ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে দিল কৃষক আন্দোলন







দীপেন্দু চৌধুরী

কেন্দ্রের বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের প্রায় এক বছর পূর্ণ হবে আর কিছুদিনের মধ্যে। সমস্ত রকমের দমন-পীড়ন চলিয়েও মোদী সরকার কৃষক আন্দোলনকে নিজেদের কব্জায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।দেশের প্রায় ৩০০টি কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’-র নেতৃত্বে আন্দোলনকে বিন্দুমাত্র দুর্বল করতে পারেনি মোদী সরকার। উল্টে যত দিন যাচ্ছে কিসান আন্দোলন আরও মজবুত হচ্ছে।ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে দিয়েছে ভারতীয় কৃষকরা। ২৫ ও ২৭ অগস্ট কিসান মোর্চার ডাকে একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেনশনে যোগ দিয়েছিল ৩০০টির বেশি কৃষক সংগঠন। ১৮টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-যুব মহিলা সংগঠন এবং শিল্প ভিত্তিক ফেডারেশন। এই ফেডারেশন থেকেই ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। ২৭ তারিখ ভারত বন্ধের সমর্থনে রাজ্যে রাজ্যে মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা সহ বিভিন্ন রাজ্য এই সব মহাপঞ্চায়েতের উপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন চালিয়েও কৃষক আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ বিভিন্ন রাজ্য সরকার।ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেই সাম্প্রতিক কালের কৃষক আন্দোলন যেন সবুজ-হলুদ ক্ষেতের গদ্য কবিতা। আন্দোলনের শপথ, শপথের প্রাচুর্যে ভরা উত্তরণের নতুন ভাষা।    

আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, রাজস্থান সহ পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন আছে।তাই কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের আরাম-আয়াস ঘুম টুটে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বঘোষিত দুই সম্রাটের যুগলবন্দি। পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে ‘মোদী-যোগী’-র নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মঞ্চ প্রস্তুত করতে নেমে পড়েছে বিজেপি। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে মোদী শ্মশান ও কবরস্থানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র সচেতন ভারতীয় নাগরিকদের নিশ্চয় মনে আছে। মেরুকরণের ফায়দা তুলতে হিন্দু সম্রাট মোদীকে নামিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। ২০১৭ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মোদী বলেছিলেন, ‘’গ্রামে কবরস্থান তৈরি করা হলে শ্মশানঘাটও তৈরি করতে হবে।রমজানের সময়ে বিদ্যুৎ দেওয়া হলে, দীপাবলির সময়েও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।‘’ হিন্দি বলয়ের রাজনীতিতে ‘হিন্দুত্ব’ রাজনীতি ভালো খায়। তাই দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি ধরে রাখতে ‘আব্বাজান’ রাজনীতি আমদানি করলেন ‘ছোটা হিন্দু সম্রাট’ যোগী আদিত্যনাথ।

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের কুশীনগরের এক জনসভায় ছোটা হিন্দু সম্রাট যোগী বলেন, ২০১৭ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে গরিবরা রেশন পেতেন না। কারণ কি? বিজেপির রাজনীতির ঘরানা যে রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছোটা হিন্দু সম্রাট সেই রাস্তা বেছে নিলেন। সেই রাস্তা হচ্ছে রাজনৈতিক মেরুকরণের কৌশল। যোগী নিজের দলের ভোট ব্যঙ্ক ধরে রাখতে আমদানি করলেন ‘আব্বাজান’ শব্দ। যোগী আদিত্যনাথ বলেন, ‘আব্বাজান বলা লোকজনরাই সব রেশন হজম করে ফেলতেন’।আমাদের মনে রাখতে হবে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (বিজেপির হিন্দুত্ব রাজনীতির ছোটা সম্রাট) সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবকে ‘আব্বাজান’ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, প্রায় এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের কারণে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ সম্প্রদায় এখন বিজেপির রাজনীতিতে আস্থা হারিয়েছেন। ২০১৭ সালে ‘মোদী-যোগী’-র যুগলবন্দি জাঠ-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে বিজেপির ঘরে মুনাফা তুলে দিতে পেরেছিলেন।যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিজেপি। কৃষক আন্দোলন জাঠ নেতা রাকেশ টিকায়েতের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। মুজফফরনগরের মহাপঞ্চায়েত থেকেই এই ছবি পরিষ্কার হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক অশান্তির বেদনাদায়ক যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলে মুসলমানদের সঙ্গে জাঠদের কৃষি আন্দোলনকেন্দ্রিক ‘কমরেডশিপ’ গড়ে উঠেছে। সম্প্রীতির বাতবরণ ঐতিহাসিক চিরন্তন সামাজিক বন্ধনকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওরা ভয় পাচ্ছে। তাই হিন্দুত্ববাদী গবেষণাগার থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘আব্বাজান’ কূটনীতি।

 

