মনুষ্যত্বের একটি স্থির অগ্নিশিখা তিনি আমাদের মননে আছেন




দীপেন্দু চৌধুরী

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিজের কথা বলতে চেয়েছে। অন্যের কথা শুনতে চেয়েছে। সেই কারণে সংরক্ষিত তালপাতার পুঁথি থেকে আমরা আমদের অতীত জানতে পারি। পুরাণ লেখার সময় পার হয়ে চর্যাপদ পদ্যের উত্থান আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য-সংবাদ মাধ্যমের শতাব্দী প্রাচীন প্রজন্মের হাতে লেখা পুঁথি বর্তমান একুশ শতকের  সভ্যতায় পৌঁছতে সাহায্য করেছেজন্মের পরেই মানুষের প্রধান চাহিদা হল সে কিছু জানতে চায়। সে কিছু বলতে চায়। মানব সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি মৌলিক অধিকারের শর্ত হিসেবে স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র দিয়েছে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার একজন ব্যক্তির মনের ভাব প্রকাশ করার জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃতিকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলা যেতে পারে অথবা আইনসিদ্ধভাবে প্রদত্ত প্রাপ্য অধিকার বলা যেতে পারে।

বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রথম প্রকাশ হয় ১৭৮২ সালের ২৯ জানুয়ারি। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। নিরপেক্ষ সংবাদ সাপ্তাহিকটির স্লোগান ছিল, ‘’সকল পক্ষের জন্য উন্মুক্ত, তবে কেউই প্রভাবিত নয়’’। হিকির বেঙ্গল গেজেটের উত্তীর্ণ সময়কালের মানদণ্ডে একুশ শতকের উঠোনে সংবাদ মাধ্যম বর্তমানে আরও অনেক অনেক আধুনিকআরও উজ্জ্বল হয়েছে। সারা বিশ্বে মোট ১৯২ টি দেশ আছে। তারমধ্যে প্রায় ১১৭ টি হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দেশ। ১১৭ টি দেশেই গণতন্ত্রের সংবিধান থাকলেও, স্বাধীন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এমন দাবি করা সম্ভব নয়১১৭ টি দেশে নয় মাত্র ৬০টি দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। আবার এটাও সত্যি যে, এই সব দেশের সংবাদপত্রের চরিত্র এক রকমের নয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। সংবাদপত্র গঠনে এবং স্বাধীনতায়।         

ধ্রুপদী সাংবাদিকতায় যারা নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। যারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন তাঁদের খুঁজে খুঁজে চিনুন। আপনার বাড়ি, আমার আঙ্গিনায় তারা আজও নিঃসঙ্গ। অর্বাচীন। সংবাদ মাধ্যমের সেইসব সৎ, নির্ভীক, নিরপেক্ষ কর্মীরা কব্জির মোচড়ে দেশ দুনিয়ার প্রশাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিতে পারে। সোশ্যল মিডিয়ার আধুনিক যুগে যেমন এটা সত্যি। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালেও নিরপেক্ষ স্বাধীন সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকের ইতিহাস আমাদের মনন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ভাবতে গেলে অবাক লাগে ২০০ বছর পরেও এমনই একজন সাংবাদিক আজও আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার আবেদন নিয়ে সামনে রয়েছেন। তাঁকে আমরা যেমন চিনি উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক হিসেবে। যুগপুরুষ হিসেবে। তিনি ছিলেন কুসংস্কার মুক্ত একজন আধুনিক যুগোতীর্ণ ব্যক্তি। তার স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বিধবা বিবাহের সমর্থনে নতুন আইনের জন্য লড়াই ইতিহাস হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে আজও তিনি প্রাতঃস্মরণীয়পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা বলছি।

স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে এই ঘটনা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাস্তব চিন্তার অন্যতম উদাহারণ। ‘’.........প্রথম থেকেই বেথুনের সঙ্গে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালাঙ্কার আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন। মদনমোহন ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মী। এই দুই পণ্ডিত বন্ধুর কাছে স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অবিভক্ত বাংলা অনেকটা ঋণী। স্কুল প্রতিষ্ঠার পরেই বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে তার অবৈতনিক সম্পাদকরূপে কাজ করার জন্য অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগর সাগ্রহে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন (ডিসেম্বর ১৮৫০)। দূর থেকে ছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য বেথুন সাহেব একটি ঘোড়ার গাড়িরও ব্যবস্থা করেন। সম্পাদক বিদ্যাসাগর সেই গাড়ির পাশে ‘কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষাণীয়াতি যত্নতঃ’- এই শাস্ত্রবচনটি খোদাই করে দেন। শাস্ত্রের দোহাই না দিলে এ দেশের লোককে কিছুই বোঝানো যাবে না, এ কথা তিনি জানতেন। শাস্ত্রবচনের অর্থ পুত্রের মতো কন্যাকেও যত্ন করে পালন করতে ও শিক্ষা দিতে হবে..................।‘’ ( বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, পৃষ্ঠা- ২১৯ )

