ফেসবুক-র ব্যবসাবুদ্ধি সামাজিক বিভাজন বাড়াচ্ছে!



দীপেন্দু চৌধুরী

ঘটনা বছর দু’য়েক আগের। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর অভিঞ্জতা।মলয়ের স্ত্রী আমাকে ফোন করে অনুরোধ করল ওদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। আমি কারণ জানতে চাইলে বলেছিল, আপনার বন্ধু একটি ঘটনায় খুব বিভ্রান্ত। আমরা ভয়ে ভয়ে আছি। ঠিক বুঝতে পারছি না কী করব! আমি ফোন পেয়ে সেদিনই মলয়দের বাড়ি গেলাম।আমদের অঞ্চলেই থাকে। মলয়ের থেকে যেটা জানতে পেরেছিলাম সেই অভিঞ্জতা তুলে দিচ্ছি।মলয় সামাজিক মাধ্যমে বেশ পরিচিত নাম। বিশেষত ফেসবুকে। দু’বছর আগে মানে ২০১৯ সালে, সেই বছর লোকসভার ভোট ছিল। মলয়ের ফেসবুকে কিছু অনুভূতিপ্রবণ পোস্ট করা হচ্ছিল অপরিচিত প্রোফাইল থেকে।ধর্মীয় সুরসুরি দেওয়ার একটি মেসেজ দেখে মলয় খুব মুষড়ে পড়েছিল। হিন্দু ধর্মে যারা বিশ্বাস করে তাঁদের কাছে রাম-সীতা, হনুমান মহাকাব্যের চরিত্র হলেও ভগবানের মর্যাদা পায়।ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন প্রতিটি ধর্মেই এই সব চরিত্ররা আছেন।তাঁদের নিয়ে অশ্লীল ছবি প্রকাশ হওয়া মানে অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।মলয়ের ফেসবুকে এই ধরণের প্ররোচনামূলক পোস্ট ধারাবাহিকভাবে আসছিল। সেই কারণে ও অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিল।চিন্তিত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল, এই ধরণের পোস্ট যদি কেউ মলয়ের টাইম লাইনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ট্যাগ করে দেয়। তাহলে অঞ্চলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ও আর বাস করতে পারবে না।আমার পরামর্শে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরকে বিষয়টা জানায় মলয়। স্বরাষ্ট্র দফতর মলয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের স্ক্রীনশর্ট পাঠিয়ে দিতে বলে। মলয় পাঠিয়ে দিয়েছিল। পাশাপাশি স্থানীয় থানায় একটা অভিযোগ করা হয়।

আরও একটি ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি। ট্রেনে বসে একটি ছেলে স্মার্টফোনে এক বন্ধুকে বলছে, ফেসবুকে একজন মেয়ের নাম ব্যবহার করে একটা ফেক একাউন্ট খোল। সেই প্রোফাইল থেকে তুই যে ভাবে পারিস প্রচার কর।যাদের তুই টার্গেট করেছিস তাঁদের নামে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠা। কয়কে বছর আগে এই ঘটনা একজন সাংবাদিক শুনে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার আপ ট্রেনে আসার সময় এরকম অভিঞ্জতা হয় তাঁর।বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় ও বৃহৎ সামাজিকমাধ্যম ফেসবুক যে ‘ফেকবুক’ এখন সেই সাংবাদিক বুঝে গেছেন। ফেসবুক ব্যবহারকারী বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে একাধিক ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে থাকেন।এই কারণে ফেসবুক কতৃপক্ষ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ধরতে নিজেরাই একটি ‘ভুয়ো’ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। ২০১৯-এর ৪ ফেব্রুয়ারি। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফেসবুকের আসল স্বরূপ সামনে আস্তে থাকে। অভিযোগ, তিন সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুক কতৃপক্ষের অ্যাকাউন্টের ইউজার ভরে যায়। ভুরি ভুরি বিদ্বেষের বিষ, ভুয়ো তথ্য, ফেক নিউজ, সাজানো ছবি ও ভিডিও জমা পড়তে থাকে। প্ররোচনামূলক মেসেজের ছড়াছড়ি। যা দেখে ফেসবুকের কর্মীরাই চমকে উঠেছিলন। 

