অন্তর্জালের অন্তর্ঘাত আটকাবে কে বা কারা!



দীপেন্দু চৌধুরী 

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় প্রথম কাজই হল ব্যক্তিগত অথবা সংস্থার কম্পিউটারের নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন হওয়া। পাশাপাশি মোবাইল, বৈদ্যুতিন সিস্টেম ও নেটওয়ার্ককেও নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে প্রতিনিয়ত রাখতে হবে। না হলেই সাইবার অপরাধীরা সিঁধ কেটে ঢুকে পড়বে। কম্পিউটার, মোবাইলের ডেটা সুরক্ষিত রাখতে নিরাপত্তা অতি অবশ্যই জরুরী।    কারণ সুযোগ সন্ধানী বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি(হ্যাকার) নিজস্ব ‘যন্ত্রমেধা’র মাধ্যমে ক্ষতি করতে পারে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ‘সাইবার থ্রেট’ বা ভার্চুয়াল অপরাধের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। দশ বছর আগের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে লেখার বিস্তারে যেতে চাইছি।

আমার পরিচিত কল্যাণ(নাম পরিবর্তিত)কম্পিউটার কিনে সদ্য সদ্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে শিখেছে।কল্যাণের সামাজিক পরিচিতি অনেকের কাছেই ছিল ঈর্ষণীয়। আজও তিনি সমাজে যথেষ্ট পরিচিত নাম।ভদ্রলোক বিবাহিত। সামাজিক মাধ্যমে নিজের প্রোফাইল লেখার সময় ‘বিবাহিত’ কলামে কিছু লেখেননি। তিনি জানতেনও না কি করে প্রোফাইল পেজ লিখতে হয়।এই না জানাটা কল্যাণের কাছে ছিল এক তিক্ত অভিঞ্জতার সমান।সামাজিক মাধ্যমে প্রেম ও বিয়ের ঘটনার কথা যেমন আকছার শোনা যায়। আবার বিয়ের ফাঁদ পেতে নারী পাচারেরমতো অপরাধের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।বহু ভুয়ো সংস্থা ফাঁদ পেতে বসে রয়েছে। সাধারণ মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা তছরুপ হয়ে যাচ্ছে সাইবার হ্যাকারদের সুচতুর হাতছানিতে।সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই খবর প্রকাশ হয় ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে বিভিন্ন মানুষের টাকা জালিয়াতের।প্রতি বছর সাইবার অপরাধ বাড়ছে। ‘বিস্ক বেসড সিকিউরিটি’-র রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সাইবার দুনিয়ার অপরাধের বিভিন্ন দিক ক্রমশঃ উন্মোচিত হচ্ছে।সংস্থার ২০১৯ সালের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, হ্যাক হয়ে যাওয়া তথ্যের ৭.৯ বিলিয়ন রেকর্ডস প্রকাশ্যে এসেছে। সাইবার বিশ্বের হ্যাকাররা এই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করেছে। আন্তর্জাতিক ডেটা কর্পোরেশনের অনুমান ২০২২ সালের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তার প্রয়োজনে ১৩৩.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে সারা বিশ্বে। সরকারি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলি সাইবার নিরাপত্তা খাতে এই খরচ করবে।

আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিতে আমরা বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় সামাজিকমাধ্যম ‘ফেসবুক’ নামক সংস্থাটির দ্বারস্থ হতে পারি। ভার্চুয়াল দুনিয়ার সামাজিক পরিসীমায় ফেসবুক যেমন বাল্যবিবাহরোধ বিষয়ক প্রচার সহ বিভিন্ন সামাজিক পরিষেবা দিচ্ছে উল্টোদিকে ফেসবুকের অসংখ্য ফেক প্রোফাইল মানুষকে বিভিন্ন সমস্যায় ফেলছে। ফেসবুক ব্যবহারকারী বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে একাধিক ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে থাকেন।এই কারণে ফেসবুক কতৃপক্ষ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ধরতে নিজেরাই একটি ‘ভুয়ো’ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। ২০১৯-এর ৪ ফেব্রুয়ারি। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফেসবুকের আসল স্বরূপ সামনে আস্তে থাকে। অভিযোগ, তিন সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুক কতৃপক্ষের অ্যাকাউন্টের ইউজার ভরে যায়। ভুরি ভুরি বিদ্বেষের বিষ, ভুয়ো তথ্য, ফেক নিউজ, সাজানো ছবি ও ভিডিও জমা পড়তে থাকে। প্ররোচনামূলক মেসেজের ছড়াছড়ি। যা দেখে ফেসবুকের কর্মীরাই চমকে উঠেছিলন।   

