শক্তিশালী বিরোধী ঐক্য বদলে দিতে পারে ২০২৪-র নির্বাচনী পরিসর



দীপেন্দু চৌধুরী

গণতান্ত্রিক ভারতের মানুষকে যারা বোকা বানাতে চাইছে, তাঁরা হয় ইতিহাসের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন না। অথবা শুনতে চাইছেন না। একটা দেশের ৭৫ বছরের পুরনো স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো মাত্র সাত বছরে বদলে গেছে? অথবা বদলে দেওয়া সম্ভব? এই ভাবনার গোড়ায় গলদ আছে ধরে নিতে হবে! বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পূর্ব ইউরোপের কয়কেটি দেশ একটা ব্যবস্থা ত্যাগ করে অন্য একটা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা বেশি দিন টেকেনি।সেই সব দেশের নাগরিক সমাজ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতের ক্ষেত্রেও একই অভিঞ্জতার প্রসঙ্গ নিয়েই আমাদের আলোচনা। স্লোগান উঠে এসেছে ‘এক না হয়ে উপায় নেই’। এই স্লোগানের মৃগয়াভূমি তৈরি হয়েছে সদ্য মুলতুবি হয়ে যাওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনে। বেশ কিছু দিন পরে বাদল অধিবেশনে সংসদের দু’টি কক্ষে বিরোধী জোটের ঐক্যবদ্ধ বা যূথবদ্ধ লড়াই আমাদের নজরে পড়েছে। সংসদীয় ঐক্যের সেই সুর-তাল-লয় ছন্দের পথেই বিরোধী শিবির সম্প্রতি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সংগঠিত আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই সিদ্ধান্তই আগাম বলে দিচ্ছে মোদী সরকারের নেতৃত্বে দেশের সংবিধান বা রাষ্ট্রকাঠামো বদলে দেওয়ার স্বপ্ন অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলা? সেও এক রুপকথার উপাখ্যান হয়েই থেকে যাবে! সম্প্রতি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে নিয়ে একটি অনলাইন বৈঠক করেন। ২০ অগস্টের ওই বৈঠকে সনিয়া গাঁধির বিজেপি বিরোধিতার অবস্থানের সঙ্গে একই সুরে ঐক্যের কথা বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে সহ আরও ১৬ টি বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। তাঁদেরও বক্তব্য নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে, সব রকমের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সরিয়ে রাখতে গেলে, বিরোধী দলগুলিকে এক সঙ্গেই পথে নামতে হবে।শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই তবেই সম উচ্চতায় তুলে আনা সম্ভব। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে বিরোধী জোটের সলতে পাকানো চলতি বছরের ২০ অগস্ট থেকে শুরু হয়ে গেল বলা যেতেই পারে। ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ হিসেবে ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনকে রাখা হয়েছে। ওই দিনের ভার্চুয়াল বৈঠকে কংগ্রেস সভানেত্রী বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, ‘’এর জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট ভাবে পরিকল্পনা শুরু করতে হবে।‘’ পাশাপাশি কেন্দ্রে বিজেপিকে সরিয়ে বিকল্প সরকার গঠন করতেই যে এই বিরোধী জোটের ডাক সেটাও সেদিনের ৪ ঘণ্টার অনলাইন আলোচনা সভায় সনিয়া জোরের সঙ্গে বলেছেন।

