ব্রিটিশদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আজ কতটা প্রাসঙ্গিক:





দীপেন্দু চৌধুরী

লেখা যখন আলোর মুখ দেখবে তার এক-দু’দিন পরে ভারতের স্বাধীনতা দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন হবে। আশা করা যায়।১৯৪৭-২০২১, ১৫ অগস্ট। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক তথা প্রজাতান্ত্রিক দেশের সচেতন নাগরিক আমরা। তাই প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমি বা আমরাও শিহরণ অনুভব করি। দেশের আরও পাঁচজন সহিষ্ণু দেহাতি মানুষের মতই বুঝে হোক অথবা রাষ্ট্রীয় আয়োজনের সহ-নাগরিক অনুভূতিতে। আচ্ছা একটা ছোট্ট প্রশ্ন দিয়ে শুরু করার অনুমতি চাইছি। গত কয়েক বছর দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। এই বছর ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের আগে দেশের কতজন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে? যেমনটা আমরা জানি ইউপিএ সরকারের আমলে সমাজকর্মী বিনায়ক সেনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ কারা দফতর সূত্রে খবর, ২০১৯ সালে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে মানবিক কারণে রাজনৈতিক বন্দি গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী এবং প্রফুল্ল চক্রবর্তীকে মুক্তি দেয় রাজ্য সরকার। তবু আলোচনার বিষয় হিসেবে থেকে যায়, স্বাধীন ভারতে কতজন রাজনৈতক বন্দি মুক্ত পেয়েছেন? ৩০-৪০ বছর বা ৫০ বছর জেলে আছেন এমন কতজন বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে রাজ্য সরকার অথবা কেন্দ্রীয় সরকার?  

আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির প্রাসঙ্গিকতা কেন আসছে? কারণ সম্প্রতি অশীতিপর মানবাধিকার কর্মী ও জেসুইট পাদ্রী স্ট্যান স্বামীর বন্দি অবস্থায় অসুস্ত হয়ে মৃত্যু। এই মৃত্যু চিরকালীন একটি কালো দাগ হয়ে রয়ে যাবে বলে মনে করছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখা। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি মেরি লেলর বলেছেন, স্ট্যান স্বামীর মতো এক জন সৎ মানবাধিকার কর্মীকে যে ভাবে মাওবাদী বলে দাগিয়ে দিয়ে তাঁর মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তার সপক্ষে কোনও কৈফিয়তই যথেষ্ট নয়। কোনও মানুষের এ ভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। আজীবন আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করেছেন প্রয়াত ৮৪ বছরের স্ট্যান স্বামী। মুম্বইয়ের হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে রাজনৈতিক বন্দি অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। গত ৫ জুলাই তাঁকে ‘শহুরে মাওবাদী’ তকমা দিয়ে গ্রেফতার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা। ইউএপিএ-র কঠোর ধারায় অভিযুক্ত করা হয় প্রবীণ এই সমাজকর্মীকে। ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর জেল হয় অশীতিপর মানবাধিকার কর্মী স্ট্যান স্বামী।  

