‘ভাষা সন্ত্রাস’-র পরেও হাল ছাড়তে রাজি নন গানওয়ালা
দীপেন্দু চৌধুরী
কী হবে
সে কবিতা দিয়ে, দুনিয়া জাগাতে পারে না যা?
কী হবে
জলভরা সে চোখ দিয়ে, তা যদি ভাসাতে না পারে গোটা শহরকে’’
ফয়েজ
আহমেদ ফয়েজ
‘আপনাদের যেমন প্রশ্ন করার অধিকার আছে, আমারও উত্তর না দেওয়ার
অধিকার আছে।কেন্দ্রীয় সরকার কি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়?’কথাগুলি বলেন কবীর সুমন।১
ফেব্রুয়ারি কলকাতার বৈষ্ণবঘাটায় নিজের বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি এই কথা বলেন।একটি
লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের সামনে পড়ে শোনান জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। সেই বিবৃতির মূল
বক্তব্য, তিনি জানতেন না তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করা হচ্ছে।তাঁর অভিযোগ এটা করা কি উচিত?
স্বাধীন গণতান্ত্রিক একটি দেশে? আমার অনুমতি না নিয়েই আমার বক্তব্য কেন রেকর্ড করা
হবে? সাংবাদিকদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেও তিনি নিজে কোনও প্রশ্ন নেবেন না এই শর্তে
সাংবাদিকদের সামনে তাঁর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। লিখিত বক্তব্যের আগে সুমন তাঁর স্বভাবসুলভ
ভঙ্গিতে নিজের সাংবাদিকতার অভিঞ্জতার কথা বলেন। সাংবাদিকদের তিনি নিজের সহকর্মী হিসেবেই
দেখেন এটাও জানান।একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, দু’একটি প্রশ্ন নেওয়ার জন্য। কিন্তু
সুমন রাজি হননি। আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করার আগে তাঁর শর্ত ছিল তিনি কোনও
প্রশ্ন নেবেন না। তাই সাংবাদিকদের অনুরোধ প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী রাখতে পারছেন না বলে
জানান।আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনের পরে নতুন প্রজন্মের একজন সাংবাদিক বলেন, সুমনদা
আজ এখানে আমরা যারা আছি, অনেকেই আপনার অনুরাগী। আপনি আমাদের দু’একটা প্রশ্ন করার সুযোগ
দিন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনারা এই বিষয়ে একটি আলোচনাসভার ব্যবস্থা করুন, আমি সেখানে
যাব। তবে একটা বিষয় বলে রাখি, আপনাদের যেমন প্রশ্ন করার অধিকার আছে, আমারও প্রশ্নের
উত্তর না দেওয়ার অধিকার আছে।আমাদের দেশের সরকার কি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়?’
কবির সুমন যেদিন সাংবাদিক সম্মেলন করেন, সেদিনই ছিল দেশের হিন্দুত্ববাদী
বিজেপি দলের সরকারের বাৎসরিক বাজেট।যে সরকার
নতুন আইন কমিশন গঠন করে সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংশোধন আনতে চাইছে।বাজেট অধিবেশনের দিন
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা হাজির থাকলেও সাংবাদিক তথা সলিল পরবর্তী সময়ের জনপ্রিয়
সঙ্গীতশিল্পী সুমনের বক্তব্য সংবাদমাধ্যম তেমনভাবে গুরুত্ব দিতে পারেনি। আলোচ্য প্রতিবেদক
আমন্ত্রণ পেয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যক্তিগত আগ্রহে তাঁর বৈষ্ণবঘাটা বাড়িতে হাজির ছিলেন।১
ফেব্রুয়ারি নিজের বাড়িতে করা তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য থেকে যেটা মনে হয়েছে,
