‘অমৃতকাল’-র আলো থেকে বঞ্চিত গ্রামভারত
দীপেন্দু চৌধুরী
এক সপ্তাহ আগের কথা। দক্ষিণ কলকাতার শহরতলি অঞ্চলের একটি সেলুনের
মালিক কথাটা বলছিলেন। করোনাকালে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেলুন ব্যবসার। বছর পয়াতল্লিশের
মনোজিত (নাম পরিবর্তিত)-দের পারবারিক ব্যবসা। তিন পুরুষের সেলুনের ব্যবসা। তার কথায়,
করোনাআবহে লকডাউনের জন্য বিউটি পার্লার, সেলুন ব্যবসার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। সেলুনের
অনেক ক্ষৌরকর্মী বংশগত পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অতিমারির সময়ে।
লকডাউন বা আংশিক লকডাউন উঠে যেতেই মানুষ রুটি-রুজির সন্ধানে
নতুন করে নেমে পড়েছে।সম্প্রতি গ্রামাঞ্চলের সঙ্কুচিত কাজের বাজার এবং সারা দেশের বেকার
বাড়ার বিষয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট আমাদের সামনে এসেছে।‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান
ইকোনমি’(সিএমআইই)-র সমীক্ষা রিপোর্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি
মাসে দেশে বেকারত্বের হার গত ছ’মাসের মধ্যে সর্বচ্চো। এই সমীক্ষা রিপোর্ট নির্দিষ্ট
ভাবে উল্লেখ করেছে, গ্রামাঞ্চলের কাজের বাজারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। উপদেষ্টা সংস্থার
সমীক্ষকদের পর্যবেক্ষণ, করোনা সংক্রান্ত বিধি শিথিল হতেই অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে
শুরু করেছে। সেই কারণেই কাজের বাজারে নতুন উদ্যোমে চাকরি খুঁজতে নেমে পড়েছেন অনেক বেশি
মানুষ।গ্রামাঞ্চলে কাজ পাচ্ছেন না স্বল্প শিক্ষিত থেকে শিক্ষিত শ্রেণির অনেকেই। অদক্ষ
শ্রমিকদেরও কাজ নেই গ্রামাঞ্চলে।করোনা আবহের আগে বা পরে গ্রামভারতে শিল্পের বিকাশ তেমন
ভাবে হয়নি বললেই চলে।বিগত কয়েক বছর বিশেষত মোদীর শাসনকালে শিল্পপতিরা নতুন করে বিনিয়োগ
করেছেন না।এই অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যায়।বিশেষ করে ভারতের মতো শিল্প ক্ষেত্রে সম্ভবনাময়
উন্নয়নশীল দেশের গ্রামাঞ্চলে। এই সমস্যার দোসর হয়েছে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কেন্দ্রের
বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া। গত বছরের বাজেটে ১০০ দিনের কাজ বা গ্রামীণ রোজগার যোজনা প্রকল্পে
বরাদ্দ ছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের
বাজেটে এই খাতে কমিয়ে করা হয়েছে, ৭৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া
শ্রমিকের দল নতুন করে বিপাকের মধ্যে পড়েছেন।করোনাকালে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে ১০০
দিনের কাজের উপরেই বেশি ভরসা করেছিলেন।পূর্ব অভিঞ্জতার মানদণ্ডে ঘরের খেয়ে গতর খাটিয়ে
সন্তান সহ পরিবারের দায়িত্ব পালন করার আশায়। কিন্তু ১০০ দিনের সরকারি ‘কাজবাবু’-রা
নিয়মিত কাজ দিতে পারছেন না।
আলোচ্য নিবন্ধে উল্লেখিত সিএমআইই-র পরিসংখ্যান থেকে কিছু ডেটা
তুলে দেওয়া যাক। গত মাসে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১০%। এই হিসেব বা হারকে গত ছ’মাসে
সর্বোচ্চ বলে দাবি করা হয়েছে সমীক্ষা রিপোর্টে।ওই মাসেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রাম
এবং শহরে ওই হার ছিল যথাক্রমে ৮.৩৫% ও ৭.৫৫%। সমীক্ষকরা আরও দাবি করছেন, শহরাঞ্চলে
