বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য টেনে নামাতে চাইছে কে বা কারা!
দীপেন্দু চৌধুরী
বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের যে সব ঘটনা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে
এক টানা ঘটে চলেছে তা কোনও আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশ্বভারতী তথা সবুজ ঘেরা
কবিগুরুর মুক্ত সংস্কৃতির শান্তিনিকেতন সংবাদ মাধ্যমের পাতায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা
হচ্ছিল।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে ধ্বংস করাই বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর
মূল লক্ষ্য। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে কেন্দ্রের চরম রবীন্দ্র দর্শন বিরোধী
হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের আশীর্বাদের হাত তার মাথার ওপরে। সমস্ত শান্তিনিকেতন আশ্রমকে
এই উপাচার্য এক বন্দি শিবিরে পরিণত করেছেন। এই সব সংবাদ দেখে বাংলার বিদ্বৎজ্জন সমাজ
ভীষণ মুষড়ে পড়ছিলেন। সারা বিশ্বের মুক্ত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র
করে এই অবাঞ্ছিত বিতর্ক ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের পৌরহিত্যে আম্রকুঞ্জের
শিক্ষকদের হাতে গড়ে ওঠা মুক্ত প্রাঙ্গণকে অপ্রাসঙ্গিক আমলাতন্ত্রের বন্ধনে বেঁধে রাখা,
কেউ মানতে পারছেন না।তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তারপরেও কতৃপক্ষ ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘাত
চলতেই থাকে। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরেও বিশ্বভারতীর তিন ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কারের
সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবতীর নেতৃত্বে বিশ্বভারতীর আমলাতান্ত্রিক
কতৃপক্ষ। ৮ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল তিন বহিষ্কৃত ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসে
যোগ দেওয়ার। কিন্তু তারপরেও ওই তিন ছাত্রছাত্রী ক্লাসে যোগ দিতে পারেননি। সেদিন বহিষ্কৃত
ছাত্র সোমনাথ সৌ বলেন ‘…উপাচার্য নিজেকে আইনের ঊর্ধেব ভাবলে আদালত ব্যবস্থা নেবে বলেই
আমাদের আশা।’ বিশ্বভারতীতে লাগাতর ছাত্র আন্দোলনের প্রধান দাবিই ছিল, সোমনাথ সৌ, রূপা
চক্রবর্তী ও ফাল্গুনি পান নামের তিন জনের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা। ৮ সেপ্টেম্বরের
নির্দেশে হাইকোর্ট বিশ্বভারতী কতৃপক্ষের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের উপরে অন্তর্বর্তীকালীন
স্থগিতাদেশ জারি করে। একই নির্দেশে হাইকোর্ট তিন পড়ুয়াকে ক্লাসে যোগ দেওয়ারও নির্দেশ
দিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও কতৃপক্ষের অনড় মনোভাবের জন্য ওই তিন পড়ুয়া ক্লাসে যোগ দিতে
পারেননি।
বিশ্বভারতীর তিন পড়ুয়াকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কারের যে সিদ্ধান্ত
কতৃপক্ষ নিয়েছিল, ১৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের নির্দেশে সেটা খারিজ হয়ে যায়। হাইকোর্টের
এই নির্দেশকে ‘সঙ্ঘবদ্ধ ছাত্র-আন্দোলনের জয়’ বলে চিহ্নিত করেছে ওই তিন পড়ুয়া। হাইকোর্টের
নির্দেশে তিন ছাত্রছাত্রী ক্লাস করার সুযোগ পেলেও নতুন করে শাস্তির খাঁড়া নেমে এসেছে
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের উপর। তাঁর সাসপেনশনের
মেয়াদ আরও এক বার বাড়ানো হল।এবারেও আরও এক মাস সাসপেনশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ একটি ই-মেল পাঠিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানিয়ে দেয়। কতৃপক্ষের
অগণতান্ত্রিক কাজের প্রতিবাদে যে আন্দোলন বিশ্বভারতীতে হচ্ছে, সেই আন্দোলনের প্রথম
সারিতে আছেন সুদীপ্তবাবু। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে হতে পারে বিশ্বভারতীর চিরন্তন
