বিজেপিকে রুখতে গোটা দেশ কংগ্রেসের পুনরুত্থান চাইছে




দীপেন্দু চৌধুরী

বিগত সাত আট বছরে জাতীয় কংগ্রেস নামক দলটি কি নিজেদের শতাব্দীপ্রচীন ঐতিহ্য ভেঙে রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে? প্রশ্নটা তুলেছেন, ভাস্কর পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক শ্রবণ গর্গ।দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস নামক একটি জাতীয়তাবাদী দলের অতীতে যে লড়াই দেশের মানুষ দেখতে অভ্যস্ত সেই লড়াই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।শ্রবণ গর্গ বলছেন, আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে বিজেপি নামক একটি স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে একমাত্র জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস।নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় বসার পর থেকে উদার অর্থনীতিকে সামনে রেখে একের পর এক রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছে।জাতপাতের রাজনীতিকে সামনে রেখে সমাজে অস্থিরতার সুযোগ তৈরি করে বিজেপি ভোটের মুনাফা লুটছে। বিশ্বায়ন উত্তর উদার অর্থনীতির সমর্থক প্রথম সারির অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিজেপি সরকারের বিলগ্নিকরণকে উদার অর্থনীতির শর্ত হিসেবে দেখলে আমরা ভুল করব। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে সাত দশক ধরে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত গড়ে উঠেছিল কংগ্রেস সরকারের নেতৃত্বে।আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ‘ডিজিটাল ভারত’ গড়ে তোলার স্তম্ভগুলির মুখ্য কারিগর ছিলেন বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস ঘরানার অভিঞ্জ ব্যক্তিত্বরা। যাদের স্মরণে না রাখলে দেশের সাধারণ মানুষ কোনওদিন আমদের ক্ষমা করতে পারবে না। স্বঘোষিত ‘বিকাশ পুরুষ’ দশ লাখি পোশাকে আধুনিক ভারতের বিঞ্জাপন প্রদর্শন করলেও ইতিহাস অন্য কথা স্মরণে রাখার অধ্যায় পড়তে বলছে।  

আমরা বলতে চাইছি, ‘স্যুট বুটের সরকার’ মাত্র কয়েকজন শিল্পপতির হাতে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাঠামো তথা গণতন্ত্রের দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে।কাকতালীয় হলেও সত্যি ঠিক এই সময়ে কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে আলাদা হাঁড়ির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নতুন একটি গোষ্ঠী ‘কংগ্রেস হাইকমান্ড’ তথা গাঁধি পরিবারকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ শাণিয়ে যাচ্ছে।এক্ষেত্রেও বিজেপির হাত আছে বলে রাজনৈতিক বিশেষঞ্জদের অনুমান।বিরোধী জোটের যূথবদ্ধ মঞ্চকেও ভেঙে খান খান করে দিতে চাইছে নাগপুরের বিশ্বস্ত, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের দুই প্রমূখ।‘মোদী-শাহ’ জুটি জাতীয় কংগ্রেস নামক দলটিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে তাঁদের সমস্তরকমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শক্তির জোরে।   

উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের আগে ১৭ অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ছিল। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধির শারীরিক ভাষা কংগ্রেস নেতৃত্বকে লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে এনেছে। কংগ্রেস সভানেত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, তিনি অন্তর্বর্তী সভানেত্রী হলেও ‘ফুল টাইম’ সভানেত্রী। যাবতীয় সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়ে থাকেন। পাশাপাশি সনিয়া বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির আক্রমণের সমস্ত চ্যালেঞ্জ নিতে কংগ্রেস তৈরি।বিষয়টা উল্লেখা করার অন্যতম কারণ সাম্প্রতিককালে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী কোন্দল। বিক্ষুব্ধ জি-২৩ নেতৃগোষ্ঠীর উত্থান কংগ্রেস রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়।জি-২৩ নেতৃগোষ্ঠীর অভিযোগ ছিল, রাহুল দায়িত্ব নিতে চান না। সনিয়া সভানেত্রী হিসেবে থাকলেও আসলে রাহুল গাঁধি সমস্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর অন্যতম মুখ কপিল সিব্বল সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? ১৭ অক্টোব্রের কর্ম সমিতির বৈঠকে সনিয়ার সাফ জবাব, ‘’আমি বরাবরই খোলাখুলি কথাবার্তার সমাদার করে এসেছি। আমার সঙ্গে ভায়া সংবাদমাধ্যম কথা বলার কোনও দরকার নেই।‘’     