বৈঠকের পরে বিজেপি বিরোধী জোটের ১৯টি দলের নেতৃত্ব বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, আগামী ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর দেশ জুড়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামবে। প্রতিবাদ জানানোর সঙ্গে বিরোধী জোটের দাবি সমূহও ১০-১১ দিনের কর্মসূচীতে তাঁরা সামনে আনবে। ১৯টি দলের আন্দোলনের কর্মসূচী দেখে গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতীয় জনতা মানসিকভাবে শক্তি ফিরে পাচ্ছে বলা যায়। কারণ সংসদের বাইরে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির নেতৃত্বে এতটা জোরদার আন্দোলনের আহ্বান আমাদের নজরে পড়েনি। সাম্প্রতিক অতীত কেন গত সাত বছরে এই ধরণের প্রয়াসের কথা আমরা এক ছটাকও মনে করতে পারছি না। ১৯টি বিরোধী দল বেসরকারিকরণের প্রতিবাদ, কৃষি আইন প্রত্যাহার, পেগাসাসকান্ড সহ আরও কয়েক দফা দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাবে। দাবির তালিকায় এদিন বিরোধী জোটের সিদ্ধান্ত, কাশ্মীরে ৩৭০ রদের বিরোধিতা ও সিএএ-বিরোধী আন্দোলন করে যারা গ্রেফতার হয়েছে তাঁদের মুক্তির দাবিতেও তাঁরা বিক্ষোভ দেখাবে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাঁদের মুক্তির দাবিও জানাবে বিজেপি বিরোধী জোটের দলগুলি।

সনিয়া গাঁধির ডাকা ১৯টি বিরোধী দলের ভার্চুয়াল বৈঠকে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনার পরিবেশ থাকলেও সুর কেটেছে নেতৃত্বের প্রশ্নে। যেমন সনিয়ার বক্তব্যের পরেই বর্ষীয়ান এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার প্রস্তাবে বলেন, বিরোধী দলগুলির একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে এগোতে হবে। এক সঙ্গে একাধিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করে, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর্মসূচী তৈরি করা হোক। এর পরেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বলেন, পাঁচ-ছ’টি বিষয় ঠিক করে একটি ‘কোর গ্রুপ’ তৈরি করা হোক। বিরোধী দলগুলির এই ‘কোর গ্রুপ্র’ প্রতি মাসে এক-দু’বার বৈঠক ডাকবে। শরদ পওয়ার ও মমতার প্রস্তাব ভার্চুয়াল সভায় উপস্থিত সব নেতা মেনে নিলেও প্রশ্ন উঠে যায় প্রস্তাবিত ‘কোর গ্রুপ’-র নেতৃত্ব কে দেবেন। এই প্রসঙ্গে মমতা নিজের অভিঞ্জতার মানদণ্ডে গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘ভুলে যান, কে নেতা। আমরা কেউ নেতা নই। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সরিয়ে রাখুন। আসল হল, জনগণের স্বার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই। তাতে সকলকে এক সঙ্গে পা মেলাতে হবে। ইগো রাখলে চলবে না।’ রাজনৈতিক এই প্রস্তাবের পরে অত্যন্ত সফল কূটনীতিক হিসেবে উঠে আসা মমতার একটা গ্রাফ আমরা যদি ফিরে দেখি।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধানসভা ভোটে অভাবনীয় সাফল্যের কথা বারে বারে উঠে আসছে। বিজেপির ঝাঁকে ঝাঁকে শীর্ষ নেতারা ‘বংগাল ভূমি’-তে এসে সরকার গঠন করতে চেয়েছিল। যেমন প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা সহ একাধিক নেতা বাংলা সফর করেও শেষ রক্ষা হয়নি।বাংলা বিজেপির তথাকথিত রাজনীতি-সংস্কৃতি মেনে নিতে রাজি নয়। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে দল ভাঙ্গিয়ে কয়েকজন প্রথম সারির নেতাকে বিজেপি দলে সামিল করেও বিজেপি সরকার গঠন করতে পারেনি। তাঁদের প্ল্যান‘এ’- প্ল্যান‘ডি’ সব কিছুর ভরাডুবি হয়েছে। বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্যর্থ ‘মমতা’ নামের ক্যারিশ্মার কাছে। এই পর্যন্ত আমরাও একমত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একার লড়াইয়ে রাজ্যে তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন করতে পেরেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশে অন্যতম বিজেপি বিরোধী মুখ। এই সাফল্য তৃণমূল কংগ্রেসকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাচ্ছে, সর্বভারতীয় দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলতে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গোড়ায় গলদ হচ্ছে, কংগ্রেস নেতাদের দল বদল করিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন গড়ে তোলা।

