ভিটে-মাটি হারা মানুষের পুনর্বাসন ছাড়াই মোদীর উন্নয়ন




দীপেন্দু চৌধুরী 

চলতি বছরের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার প্রাক্কালে কর্পোরেট পুঁজির সেবক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার সময় তিনি দক্ষ অভিনেতার মতো ভারতীয় কৃষকদের কাছে  ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে শীতকালীন অধিবেশনে কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিল পাস করিয়েছেন। গত এক বছর ধরে ভারতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপেই মোদী কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী তিন কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনটা বললে খুব কিছু ভুল হবে বলে মনে হয় না। আন্দোলন করতে যাওয়া ৭০০ কৃষকের মৃত্যুর পরেও বিতর্কিত কৃষি আইন নিয়ে মোদী সরকারের কোনও হেলদোল ছিল না। অথচ বছর শেষ হওয়ার আগেই মোদী সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার করছেন। এই সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার ভোটকে সামনে রেখে।এমনটাই অভিমত কংগ্রেস, সিপিএম সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বের।এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

কৃষকদের পাশে আছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর সরকার এটা যদি মুদ্রার একদিক হয় উল্টো দিকটা একবার উঁকি মেরে দেখি। লোকসভার ভোট হোক অথবা বিধানসভার ভোট, শাসকদলের নেতৃত্ব উন্নয়নের নামে ভূমি পুজোর উৎসবে মেতে ওঠেন। একই প্রকল্পের নাম বদলে বদলে নতুন করে শিলান্যাসও করা হয়। শুধুমাত্র সিংহাসনের ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে। আমরা লক্ষ্য করছি উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে হিন্দুত্ব রাজনীতির যুগলবন্দি ‘মোদী-যোগী’ উন্নয়নের পসরা সাজিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন।ব্যানারে, ফ্লেক্সে, বড় বড় হোর্ডিং-য়ে বিঞ্জাপন দিয়ে উন্নয়নের নামে ভোট রাজনীতি করতে দু’জনেই দড় হয়ে উঠেছেন। যেমন আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ‘মা’ উড়ালপুলের ছবি ব্যবহার করে যোগী সরকারের একটি বিঞ্জাপন। উত্তরপ্রদেশ সরকারের উন্নয়নের হোর্ডিং-য়ের বিঞ্জাপনের এই ছবি নিয়ে সম্প্রতি বিতর্কও হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী ‘উত্তরপ্রদেশ’ নামক রাজ্যে নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন।কারণ গোবলয় তথা  উত্তরভারতের এই রাজ্যের ক্ষমতা বিজেপি দখল করতে না পারলে ২০২৪ সালের কর্পোরেট পুঁজির মহাভারতের ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’-র নতুন সিংহাসন অধরাই থেকে যাবে। তাই উত্তরপ্রদেশ নামক রাজ্যে বিজেপি দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা কাণ্ডারী মোদীর ঘন ঘন রাজকীয় সফর। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদী নয়ডায় জেওয়ার বিমানবন্দরের শিলান্যাস করেছেন। প্রস্তাবিত নতুন এই বিমানবন্দরের ৭০০ মিটারের মধ্যে ও কাছাকাছি গ্রাম নাঙ্গলাশারিফ গ্রামে গেলে দেখা যাবে সারি সারি প্লাস্টিকের তাঁবু। ওই সব তাঁবুতে ঠাঁই হয়েছে সেই সব কৃষক পরিবারের যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, প্রস্তাবিত নয়ডায় জেওয়ার বিমানবন্দরের জন্য। যোগীর রাজ্যে ৫৭৩০ কোটি টাকার এই প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। আলোচ্য প্রকল্পের জন্য যে সব কৃষক পরিবারকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁরা পুনর্বাসনের জমি এখনও পাননি। অনেকেই অভিযোগ করেছেন তাঁরা পাননি ক্ষতিপুরণের টাকাও। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক ধীরেন্দ্র সিংহ স্বীকার করেছেন, যোগী আদিত্যনাথ সরকারকে জমি অধিগ্রহণে তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশ সরকার বিগত দু’বছরে ১,২৪০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছে। জেওয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করার জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই অভিযোগ স্থানীয় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের। অধিগৃহীত ১০ হাজার পরিবার ৬টি গ্রামে বাস করতেন। ৬টি গ্রাম হল, বণহেরা, রোহী, দয়ানতপুর, পরোহী ও বনওয়ারিবাস।সংবাদ সংস্থা সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, ৪৫ বছরের এক কৃষক ওম পাল জানিয়েছেন, তিন বছর তাঁর ফাইল আটকে আছে।প্রয়োজনীয় সব কাগজাদ আটকে আছে, উত্তরপ্রদেশ সরকারে ভূমি দফতরের আধিকারিকদের টেবিলে।আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, ৯০ মিটার আয়তনের মধ্যেই ছোটখাটো একটি ইটে গাঁথা পাকা বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন রামস্বরূপ নামে একজন। যোগী-মোদী-র তথাকথিত উন্নয়নের ধাক্কায় তাঁর সেই বাড়ি এখন অধিগ্রহণের কবলে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে তিনিও তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছেন। অভিযোগ উঠে আসছে, নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবন থেকে বিচ্ছিন হয়ে ওম পাল, রামস্বরূপরা এখন তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছেন। না আছে বিদ্যুৎ সংযোগ, না আছে পানীয় জলের ব্যবস্থা। হাসান মহম্মদ নামে এক কৃষক এই বছর তৃতীয় শীত কাটাবেন সরকারের দেওয়া তাঁবুতে। তাঁকে পুনর্বাসন হিসেবে বিকল্প বাড়ির জন্য ৫.৫ লক্ষ টাকা দিলেও তিনি সরকারের কাছে থেকে বাড়ি তৈরির জন্য প্রতিশ্রুত জমি পাননি। যদিও উত্তরপ্রদেশ সরকারের ভূমি আধিকারিকদের দাবি হাসান মহম্মদকে ৫০ মিটারের প্লট দেওয়া হয়েছে। হাসান মহম্মদের অভিযোগ ওই পরিমাণ জমিতে গবাদি পশু, নিজের গোটা পরিবার নিয়ে থাকা অসম্ভব। বিরোধীদের বক্তব্য, সরকার সব কিছু জেনেও উদাসীন কেন? কাদের স্বার্থে?