ঐতিহ্য টেনে নামানো হচ্ছে।কে বা কারা নামাচ্ছেন? যে কথা সম্প্রতি হাইকোর্ট মনে করিয়ে
দিয়েছে।বিশ্বভারতীর বর্তমান পরিস্থিতির জন্য খুশি নয় হাইকোর্টও।১৫ সেপ্টেম্বরের রায়ে
বিচারপতি রাজশেখর মান্থা বিশ্বভারতীর মামলায় মন্তব্য করেছেন, বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যকে
টেনে নামানোর চেষ্টা চলছে।হাইকোর্ট কতৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রী উভয়পক্ষকেই স্পষ্ট ভাষায়
বিচারপতি মান্থা জানিয়েছেন, বিশ্বভারতীতে শান্তি বজায় রাখুন। পাশাপাশি হাইকোর্ট আরও
বলেছে, ছাত্রদের প্রতি বিশ্বভারতীর ব্যবহারে খুশি নয় আদালত।
আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য তাই বর্তমান
বিশ্বভারতীর পরিস্থিতি একটু ফিরে দেখা যাক। ছাত্রদের আন্দোলনকে আড়ালে রেখেই সংলাপ করতে
চাইছি। কবিগুরু শুধুমাত্র শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতনের আশ্রমিকদের জন্য নয়। এতদ অঞ্চল
লাগোয়া গ্রামের মানুষদের জন্য হাসপাতাল করেছিলেন। বিশ্বভারতীর পিয়ারসন মেমোরিয়াল নামে
সেই হাসপাতাল শান্তিনিকেতন লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কেউই এই হাসপাতাল থেকে
চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছেন না। না কতৃপক্ষ এমনতর সিদ্ধান্ত নিয়েই থেমে থাকেননি। বিশ্বভারতীর
অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরাও পিয়ারসন স্মৃতি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পরিষেবার সুযোগ পান না।
শান্তিনিকেতন আশ্রমকে কেন্দ্র করে রয়েছে, সঙ্গীত ভবন, কলাভবন, গৌড় প্রাঙ্গণ, সিংহ সদন,
পুরানো ঘণ্টাতলা, আম্রকুঞ্জ, চিন ভবন। কিছু শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং আশ্রমিকদের অভিযোগ,
এইসব ভবন সহ বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে কারোর প্রবেশাধিকার নেই। কি বলা উচিত? অবাঞ্ছিত আমলাতন্ত্র?
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য দুটি বিষয়কে পাশাপশি রেখেই গ্রামোন্নয়নের
স্বপ্ন ছিল কবিগুরুর। যে স্বপ্নকে সাকার করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন গাঁধিজি। পরে স্বাধীন
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আশ্রমিকদের আরও অভিযোগ, শ্রীনিকেতন কালীসায়র
মোড় থেকে শান্তিনিকেতন পোস্ট অফিস পর্যন্ত রাস্তাটি বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছেমতো
বন্ধ রাখছিলেন। এর জন্য আশ্রমিকদের নিত্যদিন চলাচলে অসুবিধা হচ্ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি
মাসের এক তারিখে রাজ্য সরকার রাস্তাটি অধিগ্রহণ করে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে
দিয়েছেন।
শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর স্রষ্টা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর নিজে কি এই পরিবেশ চেয়েছিলেন? তিনি কি শিক্ষা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় আমলাতন্ত্রকে
প্রশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবতে পারতেন? বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ভূমিকা নিয়ে
বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেই পরিভাষার প্রসঙ্গ রবিন্দ্রঘরানার আশ্রমিকরা ঠিক মেলাতে পারছেন
না। বিশ্বভারতীর সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা।রবীন্দ্রনাথ নিজের
লব্ধ অভিঞ্জতায় সোচ্চারে বলেছিলেন ‘উঁচু দরের ছাত্রদের জন্য বিদ্যালয় খুলি নাই।’ তিনি
ছাত্রদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘……আমাদের
দেশে বিদ্যাশিক্ষার প্রচলিত আয়োজন কঠিন ও কঠোর…কিন্তু আনন্দের ভিতর দিয়ে, মুক্তির হাওয়ার
মধ্যে শিশুচিত্ত যেমন বিকশিত হয়, তেমন আর কিছুতে হওয়া সম্ভব নয়। ……কাজেই যখন দেখলুম
শিশুচিত্ত বিদ্যার নামে বন্দী হয়ে আছে, তখন মন ব্যাকুল হল; যাতে করে শিশুর দুঃখ দূর