প্রশ্নটা হচ্ছে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কঠোর এই মনোভাব দেখাতে এতটা সময় নিল কেন? শতাব্দী প্রাচীন একটা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের আভ্যন্তরীণ নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে সুযোগ নিতে চাইবে, সংঘ পরিবার তথা বিজেপি। গত কয়েকবছরে সেই ঘটনা আমরা পরিলক্ষিত করেছি।গাঁধি-নেহরু উত্তর যুগে বারে বারে ফিরে আসে ইন্দিরা গাঁধির নাম। একাধিক ইতিহাসবিদ, সাংবাদিকের লেখায় ইন্দিরা গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস কি ভাবে বারে বারে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের  গণতন্ত্রকে মজবুত করেছেন সেই প্রসঙ্গ আমরা পড়েছি। এই নিবন্ধে সময়ের দাবিতে আরও একবার উল্লেখ করা যাক।রাজনৈতিক বিশেষঞ্জদের অভিমত ইন্দিরা গাঁধি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জওহারলাল-কন্যা বলে নয়। সেই সময় ভোট গণনাই হয়নি। কামরাজ নিজের দায়িত্বে দলের অন্যান্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে বলেন, ‘কনসেনসাস’ ইন্দিরার পক্ষে। আরও একটি উদাহারণ ১৯৭৭ সালের ভোটে কংগ্রেস মাত্র ১৫৪টি আসনে জিতেছিল। ইন্দিরা নিজে পঞ্চান্ন হাজারের বেশি ভোটে রায়বরেলী থেকে হেরে যান। কংগ্রেসের ব্যর্থতার পুরো দায় ইন্দিরা নিজে নিয়েছিলেন। এর পরের ঘটনা ভারতীয় গণতন্ত্রে কংগ্রেসের ফের পুনরুত্থান। নিজের হার মেনে নিয়ে দু’মাস পরেই পুরনো আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বমহিমায় ফিরে এলেন ইন্দিরা গাঁধি। সে সময় তাঁর দিন শুরু হত সকাল ৬টায়। শেষ হত রাত তিনটেয়। বিহারের নালন্দায় দলিত-হত্যার পরে তিনি সাড়ে তিন ঘণ্টা কাদাভর্তি রাস্তায় হেঁটেছিলেন। তারপরে কিছুটা রাস্তা হাতির পিঠে চেপে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে যে কথা লেখা আছে। কিছুদিন আগে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির বিজেপির নেতার গাড়ি ৪ জন কৃষক ও একজন সাংবাদিককে পিষে হত্যা করে। যে মামলা আদালতে বিচারাধীন।ঘটনার পরে প্রিয়াঙ্কা গাঁধির ভূমিকাকে রাজনৈতিক বিশেষঞ্জরা ইন্দিরা গাঁধির বিহারের নালন্দার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করছেন।

একের পর এক নির্বাচনে হারের প্রসঙ্গ আসছে। আমাদের মনে হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীর জাতীয় কংগ্রেস দলের এই ভরাডুবি বা বিপর্যয়ের প্রয়োজন ছিল। যারা কংগ্রেস থেকে বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। আজ সেই প্রবীণ নেতৃত্ব আর্থসামাজিক সমাজের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হলেও নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। হয়ত সেই কারণে হতাশ হয়ে নিজেদের কতৃত্ব ফিরে পেতে চাইছেন। ভারতীয় সাধারণ মানুষ ওই সব নেতৃত্বের পোশাকী আচরণ ধরে ফেলেছে। তাই গত এক দশক ধরে কংগ্রেস রাজ্যে রাজ্যে হারছে। রাষ্ট্র বিঞ্জানের বৈঞ্জানিক শর্ত মেনেই কংগ্রেস সাময়িকভাবে ব্যর্থ। নতুন করে দল গড়ে তোলার প্রয়োজনে এই ব্যর্থতারও প্রয়োজন ছিল। সময় হয়েছে নতুন ভোরের। ওই শোনা যায় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী প্রাত্যহিক প্রভাতি  ভৈরবী সুর। কংগ্রেস নামক দলটি যুব নেতৃত্বের অপেক্ষায় ছিল। বিজেপির স্বৈরতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেই নেতৃত্ব এগিয়ে এসেছে। যে কথা দলের ওয়ারকিং কমিটির বৈঠকে ১৭ অক্টোবর সনিয়া গাঁধি উল্লেখ করেছেন।তিনি বলেছেন, গত দু’বছর আমার সহকর্মী, নির্দিষ্টভাবে বললে যুব সম্প্রদায় নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছেন। সামনে থেকে তাঁরা লড়াই করছেন। কৃষকদের আন্দোলনের পাশে থাকা, করোনা প্যানডেমিকের সময় প্রয়োজনীয় ত্রাণ নিয়ে যুব নেতৃত্ব পৌঁছে গেছেন আক্রান্ত  মানুষের বাড়ি। নারী-যুবদের সমস্যাকে তাঁরা প্রচারের আলোয় সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু শ্রেণির উপর ঘৃণিত আক্রমণের প্রতিবাদ কংগ্রেসের যুবদের নেতৃত্বেই হয়েছে। সনিয়া গাঁধি আরও বলেন, আমরা সজাগ আছি। ভবিষ্যতেও কংগ্রেস অতীতের মতই দেশের দায়িত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে।