তিনি কি সত্যিই অনুতপ্ত? তিনি কি আদৌ ক্ষমা চেয়েছেন? এ কেমনতর ক্ষমা? গানওয়ালা নিজের
প্রতিবাদের অবস্থান থেকে এক চুল সরতেও আগ্রহী নন।প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলনের পরে সাংবাদিকদের
সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘হাল ছাড়তে তিনি রাজি নন’। বরং কন্ঠ তিনি আরও
জোড়ে ছাড়তে চান। আলাপচারিতার সময়েই তিনি খুব নীচু স্বরে বলেন, ‘আমাকে যদি জিগ্যেস করেন
আমি কি ধর্ম মানি? উত্তরে বলব, হ্যা মানি, আবার মানিও না।’
প্রসঙ্গত, তাঁর বিরুদ্ধে একটি বাংলা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের
গালাগালির অভিযোগ ওঠার পরে ফেসবুকে সুমনের প্রকাশিত বক্তব্য আমরা পড়েছি।সেই বক্তব্যে সুমন তাঁর
সাংবাদিকদের করা অপভাষা প্রয়োগ ‘সুশীল সমাজের নিরিখে গর্হিত কাজ’ বলে ৩০ জানুয়ারি ক্ষমাপ্রার্থনা
করেছিলেন।তবে সুমনের ব্যাখ্যা তিনি যা করেছেন, তা ‘অক্ষমের কটূক্তি’। সত্যিকারের প্রতিশোধ
নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে এমন গালমন্দ করতেন না।
সর্বভারতীয় একটি নিউজ চ্যানেল তথা তাদের শাখা সংস্থা বাংলা
চ্যানেল যা করে যাচ্ছে, সুমন তাঁদের ভাষাতে সেই কথারই জবাব দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে প্রখ্যাত
এবং বিতর্কিত সঙ্গীত শিল্পী আবারও এমনটা করবেন বলে আগেই একটি ফেসবুক বিবর্তিতে দাবি
করেছিলেন।বিজেপি নেতারা সুমনের কথায় সম্প্রীতি বিরোধী বয়ানের অভিযোগ তুলে পুলিশে গিয়েছেন।
এর পরেই নিজের অবস্থান বদল করে ফোনে সংবাদ মাধ্যমের যে প্রতিনিধিকে কথাগুলি বলেছিলেন,
তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।বিজেপি,আরএসএস বা আইনরক্ষীদের কাছেও তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।
কারণ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন ভদ্রজনের উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্যই পুলিশের ‘কাজ বেড়েছে’।
যদি কেউ মনে করেন তিনি ভয় পেয়ে পিছু হটলেন, এমনটা কেউ ভাবলেও সুমনের আপত্তি নেই। ফেসবুকে
নিজের অনুরাগী এবং বন্ধুবৃত্তে প্রকাশিত বক্তব্য থেকে যেমনটা জানা গেছে। পাশাপাশি আগের
বিবৃতিতেও তিনি জানিয়েছিলেন, স্বর্ণযুগের বাংলার জনপ্রিয় প্রবীণ শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধযায়কে
পদ্মশ্রী সম্মান ‘ছুঁড়ে দেওয়ার’ বিষয়টিতে প্রতিবাদ করে তিনি ভুল করেননি।প্রয়াত সন্ধ্যা
মুখোপাধ্যায়ের মতো সম্মানীয় শিল্পীকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করার আন্তরিকতা নিয়ে মুখ
খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও।২ ফেব্রুয়ারি তৃণমূলের সাংগঠনিক নির্বাচনের
মঞ্চের বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘পদ্মভূষণ নিয়ে এখন দূষণের রাজনীতি হচ্ছে। রাশিদ খানের
বাড়িতে বিজেপির দু’জন প্রতিনিধি গিয়েছিলেন।সন্ধ্যাদিকে চরম অসমান করা হয়েছে।তিনি এখন
অসুস্থ।‘’ রাগ সঙ্গীতের ধ্রুপদী শিল্পী রাশিদ খান নিজেও সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রশ্ন
তুলেছেন।এত দেরি করে সকলের কাছে শ্রদ্ধেয়, প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে
সম্মানিত করা হল কেন?
