বাংলায় দল বদলু রাজনীতিতে আরও এক নতুন অধ্যায়




দীপেন্দু চৌধুরী

বাংলার রাজ্য রাজনীতির কুরুক্ষেত্রের লড়াই শেষ হয়েছে।নতুন ময়দানে নতুন শারীরিক ভাষা।দল বদলু’-দের সামনে কেন জানি না সামাল সামাল রব।‘দল বদলু’ নেতাদের কুস্তির লড়াইয়ে রাজনীতির আখড়া সরগরম। ‘মাৎসন্যায়’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী কতিপয় নেতা নিজেদের আখের গোছাতে মঞ্চ বদলে ফেলছে। চলছে দোষারোপের চাপানউতর। ‘মুই ভাল না তুই ভালো’-র এক সম এবং অসম প্রতিযোগিতা। আসল উদ্দ্যেশ্য নিজের গোষ্ঠীর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। কেউ চাইছে নিজের পীঠ বাঁচাতে এবং বৈধ-অবৈধ খাজানার সরকারি নিরাপত্তা। কেউ বা চাইছে নতুন খাজানার নতুন হালখাতা  খুলতে।

বিগত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুরে অমিত শাহের সভামঞ্চে তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারী সহ ১০ জন বিধায়ক, একজন সাংসদ এবং একজন প্রাক্তন সাংসদ দল বদল করে বিজেপি দলে যোগ দিয়েছিলেন। ১২ জনের মধ্যে এক জন এসেছিলেন সিপিএম দল থেকে। এক জন সিপিআই, বাকিরা সব শুভেন্দুর এক সময়ের স্বপ্নের দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে। বাংলায় ‘দল বদলু’ রাজনীতির বা সংস্কৃতির প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তৃণমূল আমলে এই ঘরানা শুরু হয়েছে। সেই কারণেই কি বিজেপির তৎকালীন সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় বলেছিলেন, দলবদল রাজনীতিরই অঙ্গবর্তমানে তিনি নিজেও চিহ্নিত রেসের ঘোড়া হিসাবে! বঙ্গ রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। বিজেপিতে যাওয়ার পরে, মুকুল রায় সকাল বিকেল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করতেন। সংবাদমাধ্যমকে কৃষ্ণনগরের বিজেপি বিধায়ক(বিতর্কিত অধ্যায়)মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ‘’তৃণমূলনেত্রী আমাকে ‘গদ্দার’ বলছেন।‘’ রাজনীতিবিদদের কাছে গদ্দার একটি সহিষ্ণু শব্দ। কারণ রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প।মেধাবী অভিঞ্জ সাংবাদিকরা মন্তব্য করেছিলেন, কূটনীতিতে শব্দ ব্যবহারে পটু হতে হয়। না হলে রাজনীতিকে জীবীকা করতে ব্যর্থতা অনিবার্য। গত বছর কলকাতার এক বিশিষ্ট আইনজীবী  একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘’শুভেন্দুকে আমি ছাত্র রাজনীতি থেকে চিনি। শিশির অধিকারী না থাকলে শুভেন্দুকে এই জায়গায় আসতে হত না। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রথম পর্বে শুভেন্দু ছিল না। যখন আন্দোলন শেষের দিকে তখন শুভেন্দু যুক্ত হয়। ও তৃণমূল দলে থেকে আখের গুছিয়ে নিয়ে গালাগাল দিচ্ছে?  আসলে যারা নিজেরা ঘর ভেঙে অন্য ঘরে যায়, তারা সেই ঘরের কী সাহায্য করবে?’’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা, ওই আইনজীবীর বক্তব্য শুনে বলতে হয়, তবে কি শুভেন্দুবাবু তোলা দুধের সাদা হাতি? পরিবর্তনের রাজনীতি শেষে ক্ষমতার লোভ ও নিরাপত্তার ঘেরাটোপ নিতেই কী বিজেপি দলে যাওয়া? কুবেরের বিষয়-আষয় নিয়ে ‘শান্তির নীড়’-র নিরাপত্তা?  

রাজ্য রাজনীতিতে এখন কি প্রত্যাবর্তনের সময়? নতুন আরও এক অধ্যায়? প্রদর্শনী রাজনীতি শেষে আরও এক আত্মসমর্পণের আখ্যান? সম্প্রতি বিপক্ষ দলের এক অগ্রদানী ব্রাহ্মণ নেতার মাধ্যমে নতুন সেতু তৈরি হয়েছে হয়ত বা। বিপক্ষ দলের প্রাক্তন সেই বিধায়ক, বিধানসভার লবিতে যার পরিচিতি হয়েছিল ‘যমজ ভাই’-য়ের ছোট ভাই হিসাবে। ২৯ অক্টোবর এই প্রাক্তন বিধায়ক বিধানসভায় গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। তাঁকে দেখে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সাদরে নিজের ঘরে নিয়ে যান।বিধানসভা নির্বাচনের সময় উল্লেখিত প্রাক্তন বিধায়কের দল সম্পর্কে শুভেন্দুর মন্তব্য ছিল ‘বিধানসভার ভোটের পরে দেখবেন রাজ্যের একটা দল এসইউসির মতো হয়ে যাবে।’ যুযুধান দু’টি দলের দুই নেতার মধ্যে এ দিন অবশ্য কী কথা হয়েছে আমরা জানি না। দুজনেই নিজ নিজ পরিশীলিত শারীরিক ভাষায় ও পেশাদারী দক্ষতায় এই সাক্ষাৎকারকে ‘সৌজন্য’ সাক্ষাৎকার বলে বর্ণনা করেছেন। সংসদীয় সৌজন্য! হুতমের ভাষায়, ‘আতেরবেলায় সব কিছু বুঝা যায়, বিহান বেলায় লয়।ক্যানে জানিস? আতেরবেলায় খাবার টেবিলে যোগ্য সহখাদক হুলেই সব বুঝা যায়। কে কুন দলের ই সব বুঝার দরকার লায়।’

