রাজ্যের আবেগপূর্ণ আমলা শিক্ষামন্ত্রী কতটা মানবিক!




দীপেন্দু চৌধুরী

বিপুল জনাদেশ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার আবারও রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। মনোনীত(এখনও নির্বাচিত নন)মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছে তাঁদের দল। ‘দুয়ারে সরকার’, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ রাজ্যের ইত্যাদি জনদরদী প্রকল্পে সরকার বিপুল সাড়া পাচ্ছে। জনমোহিনী এই সব প্রকল্পের জনপ্রিয়তায় দলগতভাবে তৃণমূল নেতৃত্বের ‘আত্মতৃপ্তি’-ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এটাও দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুটি দফতর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত সব চাইতে বেশি বিব্রত। এসএসকে বা শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকারা স্থায়ীকরণের দাবি ও বদলির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন।পাঁচ জন শিক্ষিকার এই আন্দোলনে সারা রাজ্যের মানুষ হতবাক।২৪ অগস্টের প্রতিবাদ আন্দোলনের পরে অযৌক্তিক বদলি আটকাতে কয়েকজন এসএসকে-র শিক্ষিকা মামলা করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।এর আগে সারা রাজ্য জুড়ে গত সাত-আট বছর শিক্ষক নিয়েগে ‘বহু চর্চিত অস্বচ্ছতা’-র কথা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতার অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে দফায় দফায় মামলা হয়েছে। তৃণমূলের প্রথম সরকারের আমলে ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন মরমী নাট্যব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ব্রাত্য বসু।আমরা মনে করতে পারি, সেই আমলে শিক্ষাবিদ প্রয়াত সুনন্দ সান্যালের শিক্ষা সংক্রান্ত একটি কমিটির শীর্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা। যত দূর জানা যায়, তিনি শিক্ষা দফতরের অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আমলেও শিক্ষা দফতর মামলা জটে জেরবার অবস্থায় ছিল।তাই শিক্ষা দফতর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কতটা অসহায় কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।         

সম্প্রতি বিধান নগরের বিকাশ ভবনের সামনে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকাদের বিক্ষোভ ও বিষ পানের ছবি রাজ্য সহ সারা দেশের মানুষ টিভিতে লাইভ দেখলেন।সংবাদ পোর্টাল সহ সামাজিক মাধ্যমে ছবি ভাইরাল হয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে গেল। আফগানিস্তানে তালিবান হামলার থেকেও সামাজিক মাধ্যমে সাময়িকভাবে শিক্ষিকাদের ‘বিষ পান’-র ট্রেন্ডিং ছিল অনেক বেশি। কেন শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের কয়কেজন শিক্ষিকাকে এই ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হল? আসুন আমরা প্রশ্নটা ‘ছুঁড়ে দি’ রাজ্যের আবেগপূর্ণ আমলা শিক্ষামন্ত্রীর দিকে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রসঙ্গে যে শব্দ বাক্য ব্যবহার করলাম সেগুলি প্রতিবেদকের নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। রাজ্যের বিরোধী দলের এক নেতার বলা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে নিজেরা শিশু শিক্ষার আঙিনায় থেকেও এই ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে গেলেন কেন? পাঁচ পাঁচজন শিক্ষিকা? তাঁদের বাবা-মা আছেন। ভাই-বোন আছে। বিবাহিত হলে স্বামী, সন্তান-সন্ততি আছে। সর্বোপরি অনুভূতি প্রবণ সমাজ আছে।মানুষ কতটা অবহেলিত বা উপেক্ষিত হলে তবেই এমনতর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়! তবে এটাও বলতে হয়, আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তকে সর্বজনগ্রাহ্য সমাজ অনুমোদন করে না। 

এসএসকে শিক্ষিকাদের বদলি সংক্রান্ত বিষয়টা বেশ কিছুদিন যাবৎ শিক্ষা দফতর ঝুলিয়ে রেখেছে।অভিযোগ ওই শিক্ষিকাদের। ওরা সকলেই শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের সদস্য।তাঁদের আরও অভিযোগ, স্থায়ীকরণ ও বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে তাঁরা কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু আবেগপ্রবণ আমলা শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। অভিযোগ শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের সদস্যদের। তাঁরা নবান্নের সামনেও বিক্ষোভ আন্দোলন করেন। তারপরে বার কয়েক ব্রাত্যবাবুরর বাড়ি গিয়ে দেখা না পেয়ে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মুঞ্চের সদস্যরা বিধান নগর থানায় ‘শিক্ষামন্ত্রী নিখোঁজ’ জানিয়ে ডায়েরি করতে যান।থানা থেকে জানান হয়, তাঁরা সেই ডায়েরি গ্রহণ করতে অপারগ। শিক্ষক ঐক্য মঞ্চের সদস্যরা কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করতে গেলে পুলিশ বাঁধা দেয়। গ্রেফতার করা হয় সংগঠনের সভাপতি মইদুলকে।শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের সভাপতি মইদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘’আমাদের দাবির কথা কেউ শুনছেন না। শিক্ষিকারা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ দেখানোয় কয়েকজনকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে, উত্তরবঙ্গে বদলি করে দেওয়া হল।‘’

