রাস্তায় বসবেন না সংসদ ঘেরাও করতে চান কৃষকেরা






দীপেন্দু চৌধুরী

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এই সত্যতা আমাদের মানতেই হবে যে, ইংল্যান্ড বা পশ্চিম ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পরেই শিল্পায়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। একইরকম ভাবে অন্যান্য কৃষিভিত্তিক দেশেও শিল্পায়ন একটি ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’ হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে একুশ শতকের প্রথম দশকে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী শিল্পগোষ্ঠী শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই সময় শিল্পপতিদের সুযোগ করে দিতে ‘সেজ’(SEZ)নামে এক প্রকল্পও এনেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেজ বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিল ছোট কৃষকের জমি আত্মসাৎ করারই এক ধরনের জমিগ্রাস প্রকল্প।সেই পর্বে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে বিপুল ক্ষোভ-বিক্ষোভ হয়েছিল। ‘সেজ’ প্রকল্পের নামে শিল্পায়নের জন্য জমি জোগাড়ের সামাজিক দায়বদ্ধতার দায় পুরোটাই চাপানো হয়েছিল কৃষিজীবী ভারতবাসীর উপর। যাঁদের অধিকাংশই ছিল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে দুর্বল। কৃষি ক্ষেত্রের দুর্বল মানুষগুলি এই প্রকপ্ল মেনে নিতে পারেননি।তারা এই প্রকল্প একরকম প্রত্যহার করেছিল। নিজেদের লাভ বা ক্ষতি তারা বোঝেন বলেই সরকারের আনা এই জমিগ্রাস সেজ প্রকল্প ভারতীয় কৃষকরা মেনে নিতে পারেনি।ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থে আনা এই শিল্পায়ন প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।

পাশাপাশি বহু কৃষক হারিয়েছেন তাঁদের জমি। এর ওপর বাড়তি বোঝা হিসেবে লাগাতর বেড়েছে কৃষির উপকরণের দাম। ফলে একদিকে চাশের খরচ বেড়েছে। এ ভাবে কৃষককে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল খাদের মুখে। সেখান থেকে আন্দোলন করে তাঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবার তাই এমএসপির দাবিতে নতুন করে সরব হবেন কৃষকরা।      

দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলি সেজ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যর্থ বলেই কি সরকার বিতর্কিত তিন কৃষি আইন এনেছিল? নতুন আঙ্গিকে কৃষকদের জমিগ্রাস করার উদ্দেশ্যে?  গত এক বছর ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে ভারতীয় কৃষকরা এই আইন প্রত্যাহার করতে মোদী সরকারকে বাধ্য করেছে।দিল্লি-হরিয়ানা সীমানার সিঙ্ঘুতে এই আন্দোলন করেছিল ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’ নামে সারা ভারতের কৃষকদের একটি যৌথমঞ্চ। ঐতিহাসিক এই আন্দোলন প্রত্যাহারের পরে কিসান মোর্চার অন্যতম নেতা গুরনাম সিংহ চারুনি বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার সবথেকে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচিত নরেন্দ্র মোদীকে কৃষকরা ঝুঁকতে বাধ্য করেছেন।‘’

সংযুক্ত কিসান মোর্চার অন্যতম শরিক পঞ্জাবের ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন(চারুনি)র শীর্ষ নেতা গুরনাম সিংহ চারুনি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন। রাজ্যে তাঁর নতুন সংগঠনের কাজে। একান্ত সাক্ষাৎকারে কৃষক নেতা চারুনি প্রথমেই জানালেন, মানুষ ভোট দিতে পারলে সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি চার রাজ্যে সরকার গঠন করতে পারত না।সরকারি কর্মীদের ভোট দেখলে এই যুক্তি কতটা সত্য সেটা বোঝা যাবে। যত দিন ইভিএম থাকবে তত দিন এই রকম ভোট হবে। এটা লোকতন্ত্রের হত্যা। প্রবীন কৃষক নেতা ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন সদ্য হয়ে যাওয়া উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভার ভোট স্বচ্ছ ভাবে হয়নি। পঞ্জাবের তথা সর্বভারতীয় কৃষক নেতা গুরনাম সিংহ চারুনির কাছে আমাদের প্রথম প্রথম প্রশ্ন ছিল, পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষক আন্দোলন কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারল? আরও প্রশ্ন ছিল কৃষক আন্দোলন মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কালা কানুন প্রত্যাহার, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য তথা এমএসপি(MSP)-র গ্যারান্টির দাবিতে উত্তর ভারতের কৃষকরা আন্দোলন করলেন। পনেরো মাস ধরে টানা এই আন্দোলন চলেছে। পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের কৃষকরা এই আন্দোলনে ছিলেন। তবুও উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড রাজ্যে কৃষক আন্দোলনের প্রভাব পড়লনা কেন? বিকেইউ(চারুনি)-র নেতা জানিয়েছেন, মোদী সরকারের আনা তিন কালা কানুন প্রত্যহারের আন্দোলনে ৭০০ কৃষক ‘কুরবানী’ দিয়েছেন তবু আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল।লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে, গত ১৫ বছর ধরে ভারতীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। গত ১৫ বছরে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য(এমএসপি)পুরনো আইনে দেওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় কৃষকরা এই মূল্য পায়নি। এমএসপি থেকে যে দাম কৃষকদের পাওয়ার কথা ছিল। অথচ গত ১৫ বছরে ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা তারা কম পেয়েছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা(WTO)-র চাপানো শর্ত মানতে গিয়ে।কর্পোরেট লবির স্বার্থে এমএসপি না দেওয়ার জন্যই তিন কালা কানুন আনা হয়েছিল।