তাঁর গৌরব গাঁথা লেখা আছে আফগানিস্তান-রাশিয়ায় 

উত্তরপ্রদেশ নিয়ে যারা চর্চা করেন। তাঁরা বলছেন, জাঠ ভোটের সঙ্গে মুসলমান আবেগ ভেদাভেদ ভুলে ‘কৃষক ঐক্য’-র ছন্দ গড়ে তুলতে সহায়ক হচ্ছে। সেই কারণে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এক জাঠ নেতাকে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনতে হল। পালটা রাজনীতির কৌশলকে অবলম্বন করে নতুন চিত্রনাট্য তৈরি করতে হচ্ছে। হিন্দু-জাঠ ভোট ব্যঙ্কের কথা মনে রেখে  রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের গৌরবান্বিত অধ্যায়কে কবর খুঁড়ে তুলে আনতে হচ্ছে।মেরুকরনের নতুন চিত্রনাট্যের সংযোজিত অধ্যায়, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করেও তিনি রাজার স্বীকৃতি পাননি। জাঠদের মধ্যে এই ক্ষোভ উসকে দিতে ভোট আসরে নেমে পড়েছেন ভারতের ‘হিন্দু সম্রাট’ নরেন্দ্র মোদী নিজেই।১৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে ‘জাঠ রাজা’ নামে খ্যাত মহেন্দ্র প্রতাপ সিংহের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসকে আড়ালে রেখে নতুন কৌশল নিলেন ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দস্তান’ রাজনীতিতে সুপটু হিন্দু সম্রাট মোদী। জাঠ নেতা মহেন্দ্র প্রতাপের স্বাধীনতা আন্দোলনে কতটা অবদান ছিল সেই বিষয়কে তুলে ধরে জাঠ ভোট নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি।আসল লক্ষ্য একদিকে জাঠ সমাজের মন জয় করা, পাশাপাশি আলিগড়ের মতো এলাকায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা করে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণকে উসকে দিতে চাওয়া। ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মহেন্দ্র প্রতাপ কোনও দিনই ‘হিন্দু নেতা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন না।তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর গৌরব গাঁথা লেখা আছে আফগানিস্তান, রাশিয়ায়।১৯৫৭ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের (নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে বিজেপি) প্রার্থী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে হারিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৫ সালে আফগানিস্তানে ভারতের প্রথম প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।নিজেকে সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদের’ ডাক দিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত ছিলেন রাশিয়ার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে মহেন্দ্র প্রতাপ ক্রেমলিন যান লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে বিদেশমন্ত্রকের সুসম্পর্ক ছিল। আলোচনার দিন সকালে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন মৌলনা বারকাতুল্লা। লেনিনের বিনয়ী আচরণে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আপ্লূত ভাষায় নিজের লেখার বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, লেনিন প্রথমেই জিঙ্গাসা করেন, কোন ভাষায় কথা বললে সুবিধে হবে। ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি না রুশ ভাষায়? অবশ্য আলোচনা হয় ইংরেজিতে।নিজের লেখা ‘ভালোবাসার ধর্ম’ বইটি উপহার হিসেবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক নেতা লেনিনের হাতে তুলে দেন। কমরেড ভ্লাদিমির লেনিন বইটি হাতে নিয়েই মহেন্দ্র প্রতাপকে বলেন, বইটি তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছে। এই বৈঠকের পরেই আফগানিস্তানের রাজা আমানুল্লাহ খানের সঙ্গে রাশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রদূতকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মহেন্দ্র প্রতাপকে বলে রুশ বিদেশমন্ত্রক। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টা খুব কিছু জরুরি ছিল না। ক্রেমলিন জানত মহেন্দ্র প্রতাপের সঙ্গে আমানুল্লাহ খানের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা। ১৯৩২ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয় তাঁর নাম

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সৈয়দ আহমেদ খানকে জমি দিয়েছিলেন। এই বিষয়টা হিন্দু সম্রাট মোদী নিজেও জানেন। কিন্তু মেরুকরণ বড় বালাই। উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে ভোট।কৃষক আন্দোলন এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব রাকেশ টিকায়েত সহ কৃষক নেতৃত্বকে ক্রমান্বয়ে আক্রমণ করছে। হরিয়ানার  কারনালে কৃষকদের ‘মাথা ভাঙা’-র নির্দেশ দেওয়া আমলা এসিডিএম আয়ুষ সিনহার বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার তদন্তে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে।কারনালে টানা সাত দিন ধরে কৃষক বিক্ষোভের কারণে।২৭ সেপ্টেম্বর ‘ভারত বন্ধ’-র কারণে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়বে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্য প্রশাসন। কারণ সিপিআই, সিপিএম, সিপিআইএমএল(লিবারেশন) সহ বিভিন্ন বাম দল ২৭ তারিখের ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে। কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়ন আইএনটিইউসি-র পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ শাখাও ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার করছে। সম্প্রতি কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জমি অধিগ্রহণ বিলের সমস্ত কৃতিত্ব রাহুল গাঁধির।তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কৃতিত্ব কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধির।বিজেপি রাহুলকে অপদস্ত করছে।’ স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিকে পরাস্ত করতে শ্রমিক-কৃষক, মজদুরদের আন্দোনের উপর আমাদের ভরসা করতেই হবে।                                                        

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?