ভোটের আগে জ্বালানি তেল নিয়ে বিজেপির ভোট রাজনীতি






 দীপেন্দু চৌধুরী

ভ্যাট কমিয়ে পেট্রল-ডিজেলে দাম কমানোর জন্য মোদী সরকার সম্প্রতি রাজ্যগুলির কাছে আহ্বান জানিয়েছে।এই আহ্বান জানানোর পরে বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও অধিকাংশ বিরোধী শাসিত রাজ্য ভ্যাট কমাতে রাজি নয়।বিরোধী শাসিত রাজ্য সরকারগুলির যুক্তি, কেন্দ্র উৎপাদন শুল্ক কমানোর জন্য পাল্লা দিয়ে সমানে রাজ্যের ভ্যাটের পরিমাণ কমছে। তার পরে আরও ভ্যাট কমাতে গেলে রাজ্যের কোষাগারে অর্থের টান পড়বে। আগামী বছর পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের আগে বিজেপি চাইছে প্রতিটি রাজ্যেই ভ্যাট কমিয়ে মানুষকে আরও সুরাহা পাইয়ে দিতে।বিজেপির রাজনৈতিক এই কৌশলের অন্যতম কারণ সম্প্রতি বিভিন্ন রাজ্যের লোকসভা ও বিধানসভা(মোট ৩০টি)কেন্দ্রের উপনির্বাচনে দল ধাক্কা খেয়েছে।উপনির্বাচনে বিজেপি লক্ষণীয়ভাবে আসন খুঁইয়েছে।দলের অভ্যন্তরে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষোভ দেখা দেয়। কোনও কোনও বিজেপি শাসিত রাজ্যের নেতৃত্ব সাংবাদিক সম্মেলন করে পেট্রপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টা উপনির্বাচনে হারার অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখও করেন। তার পরেই ৩ নভেম্বর তড়িঘড়ি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার পেট্রল-ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।পেট্রলে লিটার প্রতি ৫ টাকা, ডিজেলে ১০টাকা করে শুল্ক কমিয়েছে সরকার।

৩ নভেম্বর রাত থেকেই উত্তরপ্রদেশ, বিহার সহ এনডিএ শাসিত ১১টি রাজ্য ও জম্মু-কাশ্মীর এ পর্যন্ত ভ্যাট কমিয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি সেদিন পর্যন্ত বিজেপি ও এনডিএ শাসিত ২৭ টি রাজ্য সামান্য হলেও ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।এই কারণেই পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে জ্বালানি তেল নিয়ে বিজেপির ভোট রাজনীতি প্রকাশ্যে এসে  যাচ্ছে। কেন্দ্রের উৎপাদন শুল্ক সামান্য কমানো ও ২৭ টি রাজ্যে ভ্যাট সামণ্য কমাতেই বিজেপি ঢাক ঢোল পিটিয়ে ভোট প্রচারে নেমে পড়েছে।তার উদাহারণ যে সব রাজ্য ভ্যাট কমিয়েছে সেই সব রাজ্যের একটি তালিকা সরকারের প্রচার সংস্থা পিআইবির মাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক।উপনির্বাচনে ধাক্কা খেয়েই বিজেপি নিজেদের কৌশল কিছুটা বদলে তেল কোম্পানিগুলিকে সন্তুষ্ট রেখেই আমজনতাকে করুণা করতে চাইছে। দীপাবলি-দেওয়ালির আগে  লোক দেখানো অন্তঃশুল্ক কমানোতে সাময়িকভাবে হলেও ক্ষতির মুখে পড়েছে পেট্রোল-ডিজেলের ডিলাররা। তাঁদের বক্তব্য, ২-৩ নভেম্বর দীপাবলির আগে প্রচুরপরিমাণে পেট্রোল-ডিজেল তাঁরা মজুত করেছিল পুরনো দামে। ৪ নভেম্বর ভারত পেট্রোলিয়াম বন্ধ ছিল। ৫ নভেম্বর ইন্ডিয়ান ওয়েল বন্ধ থাকার কারণে পেট্রোপণ্য ডিলাররা বেশি করে তেল মজুত করে রেখেছিল। কিন্তু কেন্দ্র হঠাত অন্তঃশুল্ক কমিয়ে দেওয়াতে প্রতিটি ডিলারের লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতি হবে। অভিযোগ পেট্রোল-ডিজেল ডিলারদের।               