এক শিক্ষিকা বলছেন, ‘’চুপ মানবিক শিক্ষামন্ত্রী রুষ্ট হয়েছেন। কেন বলব না বলুন? বাংলা মাধ্যমের এসএসকে শিক্ষিকা ছবি চাকীকে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থেকে জলপাইগুড়ির মাল ব্লকের একটি হিন্দি স্কুলে বদলি করে দেওয়া হল? পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকের আদিবাসী শিক্ষিকা জোনা টুডুকে পাঠানো হয়েছে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি ব্লকের একটি হিন্দি স্কুলে।‘’ ওই শিক্ষিকার বক্তব্য, আমরা মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতন পাই। বাড়ি থেকে অত দূরে গিয়ে সংসার চালাব কি করে? বাড়ি ভারা দিতে হবে। খাব কি?

২৪ অগস্ট বিকাশ ভবনের সামনের ঘটনার পরম্পরা মেনে উল্লেখ করি, ওই পাঁচ জন শিক্ষিকা ইঁদুর মারার অরগ্যানো ফসফরাস জাতীয় বিষ খেয়েছিলেন। গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁদেরকে শহরের দু’টি নামকরা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা ইঁদুর মারার বিষ খাওয়ার কথা জানান। আরজি কর হাসপাতালে এক জন শিক্ষিকার অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়েছিল।চিকিৎসকদের তৎপরতায় ওই শিক্ষিকার শারীরিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরে। এনআরএস হাসপাতালে আরও এক শিক্ষিকার আচমকাই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। তিনিও এখন স্থিতিশীল। বিস্তারিত উল্লেখ করার কারণ রাজ্যে অতীতে কোনও সরকারের আমলে এই ধরণের ঘটনার কথা প্রবীণ শিক্ষকরাও মনে করতে পারছেন না।                                    

যে ব্যক্তির পূর্বাশ্রম ছিল বামপন্থী ঘরানার সেই শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমরা দাবি আদায়ের আন্দোলনের মত-পথ, রীতি-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইছি।তিনি বলেছেন, ‘’সব কিছুরই রীতি-পদ্ধতি আছে।‘’ এসএসকে শিক্ষক-শিক্ষিকা, এমএসকে, আপার প্রাইমারি আন্দোলনের শিক্ষক-শিক্ষিকা, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানতে আগ্রহী শিক্ষামন্ত্রীর আন্দোলনের গ্রাফ কি? তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচ্চতায় মাঠে ময়দানে নেমে তাঁর কি আন্দোলনের অভিঞ্জতা আছে? আমাদের উল্লেখিত বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায় পার্শ্ব শিক্ষক ঐক্য মঞ্চের যুগ্ম আহ্বায়ক ভগীরথ ঘোষের বক্তব্য। ভগীরথ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘’সরকার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছেন।‘’                                      

রাজ্যের বিরোধী দলের নেতৃত্বের দাবি, আবেগপূর্ণ নাট্যব্যক্তিত্ব তথা চলচ্চিত্র পরিচালক আমলা শিক্ষামন্ত্রী চিত্রনাট্যের রসদ খুঁজবেন না আশা করি, ২৪ অগস্টের এসএসকে শিক্ষিকাদের মর্মন্তুদ আন্দোলনের ঘটনায়!সিপিএমের পক্ষে বলা হয়েছে,  ‘’ব্রাত্যবাবু এঁদের বিজেপির লোক বলে থাকলে মিথ্যে বলেছেন। এঁরা শিক্ষিকা। এঁদের রাজনৈতিক রঙে রাঙিয়ে না দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এই সংগঠনের সদস্যরা ৪ ফেব্রুয়ারি কসবায় মুখ্যমন্ত্রীর সভায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তখন আশ্বাস দিয়েছিলেন, ভোটের পরে তাঁদের বিষয়টা দেখবেন।পাঁচ জন শিক্ষিকা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন কেন? সরকারকে এই বিষয়টাও দেখতে হবে।‘’ বিজেপি নেতা কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার বলেন, ‘’শিক্ষিকাদের আন্দোলন দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে রাজ্য সরকার।‘’ কংগ্রেসের প্রদেশ নেতৃত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শিক্ষা দফতরের ব্যর্থতার দিক।উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মহুয়া দাসের অপসারণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষা দফতরের ব্যর্থতা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রবীণ এক অধ্যাপক বললেন, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বুদ্ধিজীবী মহলে বিদগ্ধজন।ননী খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু তিনি ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীতের বেদনা শুনতে ব্যর্থ। তাঁর জীবনের গ্রাফ দেখলে আমার কথার মানে খুঁজে পাওয়া যাবে।    

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?