কৃষক নেতা চারুনি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের কথা উল্লেখ করেন। বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সময় কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা এক পা পিছিয়ে এলেও পরে দু’পা এগিয়ে যাব।’ কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর আত্মম্ভরী বক্তব্যের প্রতিবাদ করে চারুনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এমএসপি দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। সরকার বাহাদুর যদি নতুন মোড়কে কৃষি ক্ষেত্রে কালা কানুন আনতে চায় ভারতীয় কৃষকরা চুপ করে বসে থাকবে না। তোমর সাহেবকে চেতাবনি দিয়ে জানিয়ে দিতে চাই, কৃষকরা আর দিল্লি সীমানায় বসবে না।শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে এবার সংসদ ঘেরাও করবে।কৃষকেরা স্বাভিমানি।আদানী গম মজুত করার জন্য গোডাউন বানাচ্ছে। হরিয়ানায় এই গোডাউন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। আদানী এই গোডাউন তৈরি করলে ‘মান্ডি ব্যবস্থা’ ভেঙ্গে পড়বে।কৃষকরা কি চুপ করে বসে থাকবে?  

সেন্টার ফর ডেভলপিং সোসাইটির ‘লোকনীতি’ বিভাগের নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘ দিন অকালি দল, কংগ্রেস শাসন সামাজিক-আর্থিক দিক দিয়ে পঞ্জাবকে পিছিয়ে দিয়েছে। এই বিষয়ে আমরা পঞ্জাবের কৃষক নেতার অভিমত জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানান, পঞ্জাব আন্তর্জাতিক সীমান্তঘেঁষা রাজ্য।পঞ্জাবে একদা উগ্রবাদী প্রভাব ছিল।এই উগ্রপন্থাই পঞ্জাবকে পিছিয়ে দিয়েছে। বিভ্রান্ত যুব সমাজকে মূল স্রোতে আনার জন্য আর্থিক উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল।রাজ্যের সামাজিক ও প্রশাসনিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য দরকার ছিল বিপুল অর্থের।পঞ্জাবে শিল্প হয়নি। রাজ্যের কর্মসংস্থানও গত কয়েক দশকে তেমন ভাবে বাড়েনি। কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস সরকার ছিল সেই সময় রাজ্যে ক্ষমতায় অকালি দল ছিল। রাজনৈতিক কারণেই কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার পঞ্জাবকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেনি। একইরকম ভাবে রাজ্যে যখন কংগ্রেস সরকার এল কেন্দ্রে তখন বিজেপি সরকার। মোদী সরকারও রাজ্যের আর্থ-সামাজিক বিকাশের জন্য কিছু করেনি। রাজ্যের যুব সম্প্রদায় বিভ্রান্ত ছিল। কৃষক সমাজও কেন্দ্র রাজ্যের শাসক দলের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এই বিষয়ান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষক নেতা চারুনির কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল আপকে কৃষিজীবী ও অকৃষিজীবী দুই সম্প্রদায়ই ভোট দিয়েছে। এর কারণ কী?কৃষক নেতার ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, পঞ্জাবের ৬০ শতাংশ কৃষক আপকে ভোট দিয়েছে। আপ গ্রামের কৃষকদের থেকে বেশি ভোট পেয়েছে।শহরের ভোট বিজেপি পেয়েছে।অতীত অভিঞ্জতা থেকে কংগ্রেস ও অকালি দলের উপর কৃষকদের ভরসা ছিল না।