বিরোধী শাসিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তীসগঢ়, কেরল, মহারাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ভ্যাট কমাতে রাজি নয়। তাঁদের পালটা যুক্তি, কেন্দ্রীয় সরকার ডিজেলে যে শুল্ক আদায় করে তার থেকে অতি সামান্য অংশ তাঁরা রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নেয়।আদায়ীকৃত শুল্কের শতকরা ৯৫ ভাগই সরকারের কোষাগারে জমা করে।বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের সম্মিলিত দাবি, কেন্দ্র আরও শুল্ক কমিয়ে কোভিড অর্থনীতিতে ভারাক্রান্ত আমজনতাকে সুরাহা দেওয়ার ব্যবস্থা করুক। খেটে খাওয়া মানুষ দয়া করুণা চায় না।কেন্দ্র লোকদেখানোর মতো করে ভোট রাজনীতি করছে বলে মনে করে বিরোধী দলগুলি। দেশবাসীকে রান্নার গ্যাস, জ্বালানি তেল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে অন্তঃশুল্ক কমানোর দাবিও তুলেছে বিজেপি বিরোধী দলগুলি। ৬ অক্টোবর এই দাবিতে সারা দেশে প্রতিবাদ আন্দোলন করে কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলি।গত এক বছরে পেট্রোল-ডিজেলের ওপর চাপানো সমস্ত কর প্রত্যাহার করার দাবিতে কংগ্রেস রাস্তায় নামে।কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা ৫ নভেম্বর দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘’কোভিডের নামে লিটারপ্রতি পেট্রোলে ১৩ টাকা ও ডিজেলে ১৬ টাকা কেন্দ্রীয় কর চাপিয়েছে মোদী সরকার। এখন রেকর্ড হারে জিএসটি সংগ্রহ হওয়ায় এই কর তুলে নেওয়া উচিত কেন্দ্রের।‘’

কংগ্রেস মুখপাত্র এদিন আরও বলেন, ‘’পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন্য এতদিন কোভিড পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসাবে খাড়া করছিলেন। এবার তো কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের রেকর্ড জিএসটি আপনারা নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন। জিএসটি সংগ্রহ কোভিড পরিস্থিতির আগের সময়ে ফিরে গিয়েছে এবং রাজস্ব স্বাভাবিক হয়েছে বলে আপনারা দাবি করছেন। তা হলে দয়া করে কোভিডের সময় চাপানো কর অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিন।‘’কেন্দ্রের মনোহরিনী সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করেছে সিপিএম।পেট্রোলে লিটার প্রতি ৫ টাকা এবং ডিজেলে ১০ টাকা অন্তঃশুল্ক ছাড়ের বিষয়ে এক বিবৃতিতে পলিটব্যুরো জানিয়েছে, ‘’একেবারেই প্রতীকী হ্রাস। এই পদক্ষেপ সাধারণ মানুষকে কোনও স্বস্তি দেবে না।‘’ সিপিএম দাবি করেছে, অন্তঃশুল্কে আরও বেশি ছাড় ও জ্বালানির ওপর চাপানো বিশেষ সেস সরাতে হবে।