ইউএপিএ আইনের উৎস খোঁজার দায় বর্তায় আমাদের উপরেও। কারণ এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে মোদী সরকারের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা। আদালতের পর্যবেক্ষণ, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কি ব্রিটিশ জমানার এই আইন সরকার রেখে দিতে চায়? প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘’সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগ করে এর অপব্যবহার করছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে কোনও দায়বদ্ধতা নেই।‘’ ১৫ জুলাই একটি মামলায় শুনানির সময় শীর্ষ আদালতের তিন বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ যে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেনুগোপালও একমত হয়েছেন। তিনি জানান, শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সুরক্ষা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্যই এই আইন কাজে লাগানো যেতে পারে। ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪(ক) ধারা তুলে দেওয়ার বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছেন মোদী সরকারের প্রখ্যাত আইনজীবী। ১৫ জুলাই প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা, বিচারপতি এ এস বোপান্না ও বিচারপতি হৃষীকেশ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে নিজের বক্তব্যে বেনুগোপাল বলেন, ‘’এই ধারা খারিজ করে দেওয়া প্রয়োজন। শুধু মাত্র নির্দেশিকা ঠিক করে দেওয়া দরকার। যাতে এই ধারার আইনি লক্ষ্য পূরণ হতে পারে।‘’ স্বাধীনতার পরে দেশের সব থেকে বেশি সমালোচিত ও বিতর্কিত মোদী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে এর বেশি প্রত্যাশা করাটাও আমাদের মূর্খতা হবে। প্রখ্যাত আইনজীবী বেনুগোপালের অবস্থান জানার পরে দেশের শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন রাখা উচিত কিনা এ বিষয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য জানতে চেয়েছে। ১৫ জুলাই প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘’বিবাদের বিষয় হল, এটা ঔপনিবেশিক আইন। স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশরা একে কাজে লাগিয়েছিল। মহাত্মা গাঁধি, বাল গঙ্গাধর তিলকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কি এই আইন এখনও দরকার?’’

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এখানেই তাঁর বক্তব্য শেষ করেননি। তিনি কেন্দ্রকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এর আগে নাগরিকদের মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তির আইনের ৬৬ক ধারার অপপ্রয়োগ করা হচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্ট ওই আইনের ধারা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে বলে তা খারিজ করে দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল ঠিকই, কিন্তু সিডিশন আইন রয়েই গেল। সেই এলিজাবেথান যুগে অর্থাৎ ১৫৯০ সালে ‘সিডিশন’ অথবা ‘প্রজা বিদ্রোহ’ কথাটা প্রথম ব্যবহার হয়। ব্রিটিশ সরকার ঔপনিবেশিক ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শায়েস্তা করতে অমানুষিক অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে ১৮৭০ সালে সিডিশন আইন ভারতে আমদানি করে। ভারতীয় দন্ডবিধিতে ১২৪(ক) ধারা যোগ করা হয়েছিল। এই আইন বলে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘চরমপন্থী’ (লাল-বাল-পাল) গোষ্ঠীর সদস্যদের যেমন গ্রেফতার করে জেলে পুরতে পেরেছিল। আবার অহিংস আন্দোলনের নেতৃত্বকেও জেলে পুরতে সহায়ক হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের আনা সংযোজিত এই ধারা। যেমন ভগৎ সিং থেকে শুরু করে মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধি, বাল গঙ্গাধর তিলক, পণ্ডিত নেহরু সহ আরও অনেককে কারাবাস করতে হয়েছে এই আইনের আওতায়। ব্রিটিশদের আনা তথাকথিত এই আইনের অপপ্রয়োগ বোঝাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা বলেন, ইতিহাস বলছে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার খুবই কম।

বিরোধীরা অনেকদিন আগে থেকেই অভিযোগ করছেন, সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধামাচাপা দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’-কে ব্যবহার করছে সরকার। সেদিন আদালতে এডিটর্স গিল্ডের তরফে আইনজীবী শ্যাম দিভান বলেছেন, ‘’আমরা একই বিষয়ে আদালতের নির্দেশিকা চেয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, ১২৪(ক) ধারা অসাংবিধানিক ও তার অপব্যবহার চলছে।‘’ উল্লেখ করা যাক, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে কয়েকজন কর্মরত সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।  

