সত্যাগ্রহী অন্নদাতা কৃষকদের পাশে আছে সব বিরোধী দল






দীপেন্দু চৌধুরী   

পুলিশের লাঠির আঘাতে সম্প্রতি সুশীল কাজল নামে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আবাদী মরশুমের সময় সারা দেশে এই মৃত্যু সবুজ-হরিৎ ক্ষেতিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মোদী সরকারের পুলিশ।২৯ অগস্ট হরিয়ানার কারনালে বস্তারা টোল প্লাজার কাছে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছিল আন্দোলনরত কৃষকরা।মোদী সরকারের কৃষি মন্ত্রকের আনা সংশোধিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চা-র নেতৃত্বে গত দশ মাস ধরে টানা আন্দোলন করছেন ভারতীয় কৃষকরা।ইতিমধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি কৃষকের মৃত্যু হয়েছে আন্দোলনে যোগদান করতে এসে। সেই মৃত্যু মিছিলে আরও একজন সংগ্রামী কৃষকের নাম উঠে এল।দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তের সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মোদী সরকার, দিল্লি পুলিশের হাজারো প্ররোচনা সত্বেও কৃষকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ২৮ অগস্ট কারনালে প্রতিবাদী কৃষকদের উপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে পুলিশ। কৃষক নেতারা অভিযোগ করেছিলেন সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনায় বহু কৃষক আহত হন। তাঁদেরই একজন সুশীল কাজল। সেদিনের ঘটনায় কারনালের তৎকালীন এসডিএম আয়ুষ সিংহের দিকে আঙুল উঠেছে। কৃষক নেতৃত্বের অভিযোগ তাঁর নির্দেশেই পুলিশ লাঠি চালায়। ঘটনার দিনেই একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিয়োয় আয়ুষ সিংহকে বলতে শোনা যায়, ‘’একটা লোকও যেন আমার কাছে আসতে না পারে। যদি বা পৌঁছয়, তার মাথা যেন ফাটিয়ে দেওয়া হয়।‘’ পুলিশের লাঠির আঘাতে সুশীল কাজলের মৃত্যুর পরেই শিরোমণি অকালি দলের নেতা মনজেন্দ্র সিংহ সিরসা টুইটারে লেখেন, ‘ওই এসডিএমের নির্দেশে পুলিশ সুশীল কাজলকে মেরেছে। তাঁর মাথায় বার বার আঘাত করেছে পুলিশ’।

কৃষক মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশের কৃষকরা ক্ষোভে ফুঁসছে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষোভ-আন্দোলন আরও তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসকেএম নেতা দর্শন পাল সিংহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কিছুদিনের মধ্যে দিল্লি ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হবে। বিজেপিকে নিশানা করেছেন ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েতও। তিনি বলেছেন, ‘’আপনারা আমাদের খালিস্তানি বলেন, আপনারা তো তালিবান। আমরা গত কাল একটি সরকারি তালিবানকে চিহ্নিত করেছি। তিনি সরকারের এক অফিসার(আয়ুষ সিংহ)।‘’       

সুশীল কাজল নামে কৃষকের মৃত্যু সারা দেশের কৃষকদের লড়াইয়ের মনোবল আরও বাড়িয়ে দিল। তারা শোককে শক্তিতে পরিণত করল।কৃষকদের আন্দোলন আরও ঋজু আরও মজবুত হয়ে উঠছে। ২৯ অগস্টের দিনেই কৃষক সংগঠনগুলির যুক্তমঞ্চ সংযুক্ত কিসান মোর্চা(এসকেএম)ঘোষণা করে, দিল্লি সীমানায় কেন্দ্রের বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের প্রতিবাদে তাঁরা যে আন্দোলন করছে ২5 সেপ্টেম্বর সেই বিক্ষোভের ১০ মাস পূর্তি হবে। ১০ মাস পূর্তি উপলক্ষে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২৬ জুন তিন বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল ও জরুরি অবস্থার ৪৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘ক্ষেতি বাঁচাও, লোকতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসের ডাক দিয়ে সারা দেশে আন্দোলন করেছে সংযুক্ত কিসান মোর্চা। সেদিনের আন্দোলনকে সমর্থন করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি টুইট করেছিলেন, ‘’সিধি বাত হ্যায়, হাম সত্যাগ্রহী অন্নদাতাকে সাথ হ্যায়।(সাফ কথা হল, আমরা সত্যাগ্রহী অন্নদাতাদের পাশে আছি।)‘’

১০ মাস ধরে কৃষকদের টানা আন্দোলন বিজেপি সহ তাঁদের হেড কোয়ার্টার নাগপুরকেও যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সূত্রের খবর, আন্দোলনরত অনড় কৃষকদের সমস্যা না মেটাতে পারলে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাবের বিধানসভা ভোটে ভরাডুবি হবে পদ্মশিবিরের। আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে কৃষকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে,  পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে ভালো ফলের আশা করছেন না সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষ সংগঠন আরএসএস। ৩-৪ সেপ্টেম্বর নাগপুরে ছিল দু’দিনের চিন্তন শিবির।দু’দিনের আলোচনায় মূল আলোচ্য বিষয়ই ছিল পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। পাঁচ রাজ্যে প্রাক নির্বাচনের আগে গোয়া, মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। ওই চার রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, পাশাপাশি পঞ্জাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এমনিতেই অকালি দলের সঙ্গে জোট ভেঙে যাওয়ার পরে ওই রাজ্যে বিজেপির পায়ের তলার মাটি যথেষ্ট দুর্বল। তাই নাগপুর মনে করছে কৃষক সমস্যা না মেটাতে পারলে পঞ্জাবে হার নিশ্চিত। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষক অধ্যুষিত এলাকা নিয়েও বিজেপি সমস্যায় পড়তে পারে।

