হাতির গলায় দড়ি নয় জিপিএস যুক্ত রেডিও কলার
দীপেন্দু চৌধুরী
ও তোমরা গেহিলে কি আসিবেন/ মোর মাহুত বন্ধুরে……… বিখ্যাত এই
গানটি একটি গোয়াল পড়িয়া লোকগীতি। অসমীয়া ‘হস্তিব কন্যা’ ছবিতে গানটি গেয়েছিলেন প্রতিমা
বড়ুয়া। পরে পশ্চিমবঙ্গেও গানটি জনপ্রিয় হয়। হাতি পোষ্য হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত
প্রিয়। বিশাল বপু নিয়ে তার চলন এবং ভাষা বোঝে একমাত্র মাহুত বন্ধু।হাতি শিশুদের কাছেও
খুব জনপ্রিয়। কিন্তু লোভী মানব সভ্যতা জঙ্গলের হাতি মেরে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা করছে।
প্রবাদেও আছে মড়া হাতির দাম লাখ টাকা।শিকারি মানুষের হাত থেকে বন্য হাতিকে বাঁচাতে,
এবং বন্য হাতির আক্রমণ থেকে মানুষের মৃত্যু কমাতে আগ্রহী অসম বন দফতর।সেই উদ্দেশ্যে
সম্প্রতি পরীক্ষামূলক ভাবে হাতির গলায় রেডিও কলার লাগান হয়েছে।বিগত বছরের ডিসেম্বর
মাসে পাঁচটি বন্য হাতির গলায় জিপিএস যুক্ত হার পড়ানো হয়েছে।এই কাজ অসম রাজ্য বন দফতর
এবং অসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড(WWF)-ইন্ডিয়ার উদ্যোগে সোনিতপুর জেলায়
প্রথম করা হয়েছে। যৌথ এই উদ্যোগের মূল উদ্দ্যেশ্য, বনবস্তির মানুষ এবং বন্য হাতির মধ্যে
যে সামাজিক সংঘাত আছে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনা।সংঘর্ষপ্রবণ বনবস্তিগুলিকে বাসযোগ্য
করে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন অসম বন দফতরের কর্তারা। হাতি বিশেষঞ্জদের এমনই
অভিমত।সাফল্যের হার কম হলেও এই ধরণের পরীক্ষামূলক কাজ আরও করা হবে বলে জানিয়েছেন, ওই
রাজ্যের বন দফতরের শীর্ষ কর্তারা।
মানুষ এবং বন্য হাতির দলের সঙ্গে সংঘাত কমাতে সত্যিই কি এই
রেডিও কলার কোনও সাহায্যে আসবে? জিপিএস যুক্ত রেডিও কলার আসলে কি? এই বিষয়টা আমাদের
আগে জানতে হবে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে বন্য হাতির গতিবিধির উপর নজরদারি করা সম্ভব
হবে বলে জানাচ্ছেন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষঞ্জরা। আনুমানিক আট কিলোগ্রাম ওজনের এই অলঙ্কার
হাতির গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডব্লুউডব্লুউএফ(WWF)সূত্রে জানা যাচ্ছে, একটি পূর্ণ
বয়স্ক হাতিকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে এই রেডিও কলার। হাতির গতিবিধি যেমন হাতির বনের
ভিতরে ঘোরা, ছুটে যাওয়া, খাবার খাওয়া, জল খাওয়া প্রভৃতি বিষয় নজরে রাখবে প্রযুক্তি
ও হস্তি বিশেষঞ্জদের একটি দল।
অসম বন্যপ্রাণ দফতরের মুখ্য আধিকারিক এম কে যাদব সংবাদ সংস্থাকে
দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, রেডিও কলারটি দুই ভাঁজের হয়। তাঁর কথায় জিপিএসের মাধ্যমে
পাওয়া তথ্য বন দফতরকে বুঝতে সাহায্য করবে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয়ে। যেমন বনবস্তি সহ জঙ্গলে
বন্যহাতির গতিবিধি এবং ওদের দৈনন্দিন জীবনশৈলী। এই তথ্য সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় মানুষ এবং
বন্য হাতির মধ্যে যে সংঘাত সেটা বুঝতে অনেকটা সাহায্য করবে। ডব্লুউডব্লুউএফ-এর তরফে
হীতেন বড়ুয়া জানাচ্ছেন, এই প্রযুক্তির সাহায্যে বন আধিকারিকরা জানতে পারবেন, কোন করিডর
দলবদ্ধ হাতির কাছে নিরাপদ। যদি সেই করিডরে বনবস্তি মানুষের বসবাস বেশি হয় তবে হাতি
এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ এবং বন্য হাতির মধ্যে সংঘাত বন্ধ করতে
হবে।প্রয়োজনে হাতির প্রাণ বাঁচাতে অন্য করিডর তৈরি করে দিতে হবে। কারণ বনবস্তির নতুন
বাসিন্দাদের সম্পর্কে অনেক সময় যথেষ্ট তথ্য বন দফতরের কাছে থাকে না।
