ভারতে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রকে রুখতে বিরোধীরা প্রস্তুত হচ্ছে






দীপেন্দু চৌধুরী

কেন্দ্রের মোদী সরকারের গত সাড়ে সাত মাসের শাসনে দেশবাসীর কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বর্তমান সরকার সংসদীয় গণতন্ত্র মানতে আগ্রহী নয়। সম্প্রতি জোড়া অধ্যাদেশ জারি করে সিবিআই ও ইডি-র ডিরেক্টরদের পাঁচ বছর পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকার আইনি ছাড়পত্র দিল কেন্দ্র। বিরোধীদের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুটি প্রথমসারির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার প্রধানদের কার্যকালের মেয়াদ এক ধাক্কায় পাঁচ বছর বাড়িয়ে নিয়েছে সরকার। বিরোধীদের আরও অভিযোগ, সংসদকে এড়িয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী সরকার একটার পর একটা অধ্যাদেশ জারি করে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াকে একরকম ধ্বংসের পথে নিয়ে এসেছে।

গত ১৫ নভেম্বর জোড়া অধ্যাদেশ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআই ও ইডির প্রধানদের পাঁচবছর পর্যন্ত শীর্ষপদে থাকার ব্যবস্থা করেছে। এই নতুন অধ্যাদেশ আনার আগে যে ব্যবস্থা ছিল, উল্লেখ করা যাক সরকারের সেই আইন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে প্রতিরক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইবি ও র’-প্রধানের মেয়াদ দু’বছরের জন্য বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দু’টি দফতরের কার্যক্রমের গোপনীয়তা রক্ষা একটি দেশের সরকারের কাছে রক্ষা কবচের সমান।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন কেন্দ্রের এই দু’টি দফতর তাই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। গত ১৫ নভেম্বর সরকারের আনা নতুন অধ্যাদেশবলে এখন থেকে ওই দু’টি দফতরের মেয়াদ আরও দু’বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবে সরকার। সরকারের একের পর এক অধ্যাদেশ আনা নিয়ে বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দল। তাঁদের বক্তব্য অন্যায়ভাবে এই অধ্যাদেশ আনা হয়েছে। তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছেন, ‘’নির্লজ্জ ভাবে অধ্যাদেশ এনে ইডি ও সিবিআই প্রধানের মেয়াদ পাঁচ বছর করা হয়েছে। আসন্ন অধিবেশনে ভারতে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র রুখতে বিরোধীরা একজোট হয়ে সরকারের বিরোধিতা করতে প্রস্তুত।। সংসদের দু’টি কক্ষে ওই অধ্যাদেশ খারিজের উদ্দেশ্যে বিধিবদ্ধ প্রস্তাব আনতে চলেছে তৃণমূল।‘’ কংগ্রেসের বক্তব্য অধ্যাদেশ এনে ধারাবাহিকভাবে সুপ্রিম কোর্টকে অশ্রদ্ধা ও সংসদের অবমাননা করে চলেছে বিজেপি। সরকারের এই নীতিতে বলা হচ্ছে, ইডি ও সিবিআইয়ের প্রধানের মেয়াদ প্রত্যেক বছর বাড়াতে পারবে সরকার। কেন্দ্রের সরকার চালানোর দীর্ঘ অভিঞ্জতার মানদণ্ডে নতুন এই অধ্যাদেশের বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোকপাত করে মুখ খুলেছে কংগ্রেস। কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, তদন্তকারী সংস্থার প্রধান সরকারের কথা মেনে চলছেন, না অবমাননা করছেন তার উপরে নির্ভর করবে প্রতি বছরের পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত।কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেছেন, ‘’লোকসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দল প্রস্তাব আনবে।কারণ এই অধ্যাদেশ অত্যন্ত ভয় ও আতঙ্কের ককটেল। এই অধ্যাদেশ সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগবে না। এই সিদ্ধান্ত সরকারের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগাবে।‘’

কংগ্রেস নেতা সিঙ্ঘভি সংবাদমাধ্যমকে আরও বলেন, ‘’প্রধানমন্ত্রী তদন্তকারী সংস্থার গোপনীয়তা রক্ষা করার উদ্দ্যেশ্যকে সামনে রেখে ব্যক্তিগতভাবে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। আসলে নিজের বন্ধুদের রক্ষা করা ও বিরোধীদের কন্ঠরোধ করে দেওয়া।দেশের নিরাপত্তা নয়, নিজেদের লোকেদের তথা সরকারের নিরাপত্তা নিয়েই মোদী সরকার বেশি চিন্তিত।‘’ সিবিআই বনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একটি মামলায় রাজ্যের আইনজীবী বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট আইনে কেন্দ্রীয় সরকারই সিবিআই গঠন করেছে। তারা কোন অপরাধের তদন্ত করবে, তার তদন্তের এলাকা কী কী হবে, সে সবের যাবতীয় ক্ষমতা সিবিআই কেন্দ্রের থেকে পেয়েছে। ফলে কেন্দ্র ও সিবিআই পরস্পরে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।‘’ কংগ্রেস এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে মধ্যরাত্রে সিবিআইয়ের তৎকালীন শীর্ষ আধিকারিক অলোক ভার্মাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনেছে।কংগ্রেসের বক্তব্য, সিবিআইয়ের তৎকালীন ডিরেক্টর অলোক ভার্মাকে বদলি করে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল রাফাল বিমানের দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া। অলোক ভার্মা রাফাল বিমান দুর্নীতির তদন্ত করলে ঝোলা থেকে বিড়াল বেড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ২০১৯ সালে অলোক ভার্মার ঘটনার পরম্পরা ধরে বিশ্লেষণ করলেই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও রকম ধোঁয়াশা থাকার কথা নয়।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, সরকারের এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝাই যাচ্ছে দেশের চৌকিদার ‘জো হুজুর’ প্রশাসকদের বেশি পছন্দ করেন।

