আমরা খুঁজছি সভ্যতার মানবিক করিডর




দীপেন্দু চৌধুরী

শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান-

বলব, ‘বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সভ্যতা! গত কয়েক দশকের অভিঞ্জতায় সমাজ সচেতন মানুষ যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত ক্ষমতা, গোষ্ঠী কেন্দ্রিক ক্ষমতা দখলের আদিম নেশায় মানবসভ্যতা আজও পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে।ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কতটা মর্মান্তিক সত্য হতে পারে এই তথ্য? খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দাবি যেখানে চিরন্তন, সেই অবস্থান থেকে দেখলেও নিষ্ঠুর বিশ্বের ছবি আমরা দেখতে পাব।বর্তমান সময়েও সারা পৃথিবীতে ৮ কোটি মানুষ ঘুমোতে যান খালি পেটে।প্রতি তুলনায় একটি যুদ্ধ সভ্যতার কাছে কতটা ভয়াবহতা আনতে পারে? রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে দু’সপ্তাহের বেশি। কত দিন চলবে তা আমাদের জানা নেই।ইউক্রেনের অভিযোগ ছিল, সুমির আবাসিক অঞ্চলে ৫০০ কেজি ওজনের একটি বোমা ফেলেছে রুশ বিমানবাহিনী।

বোমার আঘাতে দু’টি শিশু-সহ অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সমানে সমানে হোক অথবা অসম যুদ্ধ।এই যুদ্ধে কৌশলী বাকচাতুরতার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে যুদ্ধবাজ দু’টি দেশের রাষ্ট্রনায়করা। ইউক্রেন দাবি করেছে, এই যুদ্ধে রাশিয়ার ১১ হাজার সেনার মৃত্যু হয়েছে।রাশিয়ার পাল্টা দাবি, তাঁদের মাত্র পাঁচশো সৈনিকের এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে।মৃত্যু মিছিলে শিশু সহ সাধারণ নাগরিকের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। গত দু’সপ্তাহের বেশি সময়ে ইউক্রেনে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে তার সঠিক কোনও হিসেব নেই।৩ মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেন সরকার দাবি করেছিল ২ হাজারের বেশি সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।একটি সূত্র বলছে, ২০২০ সালের জনগণনার তালিকা অনুযায়ী ইউক্রেনের জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা কমপক্ষে ৪০ লক্ষ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে।শেষ পাওয়া খবর যুদ্ধবাজ দুই দেশের যুদ্ধে ইতিমধ্যে ১৩৬টি ইউক্রেনীয় শিশুর প্রাণ গিয়েছে।সিরিয়া যুদ্ধের মতই প্রতিবেশি রাষ্ট্রে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন ইউক্রেনীয়রা।পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন ১০ লক্ষ মানুষ।ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইউ)জানিয়েছে, রোমানিয়ায় দেশছেড়ে চলে আসা ইউক্রেনীয়দের জন্য একটি আশ্রয়শিবির তৈরি করা হবে।মানবিক আশ্রয়শিবিরের কি ছবি হতে পারে আমরা জানি। আমরা খুঁজছি সভ্যতার মানবিক করিডর।

২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপের বিভিন্ন প্রথম সারির দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল একটি ছবি। তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা আলান নামে একটি শিশুর মৃতদেহের ছবি। শিরোনামে একটি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ইউরোপ, এর পরেও কি তুমি উদ্বাস্তুদের হাহাকার শুনতে পাবে না? ১৯৭২ সালের ৮ জুনের আরও একটি মর্মান্তিক ছবির কথা  মনে পড়ছে। ফাঁকা রাস্তা সামনে ছুটে আসছে উদুম গায়ের ন বছরের কিম ফুক।কিমের পিছনের আকাশে নাপান বোমার চাপ চাপ ধোঁয়া।কিমের পিছনের অংশ ঝলসে গিয়েছিল।আরও একটি ছবি আমরা দেখেছি। ১৯৯৩ সালে।  ছবিটির শিরোনাম ছিল ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’। সুদানে ছবিটি তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টার। সুদান সহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে দুর্ভিক্ষ-মড়ক হয়েছিল তারই এক করুণ দলিল বলা যায় এই ছবিকে।খরা বিদ্ধস্ত সুদানে একটি মৃতপ্রায় কঙ্কালসার শিশুকন্যা ফ্যাকাসে চোখ নিয়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছে একটি শকুন। শিশুটির মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে শকুনটি। উল্টোদিকে অপেক্ষায় ছিলেন মানবতাবাদী চিত্র সাংবাদিক কেভিন। কুড়ি মিনিট অত্যাধুনিক ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষায় বসে ছিলেন কেভিন। শকুনটি শিশু কন্যাটির কাছাকাছি আসার পর কেভিনের ক্যামেরার লেন্স গদ্যের দলিল রচনা করে।