সনিয়া মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, আপনারা অবগত আছেন যে আমরা সমমনোভাবাপন্ন দল ও ব্যক্তিদের নিয়েই হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নিরুদ্ধে লড়াই করছি। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ভবিষ্যতেও আমাদের এই কর্মসুচী সামনে রেখে কংগ্রেস দল চলবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম ঐক্যবদ্ধ থাকব। যে দাবি জানিয়েছেন শ্রবণ গর্গ। তিনি বলছেন, বিজেপি নামক হিন্দুত্ববাদী দলের সঙ্গে লড়াই করতে পারে শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস।কারণ আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে কংগ্রেসের পরিচিতি আছে। এটাই কংগ্রেসের শক্তি। গত এক দশক কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিজেপি নিজেদের প্রসার করতে পেরেছে। আঞ্চলিক দলগুলির প্রাসঙ্গিকতা মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বেই তাঁদের বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।ভাস্কর পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদকের বক্তব্য, আগ্রাসী বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করতে হলে কংগ্রেসের মজবুত যুব নেতৃত্বকে এগিয়ে আস্তে হবে। এবং তাঁদের মধ্যে বিশ্বাস ও সোহাদ্র থাকতে হবে।

 

গর্গ সাহেবের এই কথার বিশ্বাসযোগ্যতা আমরা খুঁজে পাই রাজমোহন গাঁধির লেখা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জীবনী ‘প্যাটেল এ লাইফ’(Patel A LIFE)গ্রন্থে। বইয়ের ৫৩২ পাতায় তিনি লিখছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বিধাহীন চিত্তে দেশের জন্য লড়াই করেছেন। নিজেদের মধ্যে পার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে। উদাহারণ হিসাবে রাজমোহন উল্লেখ করেছেন সর্দার প্যাটেলের কথা। সর্দার প্যাটেল অসুস্থ হয়ে আহমেদাবাদ যাওয়ার সময় বন্ধু গ্যাডগিলকে বলছেন, ‘’আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও, জওহরের সঙ্গ ছেড়ে চলে যাবে না।পণ্ডিতজির সঙ্গে পার্থক্য যাই হোক না কেন তাঁকে ছেড়ে চলে যেও না।‘’ (Earlier that day Patel said to Gadgil. ‘’I am not going to live. Make me a promise.’’ When Gadgil said yes, the Sardar took his friends hand in his hand and Continued. ‘’Whatever your differences with Panditji, do not leave him.’’) প্যাটেলের বক্তব্য আজও বিভাজনের রাজনীতি চিনতে আমাদের সাহায্য করে। 

সনিয়া যে অন্তর্বর্তী সভানেত্রী সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তিনি অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, কোভিডের কারণে সভাপতি পদে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ওই দিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০২২ সালের অগস্ট সেপ্টেম্বরে দলের সভাপতি নির্বাচন হবে। তত দিন পর্যন্ত সনিয়া গাঁধিই কংগ্রেসের সভানেত্রী থাকছেন। কংগ্রেস নেতৃত্বকে বার্তা দিয়ে সেদিন সনিয়া গাঁধি বলেন, ‘’গোটা সংগঠন কংগ্রেসের পুনরুত্থান চায়। কিন্তু তার জন্য ঐক্য ও দলের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখতে হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।‘’ আমরা অপেক্ষায় থাকব। রাহুল গাঁধি নিজের দায়িত্ব মেনে নিয়ে আবার সভাপতির দায়িত্ব নিচ্ছেন? না নতুন কোনও নাম উঠে আসছে সেটা দেখার জন্য।  

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?