দেশে উন্নয়নের ফানুস উড়ছে।তথ্যের অধিকার আইনে প্রকাশ ভারতে প্রায় ৩৩ লক্ষেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।এঁদের মধ্যে ১৭.৭ লক্ষ শিশু ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার।এই তথ্য জানিয়েছে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রক।বিরোধীদের কটাক্ষ বিজেপির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ বিচারধারার এই উদাহারণ! পাশাপাশি আরও একটি তথ্য, বিনামূল্যে রেশন দেবার কেন্দ্রীয় প্রকল্প এই মাসেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।কোভিড মহামারির সময় চালু হওয়া দেশের খাদ্য সঙ্কট মেটাতে প্রধানমন্ত্রী গরিবকল্যাণ অন্ন যোজনা নামে একটি প্রকল্প চালু হয়। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় রেশন কার্ড থাকা প্রতিটি পরিবারকে মাথাপিছু পাঁচ কিলোগ্রাম করে খাদ্যশস্য বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছিল।সম্প্রতি কেন্দ্র ঘোষণা করেছে ৩০ নভেম্বরের পরে ওই প্রকল্প আর চালানো হবে না।৫ নভেম্বর পিটিআই কেন্দ্রীয় খাদ্যসচিব সুধাংশু পান্ডের নির্দেশ টুইট করে এই খবর জনিয়েছে।সম্প্রতি বিশ্বের ক্ষুধা সূচক(গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স)প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইরিশ এইড এবং জার্মান সংস্থা ওয়েস্ট হাঙ্গার হাইলফ। এ বছর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত আরও নেমে হয়েছে ১০১। প্রতিবেশি দেশ নেপাল, পাকিস্তান বাংলাদেশের থেকেও খারাপ অবস্থা। একদিকে পেট্রোল-ডিজেলের সামান্য অন্তঃশুল্ক কমিয়ে ভোটের মুনাফা ঘরে তোলার চেষ্টা উল্টোদিকে গরিব মানুষের কাছ থেকে খাদ্যের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে মোদী সরকার।সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, এই সময়ে সামান্য, অপ্রতুল এই প্রকল্পও বাতিল করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত অপরাধ।যে কথা রাহুল গাঁধি আমাদের আরও সঠিকভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন।                 

পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ে দেশে ধুন্দুমার বিতর্ক চলাকালীন ৬ অক্টোবর রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে টুইট করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি।হিন্দি ভাষায় টুইট করা তাঁর বক্তব্য, ‘’মোদীজীর গাড়ি উল্টো  দিকে ছুটছে। ওই গাড়ির ব্রেকও ফেল হয়ে গিয়েছে।‘’ পরে আরও একটি টুইট করেন কংগ্রেস দলের প্রাক্তন সভাপতি। সেই টুইটে তিনি লেখেন, ‘’উন্নয়নের বাগড়ম্বর থেকে বহু দূরে! লক্ষ লক্ষ পরিবারকে চুলা(উনুন)ব্যবহারে বাধ্য করানো হচ্ছে।‘’ নিজের করা মন্তব্যের সমর্থনে এদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরের পেপার কাটিং জুড়ে দিয়েছেন রাহুল গাঁধি। রাহুল গাঁধির উল্লেখ করা সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ায় বিপিএল শ্রেণিভুক্ত ৪২ শতাংশ মানুষ ফের চুল্লি বা কাঠকুটো জ্বালানি হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

এই সমীক্ষার প্রধান সমীক্ষক প্রভাত কুমার শীট এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১৩টি ব্লকের ১০০টি গ্রামের ৫৬০টি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা করে তাঁরা এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে কেন্দ্রের উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প চালু হয়েছিল। সেই প্রকল্পে পাওয়া গ্যাস ওভেন এবং সিলিন্ডার গরিব পরিবারগুলির অনেকেই গোডাউনজাত করে রেখেছে, অন্যান্য পুরনো দ্রব্যসামগ্রী রাখার ঘরে। আদিবাসী হওয়ার কারণে তাঁরা বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছে।তাঁরা তাঁদের পুরনো অভ্যাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে তিনটে কারণ সমীক্ষা রিপোর্টে উঠে এসেছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস সিলিন্ডারের অপ্রতুলতা এবং লকডাউনের সময় পারিবারিক আয় কমে যাওয়া।এই সমীক্ষা প্রকাশ্যে আসার পরে উজ্জ্বলা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের ফোলানো বেলুন ফেটে গেছে। প্রান্তিক মানুষের সংসার চালানোরমতো আয়ই যদি না থাকে মানুষ গ্যাস সিলিন্ডার কেনার টাকা পাবে কোথায়?                                                                

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?