নয়ডার জেলাশাসক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘’এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আমাদের কাছে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রশাসনকে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ সামলেই অধিগ্রহণের কাজ করতে হয়েছে।‘’ জেলা শাসকের বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অধুগ্রহণ প্রক্রিয়ার সময় রাজ্য সরকারের প্রস্তুতি কতটা পরিকল্পিত ও সংগঠিত ছিল।            

বাংলায় সিঙ্গুর আন্দোলনের পরে ব্রিটিশ আমলের বিতর্কিত ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধিত আইন হিসেবে আইনসভায় পাস হয়েছে কয়েক বছর আগে। জমি অধিগ্রহণ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উচ্ছেদ হওয়া ভিটেমাটি হারানো মানুষদের যথাযথ বিকল্প পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই সরকার কৃষকদের জমি নিয়ে নিয়েছে। এই অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে এলাহাবাদ হাইকোর্টে ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন ৬২ বছরের অজয়প্রতাপ সিংহ নামে এক কৃষক। তাঁর অভিযোগে অজয়প্রতাপ জানিয়েছেন, সরকারের নিয়মে আমাদের এলাকা গ্রামীন বলে চিহ্নিত করা আছে। অথচ সেই অঞ্চলের বাসিন্দারা শহরের। এমন ঘটনার কথা কেউ কোনওদিন শুনেছেন আপনারা? গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের জমির দরের চার গুণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার কথা। অথচ দেওয়া হচ্ছে মাত্র দুই গুণ টাকা।

সরকারের আজগুবি কাহিনীর কয়েকটি অধ্যায় যেমন, চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর নয়ডায় নব কলেবরের জেওয়ার বিমানবন্দরের শিলান্যাস করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, এই প্রকল্প শেষ হলে ১ লাখের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ২০১৯ সালে প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের সময় উত্তরপ্রদেশ সরকারকে উধৃত করে প্রথমসারির একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক লিখেছিল, জেওয়ার বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে ৫ লাখ বেরোজাগার লোকের কর্মসংস্থান হবে। ইংরেজি দৈনিকটির খবর প্রকাশের দু’মাসের মধ্যে উত্তর ভারতের জনপ্রিয় একটি হিন্দি দৈনিক খবর করে উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় জেওয়ার বিমানবন্দর গড়ে উঠলে ৭ লাখ বেরোজগার যুব সম্প্রদায়ের রোজাগারের ব্যাবস্থা হবে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে চাকরির পরিসংখ্যানের দু’রকম খবর নিয়ে যোগী সরকারের তরফে কোনও আপত্তি আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। দু’বছর পরে এই প্রকল্প উদ্বোধনে এসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন ১ লক্ষ ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হবে। কতজন প্রত্যক্ষ আর কত জনইবা অপ্রত্যক্ষভাবে কাজ পাবেন সেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা মোদী দেননি। উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফেও এই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত গরিব, দারিদ্র সীমার নীচের(বিপিএল) মানুষের কাছে ‘উন্নয়ন’-র মোড়কে মোদী-যোগী জুটি স্বপ্ন ফেরি করছেন। সামনে ২০২৪ সালের সেন্ট্রাল ভিস্টার সিংহাসন, তাই কোনওরকম পুনর্বাসন না দিয়েই কৃষক পরিবারকে ভিটে-মাটি জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হচ্ছে সরকারকে।                                                                                               

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?