বর্তমান উপাচার্যের আমলে বিশ্বভারতীর ‘অচলায়তন’-র দায় কার!





 দীপেন্দু চৌধুরী 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের আখ্যান আমাদের কার কতটা মনে আছে জানি না। রবীন্দ্র বিশেষঞ্জদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ কলামচিদের তুলনা অনেকটা বাতুলতা হয়ে যায়।তাঁরা হয়ত পুরোটাই মনে করতে পারবেন।আমি নিজে রবীন্দ্র বিশেষঞ্জ নই। আমার বয়সের সাথে সাথে স্মৃতিও দুর্বল হচ্ছে। তবে এটুকু মনে আছে, রাজার প্রত্যক্ষ মদতে যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারা ঝর্ণায় বাঁধ দিয়ে শিবতরাই-র মানুষদের মারতে চেয়েছিল। অবশেষে রাজকুমার অভিজিৎ এসে সেই বাঁধ কেটে দিয়ে মুক্তধারাকে অবরোধ মুক্ত করেন।কিন্তু নিজে ভেসে গেলেন সেই প্রবল জলস্রোতে।       রবিন্দ্র-আদর্শানুসারী বিশ্বভারতী নামে একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠানে যে অচলায়তন সৃষ্টি হয়েছে তার দায়িত্ব কার? বিশ্বভারতী নিয়ে হাইকোর্টের ৩ সেপ্টেম্বরের নির্দেশের পরেও অবস্থানে অনড় আছেন আন্দোলনকারীরা। উপাচার্যের বাসভবন থেকে ৫০ মিটার দূরে নতুন মঞ্চ বেঁধে আবারও অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচী শুরু করেছেন তাঁরা। পড়ুয়াদের দাবি, আদালতের নির্দেশ মেনেই নতুন জায়গা ঠিক করে আন্দোলন চলছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী কতৃপক্ষের তরফে একটি গোষ্ঠীর দাবি, ক্যাম্পাসে অবস্থান করে আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা আদালতের রায়কে অবমাননা করছেন।

প্রশ্ন তোলাই যায়, আদালতের নির্দেশ অবমাননার প্রসঙ্গ আসছে কি করে? গণতান্ত্রিক ভারতে আন্দোলন করার অধিকার সমস্ত স্তরের মানুষের আছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে অসহিষ্ণু এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার দায়িত্ব কার? কেন ছাত্রছাত্রীরা অবস্থান আন্দোলন করছেন? বিশ্বভারতীর শিক্ষক-কর্মীদের একটা বড় অংশ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন? বিতর্কিত উপাচার্য ‘মুক্তশিক্ষার আঙিনা’ শান্তিনিকেতনকে শৃঙ্খলাপরায়ণ করার ঔদ্ধত্যে আসলে তিনি ‘গৈরিক ঘরানায়’ উত্তীর্ণ করতে আগ্রহী।প্রবীণ আশ্রমিকদের অভিমত এমনটাই। 

বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাননি। ১৯০১ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মাচর্যাশ্রম বিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। শিক্ষানীতি ছিল আবাসিক বিদ্যালয় কেন্দ্রিক।বিকল্প বিদ্যালয় শিক্ষার কথা যারা বলেন, এই আঙিনায় পথিকৃৎ যাঁরা, তাঁদের চিন্তা, দর্শনও বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষা নিয়েই। তাঁরা বিদ্যালয় উত্তর শিক্ষা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত ছিলেন না।কারণ শিশুর মন নতুন কিছুকে গ্রহণ করার জন্য উন্মুক্ত আকাশের নীচে ছুটে বেড়ায়, ঘুরে ঘুরে, ঘুরে বেড়ায়। গাছ, পাখি, আকাশ শিশুর মনন তৈরি করে। বিদ্যালয় উত্তর শিক্ষার বেড়া ভাঙতে সাহায্য করে। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘এই কথাটা অনুভব করেছিলাম, শহরের খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে মানবশিশু নির্বাসন দন্ড ভোগ করে। তার শিক্ষাও বিদ্যালয়ের সংকীর্ণ পরিধিতে সীমাবদ্ধ। গুরুর শাসনে তারা অনেক দুঃখ পায়। এ সম্বন্ধে আমার নিজেরও অভিঞ্জতা আছে।কখনও ভাবিনি আমার দ্বারা এর কোনও উপায় হবে। তবু একদিন নদীতীর ছেড়ে এখানে এসে আহ্বান করলুম ছেলেদের। এখানকার কাজে যে উৎসাহ এসেছিল সেটা সৃষ্টির আনন্দ। ……প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষ হয়ে এখানকার ছেলেদের মন বিকশিত হবে। আবরণ ঘুচে যাবে, কল্পনায় এই রূপ দেখতে পেতাম।’ তারও আগে ১৯৩৪ সালে আমৃত্যু শান্তিনিকেতনের কর্ণধার রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘………শিক্ষাসংস্কার এবং পল্লী সঞ্জীবনই আমার জীবনের প্রধান কাজ।’                    

বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক অচলায়তন ভাঙতেই ৩০ অগস্ট থেকে ছাত্ররা তাঁদের দাবির সমর্থনে টানা আন্দোলন করছে। লাগাতর বৃষ্টি ও কতৃপক্ষের অশিক্ষকসুলভ অনড় মনোভাবকে উপেক্ষা করেই ছাত্র আন্দোলন অব্যাহত। তিনজন ছাত্রকে বহিষ্কারই এই আন্দোনের অন্যতম উৎস নয়। একাধিক প্রগতিশীল রবিন্দ্রানুসারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন উপাচার্য। আলাপনী মহিলা সমিতির ঘরে তালা লাগিয়ে তাঁদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। অভিযোগের পর অভিযোগ।সাম্প্রতিক কালে যে ঘটনাগুলি রবিন্দ্রসংস্কৃতিপ্রেমী রাবিন্দ্রীক নাগরিকদের আহত করেছে, সেগুলি হল, পৌষ মেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার অজুহাতে ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা একরকম তুলেই দেওয়া হয়েছে। এমনটাই মনে করেন প্রবীণ আশ্রমিকরা।লোকায়ত এই মেলা ধর্ম-বর্ণ, ব্রাহ্মণ-অবাহ্মণ, জাত-সম্প্রদায়, আদিবাসীদের সম্মিলিত মিলন মেলা। সেই মেলার মুক্তধারার স্বতস্ফূর্ত ঝরনার স্রোত বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ বাঁধ(পড়ুন দেওয়াল তুলে)দিয়ে আটকে দিয়েছেন।রবীন্রনাথ প্রবর্তিত বসন্ত উৎসবের ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’-র সবান্ধব আমন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছেন বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। অভিযোগ শিক্ষক, ছাত্র, প্রবীণ আশ্রমিক, বুদ্ধিজীবী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের।বিশ্বভারতীর বর্তমান প্রশাসকমণ্ডলী কি মুক্তধারার ঝরনাকে আটকে দিতে চাইছেন? যে ধারায় সিনান করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিশ্বভারতীতে উত্তরণ ঘটেছে। আরও উদাহারণ, বিশ্বভারতী প্রেসে তালা দিয়ে দিলেন উপাচার্য মহাশয়।যে প্রেস থেকে মুক্ত আলোর উজ্জ্বল শব্দ ঠিকরে পড়েছে।রবীন্দ্রনাথ যে আলোর বর্তিকা আমাদের সামনে এনেছিলেন। আমারা চিনেছি বাংলাকে। সারা বিশ্ব চিনেছে ভারতবর্ষকে। আমরা বিশ্বজনীন হয়েছি।

