সাহিত্য-সংস্কৃতি সাধনায় সীমান্ত ভাঙা প্রাঙ্গণ






দীপেন্দু চৌধুরী

নতুন শতাব্দীর শুরুতে বাঙালি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। বিদ্বজ্জনসভায় আড্ডা দেওয়ার সুবাদে আমাদের মনে আছে,  একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাঙালির সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে তোলার একটা হুজুগ এসেছিল।গত কয়েক দশক থেকেই ইংরেজি আর হিন্দির সমবেত চাপ বাঙালি সংস্কৃতির উপর চেপে বসেছে।এমনটা অনুযোগ শোনা যেত। সেই আবহ থেকে বেরতে বাংলা তথা বাঙালি নতুন করে জেগে উঠতে চাইছে।বাঙালি সংস্কৃতি বাঁচিয়ে তোলার সদিচ্ছাকে আমরাও স্বাগত জানাচ্ছি।সাহিত্য, সংস্কৃতি কৃষ্টির সাধনায় মননশীল বাঙালি হিসেবে, এই দায়িত্ব আমাদের উপর এসেও বর্তায়।বর্তমান সময়ে আমরা বিশ্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যাপন করছি। সেই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে গত দেড়শো বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ঠাসবুনোট ঐতিহ্য মেনেই।সমাজতত্ববিদরা বলছেন, প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উদ্যোগেই এই সংস্কৃতির আবাহন হয়েছিল। গত দেড়শো বছরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতির পিছনে ছিল আধুনিকতার বাঁধভাঙা তাগিদ। সাহায্য করেছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর ইংরেজি শিক্ষা। সমাজতত্ববিদদের দাবি, প্রাক-আধুনিক সমাজে অভিজাত আর নিম্নবর্গের মধ্যে সম্পর্কের অভিঘাত ছিল। বিস্তর ফারাক ছিল মার্গ সঙ্গীত, ধ্রুপদী সাহিত্য আর লোকসংস্কৃতির সামাজিক গঠনে।কয়লা কুঠির লেখকরা আমাদের দুই ক্ষেত্রের ফারাকের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করেছেন।উল্লেখিত ওই দুই ক্ষেত্রের চর্চা করলেই বোঝা যাবে ভাষা, শিক্ষা, শিল্পকলা, পোশাক-আসাক, আচারব্যবহার, প্রভৃতি ধারায় উচ্চ-নীচের সংস্কৃতির প্রাচীর ভাঙা ছিল এক কঠিন প্রয়াসলব্ধ কাজ।

বিশ্বায়ন উত্তর উদার অর্থনীতির প্রভাবে আধুনিক জাতীয় সংস্কৃতি বিগত কয়েক বছর ধরে একদেহে বিলীন হতে চাইছে।  সূক্ষ্ম একটা বিতর্কের সুক্ষ রেখা আছে প্রবাহিত সর্বজনীন সংস্কৃতির মধ্যে। তবু বলতে হবে, গত কয়েক বছরে মার্গ আর জনলোকের প্রভেদ মুছে দিতে পেরেছি সংস্কৃতি সচেতন ভারতীয় নাগরিকবৃন্দ।সর্বজনীন শিক্ষা এবং গণমাধ্যমের সাহায্যে আধুনিক জাতীয়সংস্কৃতির অভিভাবকেরা সারা দেশের জন্য একটা জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাইছে।সমস্ত স্তরের ভারতীয়রা সেই মানে বা স্ট্যান্ডার্ডে আদৌ পৌঁছতে পারবে কিনা আমাদের জানা নেই। কারণ প্রান্তবাসী প্রান্তিকজনেদের লোকসংস্কৃতির বেড়া ভেঙে উপরে তোলাটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। জাতীয় সংস্কৃতির মানে সবাই পৌঁছতে না পারলে অথবা না চাইলেও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি-ইংরেজি যমজ সংস্কৃতি আমাদের উপর চেপে বসতে চেয়েছে।নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই আমাদের একথা বলতে হচ্ছে। অলঙ্ঘনীয় এই প্রভাব আমরা লক্ষ্য করেছি, ভাষা, বিঞ্জান, শিল্প, সাহিত্য, বিনোদন, দৈনন্দিন জীবনচর্চা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। পাশাপাশি আধুনিক সমাজজীবনে আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি দায়িত্ব নিয়েছে নিরপেক্ষ সাহিত্য সংস্কৃতির বিন্যাসে। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের বিষয়েও একই কথা বলা যেতে পারে।দুই বাংলার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য বললে অবান্তর হবে বলে মনে হয় না।   

রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, সুকান্তের পরবর্তী বাঙালি প্রজন্ম আমরা শিকলভাঙার সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছি। মেলাখেলায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে।বইপাড়ার আত্মীয়তায়। পশ্চিম ও পূর্ব দুই বাংলাতেই বাঙালি নিজের সংস্কৃতিকে লালনপালন করে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং করছে।ওই সূত্রেই বলা যায়, লিখিত ভাষার সাধারণীকরণ করা হয়েছে গদ্যসাহিত্য আর সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে। বাংলাভাষার বৃহত্তর সম্মেলনের লক্ষ্য নিয়ে আমরা বইপাড়া টপকে বইমেলা প্রাঙ্গণ খুলেছিলাম কয়েকদশক আগে।বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশক(১৯৭৬)-র রাজ্য সরকারের উদ্যোগে করা পুস্তকমেলা বর্তমানে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। অভিজাতদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই মেলায় নিম্নবর্গের আমন্ত্রণ থাকে বাঙালি সর্বজনীন সংস্কৃতির প্রবাহে। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এমনই একটি সর্বজনীন ধারাবাহিকতা।

করোনা আবহে গতবছর আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।ছোট বড় প্রকাশকদের বিপুল, ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি যেমন হয়েছে।বাঙালিজাতির ক্ষতি হয়েছে বৌদ্ধিক চর্চাতেও। এই বছর দেরি করে হলেও কলকাতা বইমেলা  হচ্ছে।২৮ ফেব্রুয়ারি ৪৫তম কলকাতা বইমেলা ২০২২ শুরু হচ্ছে। সারস্বত সাধনায় আন্তর্জাতিক স্তরে আহ্নিক করেই আমাদের সর্বজনীন ভাষা-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে হয়। গিল্ড সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বইমেলা-র পরিবর্তিত সময়সুচী ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন, জেনেভার স্বীকৃতি নিয়েই শুরু হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার সঙ্গে তুলনায় আসে, জার্মানি ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুট জার্মানির বাণিজ্যিক নগরী হলেও সেই দেশের সবচেয়ে পরিচিত বাণিজ্যমেলা হল ফ্রাঙ্কফুটের বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুটের বইমেলাকে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা বলে দাবি করে জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রকাশকরা। করোনার বিধির বাধ্যবাধকতায় এক মাস দেরি করে হচ্ছে কলকাতা বইমেলা। ফোকাল থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই মেলার তিনটি গেটে এ বার বাংলাদেশের ছোঁয়া থাকবে। বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বইকে বিষয় করে কলকাতা বইমেলার তিনটি গেট সাজানো হবে। এই কথা জানা গেল ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’-র প্রধান সমন্বয়ক তথা কবি ডঃ কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানালেন, মুজিবের তিনটি বই প্রকাশিত  হয়েছে। মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছাড়া রয়েছে, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়া চীন’।মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাক কারাগারে বন্দি থাকার সময়ে মুজিব লিখেছিলেন তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’।

২২ ফেব্রুয়ারি বইমেলার উদ্যোক্তারা সাংবাদিক বৈঠকে জানান, মেলা প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধার্ঘ সভাঘরে ৩৩ জন বিদগ্ধ ব্যক্তিকে স্মরণ করা হবে।অধিকর্তা সুজাতা সেন জানিয়েছেন, ১১ এবং ১২ মার্চ কলকাতা সাহিত্য উৎসবে ঋষি অরবিন্দ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধ শতবর্ষ, সত্যজিতের শতবর্ষ মেলে ধরা হবে।এই লেখার অবসরে একটি প্রশ্ন ছোট্ট করে গিল্ড কতৃপক্ষের কাছে রাখতে চাইছি।বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ, সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা, দার্শনিক, সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক রাজা রামমোহন আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় ব্রাত্য কেন? গিল্ড কতৃপক্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার কথা আপামর বইপ্রেমী বাঙালি জানে। তবু কেন উদ্যোক্তাদের এই অন্যমনস্কতা অথবা উদাসীনতা? এই বছর রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের সার্ধ দ্বিশতবর্ষ। চলতি বছরের ২২ মে তাঁর জন্মের দ্বি শতবর্ষ। ১৭৭২ সালের ২২ মে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বইমেলার প্রাঙ্গণে ভারতের যুগপুরুষ রাজা রামমোহন রায়ের জন্য একটি আলোচনাসভার ব্যবস্থা গিল্ড কতৃপক্ষ করতে পারেন না? তৎকাল বৈঠক করে গিল্ড কতৃপক্ষ যুগপুরুষ রাজা রামমোহন রায়কে স্মরণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাজা রামমোহনের পথ ধরেইতো বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ বাংলার সাহিত্য এবং সমাজকে সমৃদ্ধ করেছেন।                     

শেষে স্বতঃস্ফুর্তভাবেই বলব, নীল আকাশের নীচে উন্মুক্ত সামিয়ানা নিয়ে আমরা বসে আছি ভাষা পথিকের দল। ইংরেজি, হিন্দি সহ যে কোন ভাষার নদী এসে কলকাতার সাহিত্য, সংস্কৃতির স্রোতসিনী গঙ্গার বহুত্বের প্রবাহে মিশে যাক। আভিজাত্য আর  নিম্নবর্গের বইপ্রেমীদের সামাজিক আত্মীয়তায়।       

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?