গ্রামের স্কুলের জন্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে







 দীপেন্দু চৌধুরী     

করোনা অতিমারির সময়ে প্রায় বছর দেড়েক স্কুল বন্ধ ছিল। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারেনি। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।রাজ্যের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁদের বক্তব্য করোনার সঙ্গে লড়াই করেই শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। না হলে সমাজব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা পরিকাঠামোর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সমাজে এর ব্যপক প্রভাব পড়বে। এই কারণে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মানসিকভাবেই অসময়ের অভিঘাতের শিকার। বিশেষত স্কুলে ক্লাস না হওয়া এবং পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হলেও করোনাকালের প্রভাব পড়েছে। স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাটা দেখলেই বোঝা যায়।অনেকের অভিমত দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার জন্য অনেকেরই শৈশব, কৈশোরের অনেকটা সময় হারিয়ে গেল।

ইন্ডিয়া ডেভলপমেন্ট রিভিইউ(ইডিআর)নামে একটি সংস্থার সর্বভারতীয় একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, লকডাউন চলাকালীন ৫০% শিশু অত্যন্ত রেগে থাকত। তাঁদের মধ্যে অজানা এক উদ্বেগ কাজ করত। যে কারণে তাঁরা সেই সময়টা অস্থির হয়ে উঠেছিল। সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, শিশুরা করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক থেকে উদ্ভূত পরিবেশ পরিস্থিতকে ভয় পাচ্ছিল।ইডিআরের সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, অনলাইন ক্লাস করার ক্ষেত্রেও শিশুদের মনে একধরণের ক্রোধজনিত অস্থিরতা কাজ করছিল। যে কারণে শিশু মনে ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি হয়েছিল। অভিভাবকদের অভিঞ্জতা ওই সময়কালে শিশুরা পারিবারিক হিংসার শিকার হয়। সমীক্ষা থেকে আরও জানা যাচ্ছে, কলেজ বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার জন্য ৩২০ মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী করোনা আবহে শিক্ষা জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল।খেলাধুলো, শিক্ষা, সঙ্গীত চর্চা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় নিয়মিত অনুশীলনের। অনুশীলন না থাকার কারণে শিশুমনে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে।                 

করোনা আবহে আমাদের রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুল এখনও বন্ধ। এমত অবস্থায় রাজ্যের মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা দাবি জানালেন নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই দুটি শ্রেণির স্কুল খোলার। তা না হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। করোনা অতিমারির সময়ে প্রায় বছর দেড়েক স্কুল বন্ধ ছিল।এখনও প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুল বন্ধ।  ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারছে না। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। রাজ্যের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকরা বিষয়টা নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁদের বক্তব্য, করোনার সঙ্গে লড়াই করেই শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। না হলে সমাজব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার আবহাওয়া তথা পরিকাঠামোর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মানে সমাজে এর ব্যপক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি রাজ্যের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি সংগঠনের দ্বিতীয়বার্ষিকী সাধারণ সভা থেকে এই অভিমত উঠে এসেছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলে এডভান্সড সোসাইটি ফর হেড মাস্টার্স এন্ড হেডমিস্ট্রেস(ASFHM) সংগঠনের দ্বিতীয় বছরের সাধারণ সভা থেকে দাবি উঠেছে।সম্প্রতি এই স্কুলেই হয়ে গেল সংগঠনের দু’দিনব্যাপী রাজ্যস্তরের দ্বিতীয় বার্ষিকী সাধারণ সভা। ১৮-১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রথম দিনের আলোচনায় উঠে এল স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাও। এই বিষয় ছাড়াও আরও বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে গুচ্ছ দাবি উঠে এল।যেমন দুঃস্থ ও স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই নিতে হবে।দু’বছর ধরে বন্ধ থাকা প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিক স্কুলগুলিতে কোভিদ বিধি মেনে অবিলম্বে পঠন-পাঠন চালু করতে হবে।একান্ত আলোচনায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার মাইতি বললেন, কেন্দ্রীয় সরকারের মূল্যায়নে পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষায় বড় রাজ্যগুলির মধ্যে থেকে সেরা হওয়ার শিরোপা পেয়েছে। কিন্তু প্রায় দু’দুটি বছর স্কুল বন্ধ। এই সময়কালে শিশুশিক্ষায় যে ঘাটতি হয়েছে সেই ঘাটতি পূরণ করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। গত দু’বছরের পঠন পাঠনের ঘটতি পূরণে শিক্ষা দফতর, রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রসঙ্গত উলখ করা যাক, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, জাতীয় র‍্যাঙ্কিং ফাইন্ডেশনাল লিটারেসি ও নিউমেরেসি সূচকে বাংলা রয়েছে প্রথম স্থানে।    