২০২০ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক
অসমের সনিতপুর ও বিশ্বনাথ জেলার পাঁচটি হাতির গলায় রেডিও কলার লাগানোর অনুমতি দেয়। এই অনুমতির
সঙ্গে কয়েকটি প্রাক শর্ত ছিল যেমন, কলার পড়ানোর পরে হাতির শারীরিক অবস্থা কেমন থাকে
সেদিকে বন কর্মীদের নজর দিতে হবে। বন বস্তিতে চলাফেরার সময় হাতির আতঙ্ক কতটা তাঁর রিপোর্ট
কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রককে নিয়মিত জানাতে হবে। অসম বন দফতর সূত্রে খবর, আগামী ভবিষ্যতে
আরও ১১ টি হাতিকে রেডিও কলার পড়ানো হবে। সংঘাতপ্রবণ বন বস্তিতে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত
এমন ১১টি হাতিকে অসম বন দফতর চিহ্নিত করেছে। এই সব এলাকাগুলি হচ্ছে, সনিতপুর, গোলাঘাট,
নগাঁও, গোয়ালপাড়া, উদলগুড়ি এবং অন্যান্য অঞ্চল। যদিও এই কাজ শেষ করার নির্দিষ্ট সময়
সীমা ঠিক করা হয়নি। প্রযুক্তি বিশেষঞ্জদের অভিমত রেডিও কলার হাতিকে পড়ানো সময় সাপেক্ষ
কাজ। এবং অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। বন দফতরের প্রথম কাজই হচ্ছে, নির্দিষ্ট হাতিকে চিহ্নিত
করা।যে হাতির গলায় নিরাপত্তার এই হার পড়ানো হবে তাকে। চিহ্নিত করতে বেশ কয়েকদিন সময়
লাগে। এবং চিহ্নিত হাতিকে একা পাওয়ার অপেক্ষায় বনকর্মীদের থাকতে হয়। খুব কঠিন সময় হচ্ছে,
যখন হাতিকে কলার পড়ানো হয় সেই সময়টা। কারণ বন দফতরের কাছে হেলিকপ্টার নেই। বা হাতিকে
অবশ করার মতো অভিজাত ইকুইপমেন্টও নেই বন দফতরের কাছে। তাই অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই বন দফতরের
কর্মীদের এই কাজ করতে হয়। পায়ে হেঁটে বনকর্মীদের গভীর জঙ্গলে যেতে হয় হাতিকে চিহ্নিত
করতে এবং রেডিও কলার পড়ানোর জন্য। উভয়ের দিক থেকে এই কাজ ঝুকির। হাতি এবং বনকর্মীদের
মধ্যে আত্মরক্ষার সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাতির মৃত্যুও হতে পারে।
আবার হাতির আক্রমণে বনকর্মীদের আহত বা মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত থেকে যায়।যদিও বন দফতরের
কাছে অত্যন্ত দক্ষ কর্মীরা আছেন এই কাজ সুচারুভাবে করার জন্য। অসম রাজ্য বন দফতর কেন্দ্রীয়
পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই হাতিকে রেডিও কলার পড়ানোর কাজ শুরু
করে।
বন দফতরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, রেডিও কলার নামক হাতির অলঙ্কারের
সব যন্ত্রাংশ ভারতের বাজারে সহজ লভ্য নয়।রেডিও কলার এবং হাতিকে অঞ্জান করার ওষুধও বিদেশ
থেকে আনতে হয়। এবং বিদেশ থেকে রেডিও কলার, ওষুধ আনার খরচ যথেষ্ট ব্যায় সাপেক্ষ। বন
দফতরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, রেডিও কলার পড়ানোর জন্য হাতির শারীরিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত
হতে পারে। তাই কম বয়সী হাতি নয় পূর্ণ বয়স্ক হাতিকে চিহ্নিত করা হয়। তাদের দৈহিক বৃদ্ধির
আর কোনও প্রয়োজন থাকে না। সাধারণত নদী এবং পাহাড় অধ্যুষিত অঞ্চলের হাতিকে বেছে নেওয়া
হয়, রেডিও কলার পড়ানোর জন্য। ব্রহ্মপুত্র অঞ্চলও এর মধ্যে আছে। অসমের প্রাকৃতিক বৈচিত্রকে
মাথায় রেখেই বন্য হাতি বেছে নিতে হয়।বন সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করে গুয়াহাটির আরণ্যক নামে
একটি অসরকারি সংস্থা। এই সংস্থার আধিকারিক বিভূতি লাহকার জানাচ্ছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
হাতি কলার গলায় রাখতে চায় না। কৃত্রিম এই অলংকার নিজেদের জীবনশৈলীর সঙ্গে মেলে না।
তাই হাতি এই যন্ত্র খুলে ফেলতে চায়। খুব বেশী হলে ছ’মাস রেডিও কলার একটি হাতির গলায়
থাকে।
Comments
Post a Comment