্ষা ব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয় পাশাপাশি আম্বেদকরকেও
নতুন করে মনে করিয়ে দিল। ‘মনোপলি’ শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন সরকার পরিচালিত স্কুল, কলেজ
আছে। তেমনি বাজারি অর্থাৎ বেসরকারি একচেটিয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে। তার প্রভাব আমাদের
সমাজে অহরহ আছড়ে পড়ছে। বিশেষঞ্জরা বলছেন, মনোপলি বা ‘একচেটিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা’ সামাজিক
ভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের আর্থিকভাবে সচ্ছল অভিজাত সম্প্রদায়ের
সুযোগ বেশি থাকে। শিক্ষা বিষয়ে বিশেষঞ্জরা আরও বলছেন, সারা দেশে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতা আছে।এই কারণে অনেকে মনে করেন ভারতীয়
শিক্ষা ব্যবস্থাকে সার্বজনীন করার জন্য ‘সিভিল সোসাইটি’ বা নাগরিক সমাজের এগিয়ে আসা
উচিত।আমাদের মনে পড়ছে বিগত শতাব্দীর আশির দশকের কথা। পশ্চিমবঙ্গে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র
তথা নৈশ বিদ্যালয় বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করতেন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। দায়িত্বের সঙ্গে
যে কাজ করছেন নবনালন্দার তরুণ আচার্য এসকে ঝা।আলোকজ্জ্বল আধুনিক ভারতের গুরু-ছাত্রের
পরম্পরা আমাদের দয়া, করুণা নয়।সার্বজনীন শিক্ষার আঙিনায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
Comments
Post a Comment