এএসএফএইচএম নামক সংগঠনটির আরও দাবি, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের মতই রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদকেও একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজ্যের মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজের স্কুলে যাতে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারে তার নির্দেশ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনের নেতৃত্ব। পেশাগত দাবিও উঠে এসেছে সংগঠনের দু’দিনের আলোচনা সভায়। প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন বঞ্চনার নিরসন, শিক্ষা বহির্ভূত সব ধরণের কাজ থেকে তাঁদের অব্যহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এই বিষয় ছাড়াও গ্রামের স্কুলগুলিতে অবিলম্বে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগের দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্যের শিক্ষা সচিবকে স্মারকলিপি দিয়ে এই সকল বিষয়ে দাবিপত্র পাঠিয়েছে প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এএসএফএইচএম সংগঠনের নেতৃত্ব।

একান্ত আপাপচারিতায় বলছিলেন নদীয়া  জেলার চাকদহের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি বললেন, স্কুলের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিল দেওয়া আমরা শুরু করেছি।ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ তৈরি করতে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক নিয়মিত জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে কিছু ছাত্র আসছে না। আমাদের মনে হয়েছিল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক করতে না পেরে ভয় পেয়ে আসছে না। আমরা ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দিলাম অ্যাক্টিভিটি টাস্ক জমা দিতে হবে না। তোমরা স্কুলে এস। তারপরেও দেখা গেল বেশ কয়েকজন ছাত্র স্কুলে আসছে না। আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের ছাত্রদের বাড়ি পাঠাই। ওদের খোঁজ নিতে। আমার শিক্ষকরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে সব ছাত্র স্কুলে আসছে না তাঁরা বেশির ভাগই বাইরের রাজ্যে কাজ করতে চলে গেছে। অথবা স্থানীয়ভাবে কাজ করছে বাড়িতে অভাবের কারণে।

মুর্শিদাবাদ জেলার একজন প্রধান শিক্ষক বললেন, আমাদের অঞ্চলে একটা স্কুল আছে সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ন’হাজার। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা দেড়শো।এই সম্মেলন থেকেই জানা গেল ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতের হার।শিয়ালদহের একটি স্কুলে ১২ জন শিক্ষক আগে থেকেই আছেন। আরও ৬ জন শিক্ষক সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন। উৎসশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে।সেই স্কুলে একজন ছাত্রও নেই। গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছেন শিক্ষকরা। বিভিন্ন জেলা থেকে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাওড়া, কলকাতা, কলকাতার উপকণ্ঠে শিক্ষকরা চাকরিতে নিয়োগ হচ্ছেন অথচ দেখা যাবে সেই স্কুলে ছাত্র নেই। কোথাও আবার এমন হচ্ছে, ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক নেই।মুর্শিদাবাদ জেলার ওই প্রধান শিক্ষক বললেন, আমরাও স্কুলছুট ছাত্রদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।আমাদের সংগঠনের দু’দিনের সাধারণ সভায় বিষয়গুলি আলোচনা হবে।

বিষয়গুলির সঙ্গে একমত হলেন এডভান্সড সোসাইটি ফর হেড মাস্টার্স এন্ড হেডমিস্ট্রেস(ASFHM)সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার মাইতি। চন্দনবাবু নিজেও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। সম্প্রতি এই স্কুলেই হয়ে গেল সংগঠনের দু’দিনব্যাপী রাজ্যস্তরের দ্বিতীয় বার্ষিকী সাধারণ সভা। ১৮-১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই সভায় প্রথম দিনের আলোচনায় উঠে এল স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা। পাশাপাশি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার মাইতি আলোচনাসভায় তাঁর সম্পাদকীয় ভাষণে বলেন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের মূল কারিগর যারা, আজ সেই প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত ও অবহেলিত। তাই আগামীদিনে সরকার তাঁদের কাজের উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষা সহায়ক নীতির কথা ঘোষণা করবেন। চন্দনবাবু আরও বলেন, আমাদের সামনে সব থেকে বড় সমস্যা স্কুলছুট ছাত্রদের স্কুলে ফেরানো।আমাদের সংগঠন মনে করে অবিলম্বে শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না হলে গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

রাজ্যের ২৪টি জেলার প্রায় সাড়ে সাতশো মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা দু’দিনের এই সভায় যোগদান করেন। সভার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার-র সম্পাদক স্বামী সুপর্ণানন্দ মহারাজ।                                      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?