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষের (২০২০) লেখা লিখতে লিখতে ভারতীয় নারীদের অসহয়তার কথা বার বার মনে আসছে। উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে, আজও হ্যা আজও আমাদের এই দেশে নারীর উপর নির্যাতন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা করে চলেছে। শাস্ত্রের উদাহারণ দিয়ে বর্ণের ভেদাভেদ করে দলিত হিসেবে চিহ্নিত নারীর উপর অত্যাচার আজও আমাদের দেখতে হচ্ছে। মনুবাদী সমাজপ্রভুদের নারীদের উপর অত্যাচার আজও সমানে হয়ে চলেছে। বিদ্যাসাগর প্রধান যে দু’টি কাজ করে গেছেন, ১) আধুনিক পাশ্চাত্য ঞ্জানবিদ্যার সঙ্গে আমাদের দেশের ধ্রুপদী সংস্কৃতবিদ্যার যোগাযোগের মাধ্যম গড়ে তোলা। ২) বাংলায় শিক্ষা প্রচলন। এই সব কাজের জন্যই বিদ্যাসাগর সাংবাদিক হিসবে খাগের কলম ধরেছিলেন।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাংবাদিকতার সুবাদে তার সময়কালের প্রথমসারির সংবাদপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন তত্ববোধিনী পত্রিকা, সোমপ্রকাশ, সর্ব শুভঙ্করী, এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সঙ্গে নিয়মিত কলমচি হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। উল্লেখিত পত্রিকাগুলিতে নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বিধবা বিবাহ আইনের পক্ষে তার ক্ষুরধার কলম ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজের মাথা ব্যথা। ব্রিটিশ সরকারও বিদ্যাসাগরের কলমকে যথেষ্ট সমীহ করত। বিধবা বিবাহ বিষয়ক লেখগুলি নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে পাল্টা লেখা হয়েছে। তাঁকে বিদ্রুপ করা হয়েছে। তৎকালের অভিজাত সম্প্রদায়, সমাজ সংস্কারক বিষয়ক লেখাগুলির জন্য বিদ্যাসাগরকে এক ঘরে করে রাখতেও দ্বিধা করেনি।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন বলেই বেশিরভাগ পত্রিকা গোষ্ঠী বিদ্যাসাগরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তত্ববোধিনী পত্রিকা ১৬ অগস্ট ১৮৪৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকাশ করেন। তত্ববোধিনী সভার মুখপত্র হিসাবে এই সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। উনবিংশ শতাব্দীর ঋত্বিকদের নিয়ে ছিল এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন নিজে ছিলেন। সম্পাদকমণ্ডলীতে নিয়েছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু এবং রাজেন্দ্রলাল দত্তকে। তত্ববোধিনী পত্রিকা ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রথম আঞ্চলিক ভাষায় সংবাদ প্রকাশ করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। দেশীয় আঞ্চলিক ভাষা বলতে বাংলা ভাষায় এই পত্রিকা প্রকাশ করে হত। বাক্য গঠনে নতুন ছন্দ, নতুন ধারার প্রচলন করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল তত্ববোধিনী পত্রিকা। সংবাদ মাধ্যমকে আধুনিক করে তুলতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন বিদ্যাসাগর।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ভারতীয় সংবাদপত্রে আধুনিকতার ছাপ আনতে প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিল তত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী। ধর্ম বিষয়ক লেখা প্রকাশ করা ছাড়াও সমাজ সংস্কারক বিষয়ক লেখাগুলিকে সম্পাদকমণ্ডলী বিশেষ নজর দিয়ে প্রকাশ করত। ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল। চল্লিশ বছর বিদ্যাসাগর ছিলেন এই পত্রিকার একাধারে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, সাংবাদিক, লেখক এবং অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। সেই সময় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্র ছিল তত্ববোধিনী পত্রিকা। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার অংশীদারত্ব কিনেছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকা গোষ্ঠীর অংশীদার হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি।                   

সাংবাদিক হিসেবে বিদ্যাসাগরকে জানার পরে তার সুদৃঢ় ঋজু ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার অধ্যায়ের কিছুটা অংশ দেখে নেওয়া যেতে পারে। বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের মধ্যে পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের বিষয়ে জানা যায় তিনি একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এক তেজোময় ঋজু স্বভাবের ব্যক্তিত্ব ছিলেন রামজয়। পিতামহ রামজয়ের চারিত্রিক গঠনটি বিদ্যাসাগর বংশ পরম্পরায় অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরচরিতে লিখেছেন, ‘’............ এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোন সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয় সম্পদের উত্তরাধিকার বন্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্রমাহাত্ম্য অখন্ডভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়াছিলেন।‘’

বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের একটি পাঠে গোপালের এবং অন্য একটি পাঠে রাখালের গল্প আছে। গোপালদের কথা তিনি যেমন লিখেছেন দুষ্টু ছেলে রাখালের জন্যও সমান শব্দ বরাদ্দ করে তিনি লিখেছেন, ‘’যে রাখালের মতো হইবে সে লেখাপড়া শিখিতে পারিবে না।‘’ রাখাল অন্য কোনও কাজ করতে পারবে কি পারবে না, সেই বিষয়টা সচেতনভাবে উহ্য রেখেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন মনুষত্বের একটি স্থির অগ্নিশিখা। তিনি আমাদের মননে আছেন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আছেন। দীপ্যমান প্রজ্বলিত শিখা হয়ে।

(এই লেখাটি ২০২০ সালে একটি পত্রিকার জন্য লিখেছিলাম। করোনা আবহে সেই পত্রিকা আজ পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি।)            

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?