আমরা নিষ্ঠুর সভ্যতার প্রলম্বিত উচ্চারণে কেঁপে উঠি। সারা বিশ্ব কেঁপে কেঁপে যায়। সভ্যতা কত নিষ্ঠুর, কতো কঠোর কঠিন হতে পারে।মানব সভ্যতা আজও কাঁদছে।অভিশপ্ত একুশ শতকেও আমরা যুদ্ধের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারছি।সম্প্রতি শীতকালীন প্যারালিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেজিংয়ের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক্ কমিটির প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু পার্সন্স বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘’এই মুহূর্তে বিশ্বে যা চলছে, তাতে দেখে আমি আতঙ্কিত। একুশ শতক আলোচনা ও কূটনীতির সময়। যুদ্ধ আর ঘৃণার সময় নয় এটা।‘’ যুদ্ধ কারা করছে? কেন করছে? হয়ত আমরা অনেকেই গোদা বাংলায় বলব যুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদ আর প্রত্যক্ষগোচর নয়। আগের উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা পাওয়ায় আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। বুর্জোয়া তত্বে ও রাজনীতিকদের প্রচারে আজ সাম্রাজ্যবাদের কোন অস্তিত্ব নেই।সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নতুন ভাষায় আক্রমণ করছে।সাম্রাজ্যবাদী তথা ফ্যাসীবাদী শক্তি নিজেদের পুতুল সরকার বসিয়ে ভিন দেশের সম্পদ ও ভু-রাজনৈতিক দখল নিচ্ছে।

মানবতা-ধ্বংসকারী ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আজও আমরা চুপ করে বসে থাকব? মনে পড়ছে ১৯৩৬ সালের স্পেনের গৃহ যুদ্ধের কথা।‘লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’-র প্রচার এবং প্রসারের দায়িত্ব নিয়ে রমাঁ রলাঁ এগিয়ে আসেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে বিস্তৃত করতে ভারতে ফৈজপুর কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের কাছেও আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। স্পেন সম্পর্কিত রমাঁ রলাঁর আবেদনপত্রটি আমাদের অবিভক্ত বাংলাতেও পাঠান হয়েছিল।ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘প্রবাসী’ এবং ‘মডার্ন রিভ্যুর’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও এই চিঠি পাঠান হয়েছিল।কলকাতায় বাংলার কমিউনিস্ট, সোশ্যাললিস্ট এবং তৎকালীন প্রথমসারির বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিবিরোধী সঙ্ঘ’ নামে কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটি তৈরির কিছুদিন পরেই ‘লিগ এগেনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’-এর একটি সর্বভারতীয় কমিটি গড়ে ওঠে। সেই কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন জওহরলাল নেহরু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি আবেদনপত্রে রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষর করে লিখেছিলেন, ‘’আদিম প্রকৃতির জীবেরা মানুষের রক্তপাতের অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী।‘নৈতিক সচেতনতার অপরিপক্কতা’ থেকেই এধরণের মানসিকতা জন্ম নেয়। কিন্তু ‘সংস্কৃতিবান’ মানুষদের মধ্যেও যখন ‘অনুরূপ ব্যাপার’ লক্ষ্য করা যায় তখন বোঝা যায় পাশব প্রবৃত্তির কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেছে…………’’।                                 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?