১২৪(এ) ধারায় অভিযুক্ত হয়ে আমি আনন্দিতঃ গাঁধিজি       

ইতিহাসের কিরকম সমাপতন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। প্রায় ১০০ বছর আগে আহমেদাবাদের সরকারি সার্কিট হাউসে ১৯২২ সালের ১৮ মার্চ একটি বিচারসভা (ট্রায়াল)বসেছিল। সেদিনের সেই আদালতের কাঠগড়ায় যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি পরে ‘মহাত্মা’ নামে পরিচিত হবেন। দেশের ‘জাতির পিতা’ নামে পরিচিত হবেন। এই বিচারসভার মেয়াদকাল ছিল মাত্র ১০০ মিনিট। কারণ ভারতের অহিংস আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধি বিচারপতির কাজ নিজেই অনেকটা সহজ করে দিয়েছিলেন। গাঁধিকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ধারায় তিন তিনটে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। ১৯২২ সালের ১৮ মার্চের বিচারসভার বিচারপতি সি এন ব্রুমফিল্ড গাঁন্ধিজির বক্তব্যকে উধৃত করে বলেছিলেন, ‘’হে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিখ্যাত নেতা। আমি বলতে চাই, আপনি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছেন। আমার পক্ষে এটা অসম্ভব যে আপনাকে বা আপনার বক্তব্যকে উপেক্ষা করা।অন্যান্যদের তুলনায় আপনি সম্পূর্ণভাবে অন্য এক ঘরানার ব্যক্তি। আমি কখনই আপনার মতো হওয়ার চেষ্টা করিনি। ভবিষ্যতেও করব না। কারণ আমি সেই স্থানে পৌছতে ব্যর্থ হব। সত্য ঘটনা যে লক্ষ্ লক্ষ ভারতবাসীর চোখে আপনি তাঁদের আপনজন। তাঁরা মনে করে আপনি একজন আদর্শবাদী নেতা। আপনার রাজনৈতিক ত্যাগের উচ্চতায় তাঁরা পৌঁছতে পারবে না। আপনার মতো অভিজাত ও ধ্রুপদী মানুষের সঙ্গে বিচার সভায় দেখা হওয়াটা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের। আমি এ কথা বলতে পারি, ‘I have to deal with you in one character only.’ তিনি বলেছিলেন, ‘’আলোচ্য বিষয়ের বিচারপতির আসনে বসে শুধুমাত্র বিচারের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। এটা আমার দায়িত্ব নয় যে আপনার সমালোচনা করি। অথবা অন্যান্য বিষয়ে মন্তব্য করি। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি আপনি যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন সেই তিনটে মামলার জন্য। সেই অভিযোগের বিচার করার।‘’

বিচারপতি সি এন ব্রুমফিল্ড সর্বমোট ছ’বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন গাঁধিজি ও তিলককে। প্রতিটি মামলায় দু’বছর করে কারাদন্ড(Simple imprisonment)-র রায়ে বিচারপতি ব্রুমফিল্ড জানিয়েছিলেন, সরকার বাহাদুর মনে করলে গাঁধিজির জেলের মেয়াদ পুনর্বিবেচনা করে কমিয়ে দিতে পারেন।

গাঁধিজি কি বলেছিলেন ১৮ মার্চ, ১৯২২ সালের পরাধীন ভারতের সাজানো আদালতের ট্রায়াল কক্ষে  দাঁড়িয়ে? তিনি বলেছিলেন, ‘’১২৪এ ধারা, যাতে অভিযুক্ত হয়ে আমি আনন্দিত, তা কার্যত ভারতীয় দন্ডবিধির রাজনৈতিক ধারার ‘রাজা’, নাগরিকদের স্বাধীনতা দমনের জন্যই যা তৈরি করা হয়েছে। কারও যদি কাউকে ভাল না লাগে তা হলে সেই মনোভাব সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁর থাকা উচিত, অন্তত যতক্ষণ তা নিয়ে তিনি হিংসা ছড়ানোর চক্রান্ত না করেন, হিংসার প্রচার না করেন বা হিংসায় প্ররোচনা না দেন।‘’

ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রনায়করা শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির রায়ের পরে কি ভাববেন! ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের আদৌ কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? বর্তমান সময়ের মানদণ্ডে? যে কথা শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন। এই আইনের আওতায় আছে, মিসা, পোটা, ইউএপিএ প্রভৃতি আইন। মনে পড়ছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে সুকুমার রায়ের লেখা ‘ননসেন্স’ কবিতার একটি লাইন, ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে,/ আইন কানুন সর্বনেশে……’।               

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?