ফেসবুকের ভূতপূর্ব কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন ফেসবুকের কার্যকলাপ সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। যদিও ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ অযৌক্তিক বলে বিষয়টাকে হাল্কা করে দিতে চেয়েছেন। সম্প্রতি আরও কয়েকটি তথ্য আমাদের সামনে এসেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিশেষ কমিটির প্রশ্নের উত্তরে হাউগেন জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের তাড়নায় সামাজিক বিভাজন বাড়ে। সেই প্রক্রিয়ার দু’টো দিক আছে। একটা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী মতামতের অনুসারী যারা, তাঁরা সংগঠিত হয়ে আরও বেশি করে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে আক্রমণ শানান শুরু করে। উল্টোদিকে যাদের মতামত  কিছুটা মধ্যপন্থার অনুসারী ছিল তাঁরা আক্রান্ত হয়ে চরমপন্থী হয়ে ওঠে। সংবাদ বিশেষণঞ্জদের ব্যাখ্যা, ব্যক্তির মতামত আরও অনমনীয় হয়। আর আগে থেকেই যাদের অনমনীয় অবস্থান ছিল তাঁরা নিজেদের শিবিরে বেশি করে সংগঠিত হতে থাকেন। অভিযোগ উঠে আসছে, সামাজিক মাধ্যমের পরিচালকরা সচেতনভাবেই কী নিজেদের ব্যবসায় এই নীতি মেনে চলতে বলেন অধস্থন কর্মীদের? নতুন করে এই বিতর্ক উঠে আসছে। ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছে সত্য উত্তর সচেতন সাংস্কৃতিক সমাজ। আরও একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতি মাসে বিশ্বের ২৯১ কোটি মানুষ ফেসবুক নামে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমটি ব্যবহার করেন। আমাদের দেশ ভারতে ৪১ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন।

আমাদের বিষয়বস্তু সাইবার অপরাধ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাক ভারতের সাইবার অপরাধের পরিসংখ্যান। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই প্রায় ৫০,০৩৫ টি সাইবার অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে ভুয়ো খবর পরিবেশন সংক্রান্ত প্রায় ৫৭৮টি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। আগের বছরগুলির সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করলে যে পরিসংখ্যান উঠে আসছে তা হল,  ২০১৮ তে ভার্চুয়াল জগতে অপরাধের সংখ্যা ছিল ২৭, ২৪৮, ২০৯। ২০১৯ সালে অপরাধের সংখ্যা প্রায়  দ্বিগুণ হয়ে ৪৪, ৭৩৫ হচ্ছে। ২০২০ তে এসে এই সংখ্যা আনুমানিক ১১% বাড়ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে অন্তর্জালের অন্তর্ঘাত আটকাবে কে বা কারা? সাইবার বিশেষঞ্জ, সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলা লড়ছেন যে সব আইনজীবী তাঁদের দাবি সাইবার সচেতনতা বাড়াতে মানুষের মধ্যে প্রচার বাড়াতে হবে। রাজ্যের পদস্থ আইপিএস অফিসারদের বক্তব্যও একই। সম্প্রতি ৩০ নভেম্বর ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং(ISOEH)একটি পদযাত্রার আয়োজন করে।ওই দিন ছিল জাতীয় কম্পিউটার নিরাপত্তা দিবস।  সল্টলেকের সেক্টর ৫-এ এই পদযাত্রা হয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সহ সমাজের বিশিষ্টজনেরা এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।বিভিন্ন বিষয়ে অভিঞ্জ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত উদ্যোক্তা সংস্থাটি কলকাতা পুলিশ, সিআইডি, সিআরপিএফ সহ বিভিন্ন সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।আইএসওইএইচ(ISOEH) সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সন্দীপ সেনগুপ্তের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বললেন, একজন মানুষের পরিচিতি ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য সুরক্ষিত রাখাই সাইবার সচেতনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।                                      


 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?