হয়, অধ্যাপকের স্নেহে কল্যাণে অভিসিক্ত হয়ে মুক্ত সমীরণে শিক্ষা লাভ করতে পারে, এখানে
তার ব্যবস্থা হল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাবিধির সঙ্গে আপোসরক্ষা করে এর ভিতর
একটা দ্বন্দ্ব রয়ে গেল। তবু এই-যে বালকদের আনন্দ-কলধ্বনি প্রত্যহ আকাশকে মুখরিত করে,
তাদের গানে শালবন আম্রকুঞ্জ ধ্বনিত হয়, এও সামান্য তৃপ্তির কথা নয়।’
১৯১৩ সালের পরে ১০৮ বছর কেটে গেছে। ২০২১ সালের করোনা আবহে আমরা
গৃহবন্দি।সামাজিক বিনিময়টাও একবছর ধরে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক
সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থার কথা কেন বিদ্যুৎবাবু মনে রাখছেন
না? এটাও অভিভাবক হিসেবে তাঁর মনে রাখা উচিত নয় কী? বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য শুধু নয়। মানও
নেমে গেছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রকের প্রকাশিত ‘ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট র্যাঙ্কিং ফ্রেম
ওয়ার্ক’(এনআইআরএফ)-র রিপোর্টের তালিকায় বিশবভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ৯৭ নম্বরে।
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্রমতালিকায় ১৪ ধাপ নেমে ৬৪ নম্বরে দেশের ধ্রপদী
(নোবেল) প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এটাও এক ধরণের শিক্ষা বিপর্যয় বলছেন
প্রবীণ শিক্ষাবিদ তথা আশ্রমিকরা। বিষয়টা কতটা গুরুতর আরও একটা বিষয় উল্লেখ করলে বোঝা
যাবে। সূত্রের খবর, এনআইআরএফ বা ‘নাক’-র সম্ভাব্য পরিদর্শন চাইছেন না উপাচার্য বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী।‘নাক’-র মাপকাঠিতে অবনমনের দায় উপাচার্য বিভিন্ন বিভাগের কাজ যারা করছেন
তাদের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সম্মান’ রক্ষা আগে জরুরি।
বিদ্যুতবাবু আপনি বুঝতে পারছেন, বিশ্বভারতীর আচার্য, উপাচার্য,
শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের আম্রকুঞ্জের আশ্রম।সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের আমলাতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার
শীততাপনিয়ন্ত্রিত সভাঘর নয়।গণতান্ত্রিক ভারতের সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে থেকেই অভিভাবকের
দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে হয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হিন্দি চাপানো
নিয়ে সুর বদলকে আমারা উদাহারণ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছি।কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সহ
দক্ষিণের রাজ্যগুলির অভিযোগ বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্ব ও হিন্দি ভাষা দেশবাসীর
উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘ভাষা দিবস’-র দিন আঞ্চলিক ভাষার পক্ষে সওয়াল
করে অমিত শাহ বলেছেন, ‘’জাতীয় শিক্ষা নীতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে।
অনেকে মনে করেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা পেলে শিশুর মানসিক বিকাশ কম হয়। সেটা ঠিক নয়। খোদ
মোহনদাস করমচন্দ গাঁধি মাতৃভাষায় শিক্ষার উপরে জোর দিয়েছিলেন।‘’
এই নিবন্ধে আজ পুনুরাচ্চারণ করতে চাই, বাংলার সম্প্রীতির শিকড়
অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত।কয়েকশ বছর ধরে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়ের আন্তরিক সাংস্কৃতিক
বিনিময়ের মানদণ্ডে গড়ে উঠেছে এক নিবিড় অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। বহুবর্ণের বৈচিত্রের মিলন।
রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধির সামাজিক ঐকতান। সুফি-বাউল-র আখড়ার সংস্কৃতি এই বাংলা তথা বাঙালিদের
অহংকার। বর্ণাঢ্য সেই চিরন্তন সংস্কৃতি কেড়ে নেওয়ার অধিকার এই উপাচার্য ও তার মুরুব্বিদের
কেউ দেয়নি।
Comments
Post a Comment