রাজনীতি সম্ভবনার শিল্প। তবে শুভেন্দু ঘরের ছেলে হোক অথবা পরের ছেলে! ‘ভূত চতুরদশী’ শেষে দীপাবলির আলোয় মুক্তিস্নান বলব? সূত্রের খবর, বিজেপির ২৬ জন বিধায়ক দলের রাজ্য নেতৃত্বকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, ‘’শুভেন্দুকে বিরোধী দলনেতার পদ থেকে সরান, না হলে আমরা দল ছাড়তে বাধ্য হব।‘’ নাম না করে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি এবং বর্তমানে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ ফেসবুক পোস্টে লিখেছনে, ‘’অনেক দালাল নির্বাচনের আগে আমাদের দলে ঢুকে গিয়েছে, কিছু এখনও রয়েছেন। তাঁরা উৎপাত করছেন। সবাইকে বাদ দেব।‘’

২৪ অক্টোবর গোসাবার উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্য থেকেও ছবি কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিজেপি ছেড়ে যারা তৃণমূলে ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের কটাক্ষ করে দিলীপবাবু ওই দিন বলেন, ‘’গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে অনেক বদ লোক ঢুকেছিল। ক্ষমতার লোভে এসেছিল। বিজেপি ক্ষমতা পায়নি বলে আবার পালিয়ে গেছে। ভাল হয়েছে, বিদায় হয়েছে। বিজেপি দূষণমুক্ত হয়েছে।‘’ বিধানসভার চারটে উপনির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার রাজ্যের সমস্ত সাংগঠনিক জেলা সফর শুরু করেছেন। সঙ্গে থাকছেন দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে না। এই অভিঞ্জতার মানদণ্ডে বিজেপি দলে রাজনৈতিক সমীকরণ বুঝতে অনেক সহজ হয়ে যায়। রাজনীতির পাঠশালায় যা দেখা যায় তা শোনা যায় না। আবার যে ভাষ্য আমরা শুনি সেই ভাষ্যের অন্তর্নিহিত দৃশ্য আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের থেকে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তা এরকম, শুভেন্দুবাবু ‘সামাজিক মাধ্যম’-কে নির্ভর করে রাজনীতি করেছেন।‘শুভেন্দু অধিকারী ফ্যান ক্লাব’, ‘দাদার অনুগামী’ আন্দোলন ছিল যে রাজনীতির হাতিয়ার। গণআন্দোলন না করার জন্য এক কথায় গণভিত্তি তৈরি হয়নি তাঁর।হঠাত পড়ে পাওয়া ক্ষমতা আর লোভের বশবর্তী হয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরের নতুন এক ‘দাদা’-র দল সামাজিক মাধ্যমে উঠে এসেছিল। তাঁরাও এখন বুঝতে পারছে ‘আয়ারাম-গয়ারাম’ রাজনীতিতে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। তাই হয়ত ‘দাদার অনুগামী’-রা বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। এক কথায় পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে গেছে। তাই ভূত চতুর্দশী শেষে আবার ‘ঘর ওয়াপসি’-র প্রস্তুতি শুর হয়ে গেছে। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি, আবার বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে ঘর ওয়াপসি? বাংলা যা ভাবে......... থুড়ি রাজনীতিতে বাংলা এখন অন্য রাজ্য থেকে শিখছে।শেখার কোনও শেষ নায়।মূল্যবোধের রাজনীতির অবসান কৌটিল্যের খোঁজে। নতুন চাণক্যের মঞ্চ চেনার অপেক্ষায় বাংলার রাজনীতি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, রাজনীতিতে কাঠের মাথা বলে কি কোনও শব্দ আছে? বহুচর্চিত একটা কথা উল্লেখ করা যায়, রাজনীতির শীর্ষাসনটা ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ নয়!     

এই বিষয়ে আমরা পল্লীসংস্কারক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের উপলব্ধির কথা উল্লেখ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে নিজেদের জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে গ্রামোন্নয়নের প্রয়োজনবোধ করেন তারই ফলশ্রুতি ‘শ্রীনিকেতন’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসেবে নয় একজন সমাজকর্মীর চোখে গ্রামের উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। তিনি নিজের অভিঞ্জতার মানদন্ডে বুঝেছিলেন, উচ্চবিত্তদের অত্যাচারের ক্ষমতা ও তথাকথিত কল্যাণকামী মানসিকতার সামনে শতাব্দীর পর শতাব্দী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁদের আত্মনির্ভরশীলতা, আত্মবিশ্বাস ও সর্বপরি মারাত্মক হল যে তাঁদের আত্মমর্যাদাবোধ তলানিতে পৌঁছে গেছে। তাই তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই নিয়ম, সেই জন্য তাঁরা বাঁচেন। বাকী সব কিছুকে মনে করেন ‘নিয়তি’ বা কপালের লেখা। এখানে জনান্তিকে বলে ফেলতে চাইছি, গণনায়ক হতে গেলে ‘ফ্লুক’ নয় খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের সমস্যার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ থাকতে হবে। ১৩০ বছর পরে উন্নয়নশীল ভারতের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে একই কথা পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে।                                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?