মননশীল আত্মীয়তায় ওদের পাশে আমরাও থাকতে চাই





 দীপেন্দু চৌধুরী

স্টেট বাসের জানালায় মুখ রেখে

একবার আকাশ দেখি একবার তোমাকে।

ভিখারী-মায়ের শিশু,

কলকাতার যীশু,

সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।

কলকাতার যীশু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪)

আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছি। আর ‘কলকাতার যীশু’ কবিতাটি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন ১৯২৪ সালে। সময়ের আবর্তে প্রায় ৯৮ বছর পেরিয়ে এসে আমরা জানতে চাই ভারতের শিশুরা কেমন আছে? নিজের কাছে, নিজেদের কাছে জানতে চাইলে মনটা কেমন জানি না আঁতকে ওঠে।সর্বভারতীয় একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনা অতিমারির কারণে লকডাউন চলাকালীন ৫০শতাংশ শিশু অত্যন্ত রেগে থাকত।তাঁদের মধ্যে অজানা এক উদ্বেগ কাজ করত। যে কারণে তাঁরা সেই সময়টা অস্থির হয়ে উঠত। সংবাদ মাধ্যম দাবি করছে, তাঁরা অচেনা করোনা ভাইরাসকে ভয় পাচ্ছিল।অনভ্যস্ত অনলাইন ক্লাস করার ক্ষেত্রেও এক ধরণের ক্রোধজনিত অস্থিরতা কাজ করছিল ওদের মধ্যে। এই কারণে শিশুর মনে ভয়ানক চাপ তৈরি হয়। অভিভাবকদের অভিঞ্জতা ওই সময়কালে শিশুরা গার্হস্থ হিংসার শিকার হয়। স্কুল, কলেজ বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার জন্য ৩২০ মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী করোনা আবহে শিক্ষা জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল। তার ফলে শিশু মনে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে। ইন্ডিয়া ডেভলপমেন্ট রিভিউ(আইডিআর)নামে একটি সংস্থার সমীক্ষার সূত্রে এই তথ্য জানা যাচ্ছে।

লকডাউন নামক প্রশাসনিক তথা সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি করোনা অতিমারির প্রথম ঢেউ পর্বে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি রিপোর্ট মানবসভ্যতাকে চমকে দিতে পারে।করোনা অতিমারিতে বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ ১০ হাজার ৯৪ জন শিশু। এই সময়কালে শৈশব হারিয়ে যাওয়া ওই সব স্বজনহারা শিশুর বাবা বা মা যে কোনও একজনের মৃত্যু হয়েছে, করোনা নামক প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণে। সেই সংখ্যাটা হচ্ছে, এক লক্ষ ৩৬ হাজার ৯১০ জন। ৪৮৮ জন শিশুকে দেখাশোনার কোনও আত্মীয় বা কেউ নেই। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ক জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন(এনসিপিসিআর)-এর পেশ করা হলফনামা থেকে এই তথ্য আমরা জানতে পারছি। উচ্চ আদালতে পেশ করা তথ্যের ভিত্তি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাল স্বরাজ পোর্টালের শিশু সংক্রান্ত তথ্য। এই তথ্য জানতে পেরে মনটা কেমন যেন অবসন্ন হয়ে পড়ল। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে যে সমস্ত শিশুরা সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সুরক্ষা ও পরিচর্যার জন্য সরকারের তরফে কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে? সেই তথ্য পেশের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।সত্য উত্তর আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত ভারতে আরও একটি মর্মান্তিক তথ্য আমাদের কাছে এসেছে, ওই একই মাসে।চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি ভিন্ন একটি হলফনামায় এনসিপিসিআর সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, ৫৪০১টি শিশু পরিবারের সঙ্গে রাস্তায় থাকছে।প্রায় ৪১৪৮টি শিশুর দিন কাটে রাস্তায়, শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তারা।ক্লান্ত শ্রান্ত শৈশব হারা দেহটা নিয়ে তারা ঘরে ফেরে সূর্যাস্তের পরে।এঁদের সবাই থাকে নাগরিক সভ্যতার নতুন উপত্যকা এঁদো বস্তি অথবা ঝুপড়িতে। না এই তথ্যেই আমরা থামতে পারছি না, আরও অভিশপ্ত পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আছে। ৩৯৬ জন শিশু পরিবার ছাড়া একাই রাস্তায় থাকে।৯৮ বছর পরে কেন জানিনা আজও আছড়ে পড়ছে কলকাতার যীশু কবিতার আরও কয়েকটি চিরন্তন লাইন।

‘মগ্ন হয়ে আছে!/ স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,/ টাল মাটাল পায়ে/ রাস্তার এক পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়/ সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু’।

শিশুর চিন্তাজগৎ নির্মাণে মায়ের ভূমিকার কথা আমরা জানি। কিন্তু যে শিশুরা অনাথ হয়ে গেল।একুশ শতকের মহামারি বাবা-মা কে কেড়ে নিল, তাদের মনন গড়ে দেবে কোন মানবসভ্যতা? আমাদের সমাজ আজও পিতৃতান্ত্রিক, তাই একজন শিশুর শৈশব কৈশরে মায়ের প্রভাব থাকলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাংস্কৃতিক প্রভাব শিশুর বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে থাকে। কিন্তু যে শিশুর বাবা-মা দুজনেরই করোনার করাল থাবায় মৃত্যু হয়েছে,  সেই সব শিশুর দায়িত্ব কে বা কারা নেবে? শিশুর মানসিক, শারিরীক বিকাশের এই পর্যায় যে সময়টা একজন শিশুর  ভবিষ্যতের পরিচয় তৈরিতে সহায়ক হয়ে ওঠে সেই সময়েই তারা নিজেদের পরিবারেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল।হঠাত এক ঝঞ্ঝায় হারিয়ে গেল শৈশব, কৈশোর। সাদা সাদা ফুলের প্রস্ফুটিত পাঁপড়ি শিশির ভেজা লালিত মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। অতিমারির বহতা সময়কালে প্রান্তিক মানুষগুলোর সন্তানদের শিক্ষাতেও নেমে এসেছে ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিট্যাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘লার্নিং টুগেদার’ সংস্থার উদ্যোগে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২৮ শতাংশ শিশু লেখাপড়ার পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

অপুষ্টির আন্তর্জাতিক যে সূচক বিগত বছরের নভেম্বর মাসে প্রকাশ হয়েছে, সেই সূচক নিয়ে ভাবছে না দেশের শীর্ষ আদালত। তাঁদের মননশীল বক্তব্য, ক্ষুধার নিবৃত্তির কথা সরকারকে ভাবতে হবে। অনাহারে দেশের কোনও শিশু বা ব্যক্তির যাতে মৃত্যু না হয়, সেটা নিশ্চিত করাটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একটি মামলার শুনানিতে বিগত বছরের নভেম্বর মাসের ১৬ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা, বিচারপতি এ এস বোপান্না এবং বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চ এই মন্তব্য করেছেন। আমাদের দেশে চরম অসাম্য রয়েছে।সম্প্রতি এই দাবি করেছে, প্যারিস স্কুল অব ইকনমিকসের ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব-র একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট।কোভিড সঙ্কটকালে আমার-আপনার পরিবারের যে শিশুরা অনাথ হয়ে গেল, মননশীল আত্মীয়তায় ওদের আগলে রাখাটাও আমাদের নাগরিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।আত্মীয়হীন, সমাজহীন প্রায় ১১ হাজার অনাথ শিশুর দায়িত্ব শুধু সরকারেরই বা কেন? আমাদেরও সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব বর্তায় না কী?                                                                                                   

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?