কলাভবনের ছাত্রদের ক্যান্টিনও বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ ।উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার আমলেই সমাবর্তনের সময় ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠেছে বিনা বাঁধায়! আমরা মনে করতে পারছি, পাঠভবন-সঙ্গীতভবন অঞ্চলের একটি রাস্তার নতুন করে নামকরণ করা হয়েছে। রাস্তাটি স্বামী বিবেকানন্দের নামে নামকরণ করা হয়েছে? নতুন করে রাস্তাটির উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। নতুন এই রাস্তার নামকরণ নিয়ে ব্যপক বিতর্ক হয়েছে। বিশ্বভারতী নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি রাস্তার নাম ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ কেন হবে? স্বামীজিকেও বাংলা তথা সারা ভারতের মানুষ শ্রদ্ধা করে। শিক্ষাবিদ, আশ্রমিক, সাধারণ নাগরিকরা জানতে চেয়েছেন, বেলুড় মঠে কি রবীন্দ্রনাথের নামে একটি রাস্তার নাম অনুমোদন করবেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কতৃপক্ষ। যে বেলুড় মঠের স্রষ্টা সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই।কিছুদিন আগে বিশ্বভারতীর একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রি তথা বাংলার বিজেপি নেতা সুভাষ সরকার বলে বসলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ কালো ছিলেন তাই তাঁর মা কোলে নিতেন না’। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ কালো ছিলেন না ফর্সা ছিলেন সে বিষয়ে হঠাত করে একজন বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রের জুনিয়র মন্ত্রী আল টপকা মন্তব্য করে বসবেন কেন? সমাজবিঞ্জানী এবং রাজনৈতিক বিশেষঞ্জরা বিশ্বভারতীর সামগ্রীক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপট নির্মাণকে সহজ বা হাল্কাভাবে গ্রহণ করতে চাইছেন না। উদার, উন্মুক্ত পরিশীলিত ভাষা, ধ্রুপদী সংস্কৃতির দখল নিতে চাইছে বিজেপি নামক একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। বিশ্বভারতীর গেরুয়াকরণ করতে চাইছে তাঁরা। যে কাজের দায়িত্ব সমর্পিত হয়েছে বিশ্বস্ত প্রশাসক উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর উপর। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরও দখল নিতে এসেছিল তাঁরা। কিন্তু না পেরে ব্যর্থ হয়ে বেছে নিয়েছে বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানকে।  

বাংলার মানুষ সঙ্ঘ পরিবারের সংস্কৃতি কয়েক মাস আগেই প্রত্যাখ্যান করে বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলা রামমোহন  বিদ্যাসাগর, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরী। তাদের চেনানো পথ থেকে এই বাংলার মানুষকে বিপথে হাটানো যাবে না। সেই পরম্পরায় তিন ছাত্রছাত্রীকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে বোলপুর স্টেশন থেকে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন ‘বলাকা’ গেট পর্যন্ত মিছিল করে এসএফআই। সেদিনের মিছিল শেষে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ বলেন, ‘’উপাচার্য পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলেই আন্দোলন উঠে যাবে।‘’ ব্যতিক্রমী বললেও কিছু বলা হয় না। কারণ বিশ্বভারতীর অচলায়তনের প্রতিবাদের এসএফআইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ছাত্র পরিষদ, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সহ সমস্ত বাম ধারার ছাত্র সংগঠন।ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি সৌরভ প্রসাদের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই বোলপুর শহরে এক বিরাট মিছিল হয়েছে।বড় মিছিল করেছে টিএমসিপিও। বিশ্বভারতীতে সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করার পথে এগচ্ছে টিএমসিপি। বীরভূমের তৃণমূল নেতা জামশেদ আলি খান জানিয়েছেন, রবীন্দ্র-আদর্শ অনুসরণ করে আমরা বিশ্বভারতীর মধ্যে সরাসরি রাজনীতি করা থেকে বিরত ছিলাম। কিন্তু, এই সুযোগে উপাচার্য বিশ্ব ভারতীতে প্রবল গেরুয়াকরণ শুরু করে দিয়েছেন। তাই আমাদেরও অন্য রকম ভাবতে হচ্ছে।‘’ বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সংগঠন ভিবিইউএফএ ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করার কথা জানিয়েছে। কলকাতা থেকে একাধিক নাট্যকার ও লেখক-সাহিত্যিকরা ছাত্রদের অবস্থান মঞ্চে গিয়ে তাঁদের সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন।প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর সহ অন্যান্য প্রথিতযশা আশ্রমিক উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিতর্কিত ভূমিকার সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছেন। এর পরেও কি আমাদের ব্যাখ্যা করে বলতে হবে, বিশ্বভারতীতে অচলায়তনের দায় কার?                                                            

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?