প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, বাকি সব বিষয়ে আমার ঞ্জান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি নিয়ে সন্দেহ না রাখাই ভাল।‘’ ভারতের নাগরিক স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর চৌকাঠের এপারে দাঁড়িয়ে আছে। কেন্দ্রীয় সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে ‘আজাদী কা অমৃত  মহোৎসব’ মহা সমারোহে উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘জয় হোক’  আমরাও বলতে চাইছি।নেহরু-গাঁধি ও আম্বেদকর-প্যাটেলের ভারতের জয় হোক আমরাও বলছি। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতীয় গণতন্ত্রের বিকাশের ধারাবাহিকতার স্রোত পথ হারিয়ে ফেলেছে।গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশের ইতিহাসবিদ, সমাজবিঞ্জানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছে, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ের পরে কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার অত্যন্ত আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। ভারতীয় নাগরিকদের উপর এক ধরণের সংখ্যা গরিষ্ঠতাবাদী শাসন(Majoritarian rule) চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বন করছে তারা। সংসদকে অগ্রাহ্য করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোড়ে অধ্যাদেশ এনে আইন করার পথে হাঁটছে। শেষতম উল্লেখযোগ্য উদাহারণ বিতর্কিত কৃষকবিরোধী কৃষি আইন।                 

গত বছর ইডি-র ডিরেক্টর পদে সঞ্জয়কুমার মিশ্রের দু’বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিশ্বাসযোগ্যতার পুরষ্কার হিসেবে মিশ্রকে ইডি-র ডিরেক্টর পদে আরও এক বছরের জন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২০০৫ সালের কেন্দ্রীয় আইনের শর্ত হিসেবে এই সিদ্ধান্ত সম্ভবত আইন মোতাবেক সিদ্ধান্ত ছিল না। তাই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে মামলা হয়। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, মিশ্রের মেয়াদ আর বাড়ানো যাবে না। বিরোধীদের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল সেই রায়কে এড়িয়ে ঘুরপথে কেন্দ্র অধ্যাদেশ আনল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে সামনে রেখে ইডি প্রধানের স্বপদে রেখে দেওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধিকে চ্যলেঞ্জ করে আবার একটি মামলা হয়েছে ১৭ নভেম্বর। মামলাটি করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী সাংসদ মহুয়া মৈত্র। কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস আগেই ঘোষণা করেছে, আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে সংসদে অধ্যাদেশের বিরোধিতা করা হবে। ২৯ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আইনের অনুমোদন আটকাতে বিলের বিরোধিতা করবে বিজেপি বিরোধী দলগুলি।  

মোদী সরকারের অধ্যাদেশ জারি করে বিল পাস করানোর সংস্কৃতি বহু পুরনো। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সংসদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২২৮ দিনের মধ্যে ৮টি অধ্যদেশ জারি করেছিল। খনি, জমি অধিগ্রহণ, জীবন বিমার প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ সহ আরও কয়কেটি। বিরোধীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে সংসদে প্রতি ১০টি বিলের মধ্যে ৩.৫টি এসেছে অধ্যাদেশের মাধ্যমে। সরকারের দ্বিতীয় দফাতে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে প্রতি ১০টি বিলের মধ্যে ৩.৭টিই অধ্যাদেশ।বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধী দলের নেতৃত্বকে হেনস্থা করতে ইডি-কে ব্যবহার করার উদাহারণ ভুরি ভুরি আছে। বিরোধীরা সংগঠিত ভাবে ২৯ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া শীতকালীন অধিবেশনে প্রতিবাদ জানানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। অধিবেশন শুরুর আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিরোধী গোষ্ঠীর অন্যতম মুখ তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গুচ্ছ কর্মসূচী নিয়ে দিল্লি সফর করে এসেছেন। লোকসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে সনিয়া গাঁধি তৃণমূল সুপ্রিমোর সঙ্গে বৈঠক করতে আগ্রহ দেখালেন না কেন এটা এই মুহূর্তে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কৃষি আইন প্রত্যাহার, ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা, কৃষক আন্দোলনে ৭০০ জন মৃত চাষির ক্ষতিপূরণ, লখিমপুর খেরির ঘটনায় দোষীদের শান্তি সহ আরও অনেক বিতর্কিত বিষয় বিরোধীদের হাতে রয়েছে। শীতকালীন অধিবেশনে আমাদের এখন দেখার, জনবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধীরা কক্ষ সমন্বয় করেন কি না? শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী তৃণমূল সাফ জানিয়ে দিয়েছে আসন্ন সংসদীয় অধিবেশনে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনওরকম কক্ষ সমন্বয় হবে না। তৃণমূলের এই ঘোষণাকে খুব হাল্কা ভাবে না নেওয়াই ভালো বলে মনে হয়। বিরোধী জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে কংগ্রেসের তরফে কক্ষ সমন্বয়ে সব দলের কাছে আহ্বান আগেও যেমন ছিল শীতকালীন অধিবেশনকালেও একই আছে।কূটনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী কৌশল যেমন আছে আবার স্বল্পস্থায়ী কৌশলেরও ভুরি ভুরি উদাহারণ আছে।                                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?