মাত্র তিনসপ্তাহের নিউজ ফিড পর্যালোচনা করে ফেসবুকের তৎকালীন কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেন একটি নোট তৈরি করেন। ৪৬ পাতার সেই নোটে তিনি লিখেছিলেন, ‘’ওই তিন সপ্তাহে এত মৃত মানুষের ছবি দেখেছি, যা সারা জীবনে দেখিনি।‘’ ওই একই নোটে উল্লেখ করা হয়, বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যা প্রচারের পোস্টগুলি ছেঁকে বাদ দেওয়ার জন্য ফেসবুক কতৃপক্ষের যে অর্থ খরচ হয় তার বেশিরভাগ টাকাই খরচ করা হয় আমেরিকার ইউজারদের জন্য।মার্কিন সরকারের নিরাপত্তার কারণে। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকেই ফ্রান্সিস হাউগেন মার্কিন সেনেটের সামনে শুনানিতে জানিয়েছিলেন, ভারতে আপত্তিকর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভাষ্য, প্রতিবেদন, ছবি ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, সব কিছু জেনেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে উর্ধতন কতৃপক্ষ কোনওরকম ব্যবস্থা নেয়নি। বিজেপি আইটি সেল কীভাবে ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে সেটা ফেসবুক কতৃপক্ষ ভালোভাবেই জানে।ফ্রান্সিসের ইঙ্গিত বিজেপির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি আঁখি দাসের বিরুদ্ধে।গত বছরই অভিযোগ উঠেছিল, বিজেপির শীর্ষনেত্রী আঁখি দাস বিজেপির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেননি। অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে ভুয়ো খবর ছড়ানো, বিদ্বেষ, ঘৃণার প্ররোচনামূলক খবরের বিরুদ্ধে ফেসবুক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ফেসবুকের ভূতপূর্ব কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন ফেসবুকের কার্যকলাপ সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। যদিও ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ অযৌক্তিক বলে বিষয়টাকে হাল্কা করে দিতে চেয়েছেন। সম্প্রতি আরও কয়েকটি তথ্য আমাদের সামনে এসেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিশেষ কমিটির প্রশ্নের উত্তরে হাউগেন জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের তাড়নায় সামাজিক বিভাজন বাড়ে। সেই প্রক্রিয়ার দু’টো দিক আছে। একটা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী মতামতের অনুসারী যারা তাঁরা সংগঠিত হয়ে আরও বেশি করে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে আক্রমণ শানান শুরু করে। উল্টোদিকে যাদের মত কিছুটা মধ্যপন্থার অনুসারী ছিল তাঁরা আক্রান্ত হয়ে চরমপন্থী হয়ে ওঠে। সংবাদ মাধ্যমের ব্যাখ্যা, ব্যক্তির মতামত আরও অনমনীয় হয়। আর আগে থেকেই যাদের অনমনীয় অবস্থান ছিল তাঁরা নিজেদের শিবিরে বেশি করে সংগঠিত হতে থাকেন। অভিযোগ উঠে আসছে, সামাজিক মাধ্যমের পরিচালকরা সচেতনভাবেই কী নিজেদের ব্যবসায় এই নীতি মেনে চলতে বলেন অধস্থন কর্মীদের? নতুন করে এই বিতর্ক উঠে আসছে। ফেসবুককে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছে সত্য উত্তর সচেতন সাংস্কৃতিক সমাজ।

সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিসরের কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। ঘৃণা-বিদ্বেষ যারা ছড়াচ্ছে তাঁদের নিয়ে আলোচনা প্রতি নিয়ত হলেও নিয়ন্ত্রণ খুব একটা নজরে আসেনা। ফেসবুকের প্রাক্তন কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেনের অভিযোগ থেকে জানা যাচ্ছে, মুনাফার লোভে ফেসবুক তার যন্ত্রমেধা(অ্যালগোরিদম)-র মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষ বিভাজন ছড়াচ্ছে।আম আদমি পার্টি, কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করলেও বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনওরকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি এই অভিযোগ আবারও করেছে আপ, কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলি।নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি বিধানসভার ‘পিস অ্যান্ড হারমনি’ কমিটির কাছে ফেসবুকের তরফে বিবৃতি দেওয়ার কথা ছিল। নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিবৃতি দেওয়ার জন্য আরও ১৪ দিন সময় নিয়েছে ফেসবুক কতৃপক্ষ।১৮ নভেম্বর ফেসবুকের প্রতিনিধিকে এই কমিটির সামনে হাজিরা দিতে হবে। ২০২০ সালের দিল্লি হিংসার ঘটনায় সমাজমাধ্যমের কী ভূমিকা ছিল সেটা বিশ্লেষণ করার জন্য ‘পিস অ্যান্ড হারমনি’ কমিটি গঠন করেছে দিল্লির আপ সরকার।      

কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা ফেসবুক প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেছেন, ‘’আঁখি দাসের কথা আমরা আগেও বলেছি। এখন আবার বলছি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন ফেসবুকের প্রাক্তন ওই আধিকারিক। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, তার পরে দিল্লির হিংসার সময়ে ফেসবুক ভাল ভাবেই জানত, হিন্দি ও বাংলায় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য আটকানোর মতো ছাঁকনির ব্যবস্থা তাদের কাছে নেই। এখন ফেসবুকের যে নথি ফাঁস হয়েছে, তাতে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তার পরেও হিংসা, বিদ্বেষ ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।‘’

একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, প্রতি মাসে বিশ্বের ২৯১ কোটি মানুষ ফেসবুক নামে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমটি ব্যবহার করেন। আমাদের দেশ ভারতে ৪১ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। এই ধরণের একটি জায়ান্ট সংস্থার মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষ, বিভাজনের সংস্কৃতি ও ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে ভারত সরকারের ভূমিকা কী?৮ নভেম্বর সাংবাদিকরা  জানতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখরের কাছে। তিনি বলেন, ‘’ভারতবাসীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না কোনও সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগোরিদম।সামাজিক মাধ্যম নিরন্তর চরিত্র বদল করছে। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই আইনকানুন ও বিচার ব্যবস্থাতে বদল আনতে হবে। সরকার সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।‘’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, ভারতে সামাজিক মাধ্যম তথা ফেসবুক যে নীতি প্রয়োগ করছে, সেটা বর্তমান সরকারের সময়ে বেশি নজরে পড়ছে।গত কয়েক বছরে ফেসবুকের এই প্রবণতা বেড়েছে। তাই সরকার নিজে থেকে উদ্যোগ নিলে ভালো না হলে ভুক্তভোগী মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াবে।                                 

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?