গত কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায় বেকারত্ব কিছুটা কমলেও, গ্রামভারতে সেই হার বেড়েছে উল্লম্ফনের
মতো। যেমন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৯.০৮%,
শহরে ছিল ৭.৩৯%, আর সারা দেশে ছিল ৮.৫৫% ।ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে
বেকারত্বের হার ছিল ১১.১১%। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে বেকারত্বের হার এই রকম
ছিল, গ্রামে ৬.০৪%, শহরে ৮.৬৪%, সারা দেশের হার ছিল ৬.৮৬%।প্রাসঙ্গিক ভাবেই উল্লেখ
করছি, দেশের বেকারত্ব গত এক বছরে ২.৪% থেকে বেড়ে ১০.৩% হয়েছে। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেস সারা দেশে ওই দিনটি
প্রতীকী ভাবে ‘জাতীয় বেকার দিবস’ হিসেবে পালন করে।সমীক্ষক সংস্থা সিএমআইই-র তরফে মহেশ
ব্যাস সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিককালে এই বিষয়ে যতগুলি সমীক্ষা হয়েছে, সেই
সব সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, কাজের বাজারে যারা কাজ খুঁজতে এসেছেন তাঁদের মধ্যে
৭৭ শতাংশের বয়স ১৫-২৪ বছর। তিনি বলছেন, এঁদের বড় অংশই স্কুল কলেজের ছাত্র। বেকারদের
মধ্যে ১৫% গৃহবধূ।
সিএমআইই-র কর্তা মহেশবাবুর কথা থেকে আরও জানা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলে
সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের কিছুটা উন্নতি হয়ত হয়েছে। কিন্তু গ্রামের অবস্থা তুলনামূলক
ভাবে আরও খারাপ হয়েছে।বাজেটে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া যেমন একটা কারণ, পাশাপাশি
অসংগঠিত ক্ষেত্র ও ছোট-মাঝারি শিল্প এখনও করোনাগ্রাসে।সাম্প্রতিক আরও একটি রিপোর্ট
আমাদের সামনে এসেছে। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বেকারত্বের
হার ছিল গ্রামে ১১.১১%, শহরে ৭.৭৫% সারা দেশে ১০.৬%, ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্রামের চিত্র ছিল
৯.৬১%, শহরে ৭.৭৫% এবং সারা দেশে ১০.০৬%, ২০ ফেব্রুয়ারি এই হার গ্রামে ৭.৩০%, শহরে
৭.৭০%, সারা দেশের হার ছিল ৭.৪২%, ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামের হার ছিল ৯.০৮%, শহরে ৭.৩৯%,
সমস্ত দেশের হার ছিল ৮.৫৫%, ৬ মার্চ সপ্তাহ শেষে গ্রামের হার ছিল ৬.৩৪%, শহরে ৭.৩৪%
এবং সারা দেশের হার ছিল ৬.৬৫%, ১৩ মার্চ আমরা পাচ্ছি, গ্রামে ৬.৪৫%, শহর ১০.৩৬% এবং
দেশে ছিল ৭.৭৩%। সিএমআইই ১৪ মার্চ জানিয়েছে করোনার তৃতীয় দফায় ভারতে পর্যটনে কাজ হারিয়েছে
সওয়া দু’কোটি মানুষ।
করোনা অতিমারির আগে থেকেই ক্ষুদ্র, ছোট-মাঝারি শিল্প(এসএমই)ধুঁকছিল।সাম্প্রতিক
সময়ে কোভিড-১৯ এই শিল্পকে সব থেকে বেশি ধাক্কা দিয়েছে। গ্রামভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা
যে ভালো নয় এই কথা কয়েক মাস আগে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যয়। লেখার শুরুতে আমরা যে সেলুনের মালিকের কথা উল্লেখ করলাম,
সেই বিষয়ে একই মত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সহ আরও অনেকে।অর্থনীতিবিদদের অভিমত,
ভারতে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে সরকারি ব্যয় বরাদ্দের অঙ্ক ছিল সেই বছরের জিডিপি-র ১৭.৮
শতাংশ। পরের বছর করোনা সময়কালে যখন মানুষের আয় দ্রুত নিম্নমুখী সেই বছরে জিডিপি-র অঙ্ক
হিসেবে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ আরও কমে হয়েছিল ১৬.২ শতাংশ।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর খবরে প্রকাশ ‘দরিদ্র’ তো অবশ্যই সঙ্গে