আমাদের রাজ্যে তেতো হলেও সত্যি কংগ্রেসকে ভেঙ্গেই তৃণমূলের জন্ম। সম্প্রতি কংগ্রেসের মহিলা শাখার সর্বভারতীয় সভানেত্রী সুস্মিতা দেব নিজেদের পারিবারিক(তাঁর বাবা উত্তর-পূর্ব ভারতের খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা সন্তোষ মোহন দেব।)দল কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ‘দল বদলু’ সংস্কৃতিতে তৃণমূল ভিন রাজ্যের রাজনীতিতে কত্টা সাফল্য পাবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যথেষ্ট সন্দিহান। উদাহারণ দেওয়া যাক, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পঞ্জাব, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, অসম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে গত দু’দশকে তৃণমূলের কোনও নেতাই তৈরি হয়নি। সেই অর্থে দলের শিকড় প্রোথিত হয়নি, সংগঠন বলেও কিছুই নেই। তাই উত্তর-পূর্ব ভারত সহ দেশের অন্যান্য রাজ্যে কংগ্রেসকে ভেঙে নতুন দল করতে গেলে তৃণমূলের ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত হবে। যেমনটা ত্রিপুরা, মণিপুর অসমে সাম্প্রতিক অতীতে হয়েছে। কংগ্রেসের যে সব নেতা অতীতে ‘দল বদলু’ সংস্কৃতির শরিক হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে গিয়েছিল পরে তাঁরা ক্ষমতার লোভে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধিতায় তৃণমূল নেত্রীর প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা স্বীকার করেও দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থানের দিকগুলি উল্লেখ করতে হল জাতীয় স্বার্থে। মমতা নিজে অবিসংবাদী নেত্রী হিসেবে উঠে এলেও অসংখ্য স্ববিরোধিতার ঝোঁক তাঁর মধ্যে একাধিকবার দেখা গেছে। যে রাজনীতিকে প্রবীণ অভিঞ্জ রাজনৈতিক সাংবাদিকরা বলছেন, ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-র দুর্বলতা। মমতার রাজনীতি অনেকটাই আবেগ নির্ভর। যে রাজনীতি খুব সহজে গ্রাম বাংলার মা-মাসি, দিদির দল গ্রহণ করেছেন। এই ধ্রুবপদের সত্যও আমাদের স্বীকার করতে হবে।

সনিয়ার ডাকা ২০ অগস্টের ভার্চুয়াল বৈঠকে সমাজবাদী পার্টী ডাক পেলেও অখিলেশ যাদব নিজেও যাননি, কোনও প্রতিনিধিও পাঠাননি। বিরোধী ঐক্যের ক্ষেত্রে এটাও একটা দুর্বলতার দিক। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের দিক সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং মমতার একসঙ্গে অনলাইন বৈঠকে অংশগ্রহণ। যুযুধান দুটি দলের নেতা এক মঞ্চে। সম্মিলিত ঐক্যের ছবি বিজেপি বিরোধী জোটের শক্তি ‘ভারতীয় নির্বাচনী কুরুক্ষেত্র’ জয়ে অনেকটা সহায়ক হবে। কারণ কংগ্রেস-সিপিএম সহ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ সঙ্গে মমতার আবেগ। সিপিএম সম্প্রতি টুইট করেছে, ‘সংসদের বাদল অধিবেশন ছিল গণতন্ত্রের চরমতম অপমান’। সিপিএমের টুইট বার্তা, বাদল অধিবেশন ছিল সমস্ত বিরোধী দলগুলির কাছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ‘লিটমাস টেস্ট’। আশার কথা দেশ ফ্যাসিবাদী শক্তির দাপটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বিরোধী জোটের ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া। তিনি অনলাইন বৈঠকে বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেক দলের কিছু না কিছু নিজস্ব বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু সময়ের দাবি মেনে আমাদের দেশের জন্য চিন্তা করাটাই প্রধান অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত। তবেই আমরা বিভাজনকামী শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে পারব।’                                                                                                        

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?