একান্ত আলাপচারিতায় আরও কয়েকটি বিষয় উঠে আসে যেমন, বৃহৎ চাষি ভারতে নেই। পঞ্জাবে ১৮ একর বা ৭ হেক্টর জমি সিলিং ব্যবস্থায় রাখা যায়। হরিয়ানাতেও ৭ হেক্টরের বেশি জমি কৃষকরা রাখতে পারে না। উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৫ হেক্টর জমির মালিকানা কৃষকদের থাকে। এই প্রসঙ্গে গুরনাম সিংহ চারুনির অভিমত ভারতে তেমন ভাবে বৃহৎ চাষি নেই। অথচ মোদী সরকার কৃষক আন্দোলন ভাঙ্গার জন্য প্রচার করেছিল সংযুক্ত কৃষক মোর্চার আন্দোলন বৃহৎ চাষিদের আন্দোলন। এটা সম্পূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক কৌশল। ভারতীয় কৃষকদের মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্য পরিকল্পিতভাবে এই কথা বলা হয়েছে। যে সব কৃষকদের কাছে ৭ হেক্টর জমি ছিল তাদের কাছ থেকে সেই জমিও প্রশাসনিক কৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সরকার তৈল বীজ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে গমের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য পঞ্জাবের কৃষকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।‘মান্ডি’ বা গ্রামীণ বাজার ভেঙ্গে সরকার কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ করাতে চাইছে।লক্ষ করলে দেখা যাবে, ২০২২-২৩ বাজেটে কৃষি খাতেনতুন বরাদ্দ নেই।উল্টোদিকে দেখলে স্পষ্ট হবে, কৃষিবিমার নামে কৃষকদের টাকা লুঠ করা হচ্ছে।৫০ হাজার কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয়েছিল কৃষিবিমার  কথা বলে।অথচ বিমার যে ‘ক্লেম বা দাবি করেছিলেন হরিয়ানার কৃষকেরা’, দু’বছর হয়ে গেলেও যে সেই টাকা আজও তারা পাননি।

২৭-২৮ মার্চ নিজের সংগঠন ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন(চারুনি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার কাজে সর্বভারতীয় সভাপতি গুরনাম সিংহ চারুনি রাজ্যে এসেছিলেন।২৮ মার্চ কলকাতা প্রেসক্লাবে গুরনাম সিংহ জানান, ফসলের উৎপাদন ব্যায়ের দ্বিগুণ, তিনগুণ নয়, মাত্র দেড়গুণ দামে যদি সরকার তাদের উৎপাদিত ফসল কিনে নেয় তাহলেই কৃষকদের সমস্যা অনেকটা কমে যাবে। পাশাপাশি সমবায় পদ্ধতিতে চাষ করতে পারলে অর্থাভাবে ও অনাহারে কৃষক মৃত্যুর হারও কমানো যাবে। কৃষক নেতা চারুনি আরও প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষিপ্রধান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির প্রধান মেরুদন্ড এই রাজ্যের কৃষক। তাই কৃষকদের যে সম্মান পাওয়া উচিত তা এই রাজ্যের কৃষকরা পাবেন না কেন? তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারের উচিত কৃষকের চাষের মোট খরচের উপর আরও ৫০% লাভ অর্থাৎ ন্যুনতম সহায়ক মূল্য(MSP)দিয়ে তার উৎপাদিত পুরো ফসল কিনে নেওয়া।তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলার অর্থনীতি পালতে যাবে। এবং পশ্চিমবঙ্গ কৃষিক্ষেত্রে ভারতের উন্নত রাজ্যগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠবে।

বিকেইউ(চারুনি)গোষ্ঠীর সর্বভারতীয় নেতা গুরনাম সিংহ চারুনির বাংলা সফর এবং তাঁর দাবি সম্পর্কে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী, দলের যে কোন রাজ্যে সংগঠন করার অধিকার আছে।পশ্চিমবঙ্গেও সবাইকে স্বাগত। তিনি দাবি করেন, রাজ্যের কৃষকরা ভালো আছেন। তাঁরা তাঁদের ফসল উৎপাদনের জন্য সরকারের কাছ থেকে সবরকমের সাহায্য পায়। আবার রাজ্য সরকার কৃষক পেনশন প্রকল্পও চালু করেছে                                                                                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?