কৃষক আন্দোলনের পরম্পরা ধরেই ৫ সেপ্টেম্বর বিজেপি রোখার ডাক দিল কৃষকদের মহাপঞ্চায়েত। উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে প্রায় দশ লক্ষ কৃষকের জমায়েত থেকে কৃষক নেতৃত্ব ২০২২ সালে রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানায়।সংযুক্ত কৃষক মোর্চা ২৭ সেপ্টেম্বর সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। পুরো সেপ্টেম্বর মাস জুড়েই কৃষক আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন কৃষক নেতৃত্ব।পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে ৭ সেপ্টেম্বর হরিয়ানার কারনালে মহাপঞ্চায়েত ডেকেছিলেন কিসান মোর্চার নেতৃত্ব।হরিয়ানার বিজেপির খট্টর সরকারের প্রবল দমনপীড়নকে উপেক্ষা করে কৃষক বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল কারনালের মিনি সচিবালয়ের সামনে।বিক্ষোভকে আটকাতে কারনালে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে, ১৪৪ ধারা জারি করে, বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করেও কৃষক বিক্ষোভ আটকাতে পারল না হরিয়ানা সরকারের প্রশাসন। ৭ সেপ্টেম্বর কারনালের মিনি সচিবালয় ঘিড়ে রেখেছেন কৃষকরা। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হতেই আন্দোলনরত কয়েক হাজার কৃষক কারনালের সচিবালয় ঘেরাও করতে যায়।মোতায়েন ছিল ৪০ কোম্পানি পুলিশ, ১০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ব্যারিকেড, জলকামান নিয়ে পুলিশ, আধাসেনা তাঁদের আটকাতে বল প্রয়োগ করে।তবুও কৃষকদের আটকাতে পারেনি কারনাল মহকুমা প্রশাসন।পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে বিক্ষোভরত কৃষকরা।  

গত ২৮ অগস্ট সেই ‘মাথা ভেঙে দাও’ পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে ৭ সেপ্টেম্বর কারনালে ছিল কৃষক মহাপঞ্চায়েত। সভা শুরুর আগে রাকেশ টিকায়েত, গুরনাম সিংহ চারুনি, বলবীর সিংহ রাজওয়ালের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কারনালের জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসে।তিন দফায় প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি।সংযুক্ত কিসান মোর্চার তরফে রাজ্যের বিজেপি সরকারের কাছে নির্দিষ্ট দাবি জানিয়ে বলা হয়, শহীদ সুশীল কাজলের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে। পুলিশের মারে জখম প্রত্যেক কৃষককে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।কৃষক নেতৃত্ব এই দাবিও জানায়, এসডিএম আয়ুষ সিনহার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে। বিজেপি সরকার কৃষকদের ন্যায্য দাবি মানার পরিবর্তে সংঘাতের পথে যায়। কয়েকজন কৃষক নেতাকে আটক করে পুলিশ। এই লেখা যখন লিখছি কারনালের মিনি সচিবাল্যের সামনে সারা রাত বসে আছেন আন্দোলনরত কৃষকরা।                

২৭ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে সিপিআই-সিপিএম, সিপিআই(এমএল)সহ বিভিন্ন বামপন্থী দল।সিপিএম থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়এছে, কৃষি আইন বাতিল এবং ন্যুনতম সহায়তা মূল্যের আইনি নিশ্চয়তার দাবিতে কৃষকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম দশ মাস ধরে চলছে। আলোচনা করে সমাধান বের করার রাস্তা খুঁজতে মোদী সরকার অস্বীকার করছে। এই আচরণের নিন্দা করছে বাম দলগুলি। নতুন তিন বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করার দাবিও জানাচ্ছে বামপন্থী দলগুলি। তারা আরও দাবি করছে, ফসল বিক্রি করার ক্ষেত্রে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য(এমএসপি)-র উল্লেখ নতুন আইনে রাখতে হবে। কৃষকদের আন্দোলনকে গত দশ মাস ধরেই কংগ্রেস সমর্থন করে আসছে।সংসদে বাদল অধিবেশন চলার সময় সাংসদ রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস সাংসদরা ট্র্যাক্টর চালিয়ে সংসদ অভিযান করে। এই অভিযান ছিল বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের যে দাবি কৃষকরা করছে, সেই দাবি সংসদে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিকী আন্দোলন।কংগ্রেস বলছে, সাফ কথা হল, আমরা সত্যাগ্রহী অন্নদাতাদের পাশে আছি।                                     

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?