ফেসবুকের ভিন্ন একটি পোস্টে সুমন জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে উত্তেজনা
প্রশমনের পক্ষে হলেও এ দেশে জাতি বিদ্বেষমূলক প্রচার বা হিংসায় লোকে সচরাচর ক্ষমা চায়
না।তাঁর ইঙ্গিত ছিল মোদী সরকারের আমলে দলিত ও সংখ্যালঘু নিগ্রহের দিকে। বামপন্থী দল,
কংগ্রেস সহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের অভিযোগ, শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
সংঘ মতাদর্শের ঢালাও অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা হচ্ছে। গত সাত বছরে মোদী সরকারের আমলে ‘গৈরিকরণ’-র
ঝোঁক আমরা পরিলক্ষিত করতে পারছি।স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকেও বিকৃত করার অভিযোগ করছেন
দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদেরা।
যদিও এই প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ গীতিকার, সুরকার এবং গানওয়ালা গায়ক
সুমনের ‘ভাষা সন্ত্রাস’ নিয়ে সমাজমাধ্যমে নেটিজনেরা উচ্চকিতভাবে সরব হয়েছে।একজন সাংবাদিক
এবং ব্লগার হিসেবে আমি নিজেও ‘ভাষা সন্ত্রাস’-র প্রতিবাদ করেছি।ভিন্ন একটি বাংলা টিভি
চ্যানেলের এক তরুণ সাংবাদিক বন্ধুর ফেসবুক পোস্টে আমি লিখেছিলাম, কবির সুমনের পূর্বাশ্রম
ছিল সাংবাদিকতা। তাই তিনি আমাদেরই একজন লোক হয়ে যদি এই ভাষায় কথা বলে থাকেন সেটার প্রতিবাদ
হওয়া উচিত।ফেসবুক লাইভে সুমনের বক্তব্য শুনলেও আদৌ মনে হচ্ছে না, ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে
সত্যিই তিনি কতটা আন্তরিক।
সমাজ বিকাশের ইতিহাস পড়লে আমরা জানতে পারি, শাসক বা রাজা বিভিন্ন
কবি বা বুদ্ধিজীবীকে আনুকুল্য দিয়ে থাকেন নিজের স্বার্থে। মানুষের মনে যে বুদ্ধিজীবী,
কবি, শিল্পীরা থাকেন, সুশীল সমাজের সেই প্রতিনিধিকে দেশের রাজা বা শাসক সম্মানিত করতে
চান। কারণ তাঁদের সম্মানিত করে নিজের একটা গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি তৈরি করতে প্রয়াসী
হন তিনি।শাসকের দেওয়া যে কোন সম্মান দেওয়ার পেছনে এই গূঢ় উদ্দেশ্য সে যুগেও ছিল, বর্তমান
সময়ে আরও প্রকটভাবে আছে।মোদ্দা কথা এই আনুকূল্যদানের মাধ্যমে তাঁরা শিল্পীর মেধাকে
কিনে নিতে চান। স্ব-স্বার্থে সম্মানিত শিল্পীকে ব্যবহার করে থাকেন দেশের রাজা, মন্ত্রী,
রাজন্যবর্গ। এই জন্য পুরষ্কারস্বরূপ তাঁদের উপঢৌকন দিয়ে অনুগৃহীত করতে চান শাসককূল।
অভিঞ্জতা বলছে, রাজানুকূল্য পাওয়া শিল্পীরাও তার প্রতিদানে রাজস্তুতি করেন। রাজা এবং
রাজন্যবর্গের স্তুতি করাকেই তাঁদের রাজকর্তব্য বলে মনে করেন তাঁরা।তাঁদের কাছে জনস্বার্থ
বলে আর কিছু থাকে না।বেশিরভাগ সময়েই দেখা গেছে, পুরস্কৃত শিল্পীর কাছে রাজমাহাত্ব প্রচারই
তাঁদের শিল্পের ভাষা হয়ে যায়।বিবেক সচেতন শিল্পিরা এই বিষয়টা নিয়েই সতর্ক থাকেন।জনস্বার্থের
কথা ভেবে নিজের প্রতিবাদী সত্তাকে চিরন্তন রাখাকেই অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে করেন তাঁরা।
Comments
Post a Comment