আছে ভারত এখন এক ‘চরম অসাম্যের দেশ’।‘বিশ্ব অসাম্য রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পেরেছি,
ভারতের নীচের তলার মানুষের অর্ধেকের হাতে দেশের সম্পদের প্রায় কিছুই নেই। সেখানে দেশের
মোট আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগই গিয়েছে দেশের উপরের তলার এক শতাংশের মানুষের হাতে। রিপোর্ট
থেকে আরও জানা যাচ্ছে, নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষকে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ নিয়েই
ম্লান মুখে সংসারের বোঝা বইতে হচ্ছে।প্যারিস স্কুল অব ইকনমিকস-র শাখা ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি
ল্যাব’–এর রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।করোনাকালে ১৪২ জন ধনী ভারতীয়ের সম্পদ
বেড়েছে ২৩ লক্ষ কোটি থেকে ৫৩ লক্ষ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন
২০২২-২০২৩ আর্থিক বছরের বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ করেছেন ৩৯.৪৪ লাখ কোটি টাকা। প্রাপ্ত হিসেব
থেকে দেশের ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য বুঝতে আমাদের সাহায্য করছে। বাজেটে ব্যায় বরাদ্দের
টাকার থেকে ১৪২ জন উচ্চবিত্তের কাছে সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি।
ভারত সম্পর্কে ওই অসাম্য রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারছি, ক্রয়ক্ষমতার
সঙ্গে তুলনায় ভারতীয় নাগরিকদের মাথাপিছু গড় আয় বছরে ২ লক্ষ ৪ হাজার ২০০ টাকা। উল্টোদিকে
আয়ের দিক থেকে নীচের সারির অর্ধেক মানুষের গড় আয় মাত্র ৫৩ হাজার ৬১০ টাকা। অসাম্য রিপোর্টে
আরও বলা হয়েছে, উপরের শ্রেণির ১০ শতাংশ মানুষের আয় সাধারণ মানুষের আয়ের তুলনায় প্রায়
২০ গুণ। ১১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫২০ টাকা। এই তথ্য প্রকাশের পরে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে
উপদেষ্টা সংস্থা অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, করোনার দু’বছরে ভারতে ধনী-গরিবের মধ্যে
আর্থিক অসাম্যের দূরত্ব নজরে পড়ার মতো বেড়েছে।আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষুধার
নিরিখে ভারতের স্থান ১১৭টা দেশের মধ্যে ১০২।সমস্ত প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে পিছিয়ে। বর্তমান
বিশ্বে আজ ৮ কোটি মানুষ ঘুমোতে যান খালি পেটে। অপুষ্টির প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে মহিলা
ও শিশুদের মধ্যে।
গ্রামের মানুষের হাতে টাকা না থাকলে বাজারে চাহিদা থাকবে না।সরকারি
বা বেসরকারি বিনিয়োগ না থাকলে গ্রামীণ শিল্পে উৎপাদনও থমকে যাবে।অর্থনীতির ভিত্তি হিসাবে
কাজ করে থাকে এক অভ্যন্তরীণ বাজার।বাজারে চাহিদার ভিত্তিই হচ্ছে, শ্রমজীবী ও পেশাজীবী
মানুষের আয়।ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোগপতিদের আয়ও বাজারে চাহিদা তৈরি করতে সাহায্য করে।সাম্প্রতিক
কালের সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে পাওয়া দেশের অসাম্যের ছবি আমাদের ভাবতে বলছে, উদার অর্থনীতির
আলোয় উন্নয়নশীল ভারতের আখ্যান কতটা গদ্যময়।অমৃতকাল-এর প্রচারের উজ্জ্বল আলোয় কি হারিয়ে
যাবে বঞ্চিত গ্রাম ভারত।
Comments
Post a Comment