স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গেরুয়া বাহিনীর তাণ্ডব
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গেরুয়া বাহিনীর তাণ্ডব :
দীপেন্দু চৌধুরী
প্রথমে দিল্লি পুলিশ বলেছিল, ৮ অগস্ট দিল্লিতে ‘ভারত জোড়ো আন্দোলন’-এর
সমর্থকরা খুনের হুমকি দিয়ে স্লোগান দিয়েছে কিনা পুলিশ জানে না! পুলিশের অন্যতম এক কর্তা
দীপক যাদব দাবি করেছিলেন, ‘’সভার অনুমতি ছিল না। তাই পুলিশ জানত না।‘’ প্রশ্ন উঠছে
তাহলে দিল্লি পুলিশকে যন্তর মন্তরের সভা থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে
৬ জনকে গ্রেফতার করতে হল কেন? উত্তর খুব পরিষ্কার, সংবাদ মাধ্যমের চাপ, কংগ্রেস সহ
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিবাদ। দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী সেদিন ইউ টিউবের
ন্যাশন্যাল দস্তকের সাংবাদিক আনমল প্রীতমের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতৃত্ব যে
আচরণ করেছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি সংসদে বাদল অধিবেশন চলছিল। তিন কৃষি
আইন বাতিল, পেগাসাস কান্ড ইত্যাদি বিষয়ে সরকার এমনিতেই সাঁড়াশি চাপে আছে। বিরোধীদের
ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সামলাতে না পেরে সরকার সংসদের বাদল অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করে দিয়েছে।
এর থেকে বোঝাই যায়, দেশের ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবসের আগে দিল্লিতে আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজন
চাইছে না বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। ৮ অগস্টের ঘটনায় দিল্লি পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে,
তাঁরা হলেন দিল্লি বিজেপির প্রাক্তন মুখপাত্র ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়,
‘হিন্দু ফোর্স’ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি দীপক সিংহ, ‘সুদর্শন বাহিনী’-র প্রধান বিনোদ
শর্মা, ‘সেভ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান প্রীত সিংহ, দীপক কুমার এবং বিনীত বাজপেয়ী।
ধৃত শীর্ষ নেতাদের সংগঠনের নাম শুনেই অনুমান করা যায় তাঁরা হিন্দুত্ববাদী দলের শাখা
সংগঠনের সদস্য।
৮ অগস্ট সংসদ ভবনের এক কিলোমিটারের মধ্যে গেরুয়া বাহিনীর এই
সভার ভিডিও বিভিন্ন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিনের ঘটনার
ভিডিও থেকে জানা যায়, দিল্লির প্রাক্তন বিজেপি মুখপাত্র অশ্বিনী উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে
‘ভারত জোড়ো আন্দোলন’-র সমর্থকরা স্লোগান দিচ্ছিল, ঔপনিবেশিক যুগের কয়েকটা আইন বাতিল
করতে হবে। যেমন দেশের বিবাহ আইনের পরিবর্তে ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ চালু করতে হবে। এই
আইন চালু হলে ভারতীয় বিবাহ আইনের সমর্থনে আলাদা ভাবে দু’তিনটি ধর্মের যে বিবাহের মর্যাদা
এবং স্বীকৃতি চালু আছে সেটা বন্ধ করে দিতে পারবে সরকার। এই দাবি বিজেপির দীর্ঘ দিন
ধরে করে আসছে।ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে সেদিন আওয়াজ তোলা হচ্ছিল ‘হিন্দুস্তানে
থাকতে হলে জয় শ্রীরাম বলতে হবে’। হুমকী দেওয়া হচ্ছিল তা না হলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে
এই দেশে থাকতে হবে। গেরুয়া বাহিনীর শোভাযাত্রা থেকে সেদিন স্লোগান সম্বলিত ছাপা ইস্তেহারও
বিলি করা হয়।রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র যন্তর মন্তরে গেরুয়া বাহিনীর সভা ও শোভাযাত্রা ছিল
সংসদ ভবনের এক কিলোমিটারের মধ্যে। উল্লেখ করতে হচ্ছে এই জন্য যে সংসদ ভবনের নিরাপত্তার
জন্য সারা বছর দিল্লি পুলিশের বাড়তি সতর্কতা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। তারপরেও তখন
সংসদের বাদল অধিবেশন চলছিল। অথচ ৮ অগস্টের গেরুয়া বাহিনীর সভা বা শোভা যাত্রার বিষয়ে
পুলিশের কাছে কোনও খবর ছিল না? এটা মেনে নিতে হবে? সম্প্রতি দিল্লিতে এক দলিত কন্যার
মৃত্যুকে ঘিরেও বিতর্ক শুরু হয়েছে। একটি ন’বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার অভিযোগ
উঠেছে।
দলিত মেয়েটি শ্মশান ঘাটে ওয়াটার কুলারে জল আনতে গিয়েছিল। তার
কিছুক্ষণ পরে মেয়েটির পরিবারকে শ্মশানে আস্তে বলা হয়। অভিযুক্ত শ্মশান পুরোহিত রাধেশ্যাম
মেয়েটির পরিবারকে শ্মশানে আস্তে বলে। এই ঘটনার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের হাথরসের স্মৃতি
উসকে দিয়ে দলিত মেয়েটির পরিবারকে জোর করে মেয়ের দেহ সৎকার করতে বলা হয় বলে অভিযোগ করছে
মৃত দলিত মেয়েটির পরিবার। এই ঘটনাতেও দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
কাটুয়া, হাথরস, উন্নাও, দিল্লির ধর্ষণ নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
বা তার ডান হাত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহকে কোনও বক্তব্য রাখতে দেখা যায়নি।
বিরোধীরা আরও নজির টেনে আনছেন অতীতের। তাঁদের বক্তব্য গেরুয়া
বাহিনী ও হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি অমিত শাহের পুলিশের যে দুর্বলতা আছে, সেটা একাধিকবার
প্রমাণ মিলেছে। গেরুয়া বাহিনী সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের দিকে বন্দুক তাক করে একই
ধরণের স্লোগান দিয়েছিল।দিল্লি পুলিশ এখনও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন তাই
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহই শেষ কথা। দিল্লি দাঙ্গার সময়ও একইভাবে ‘হিংসা’ ছড়ানোর
অভিযোগ ছিল। মাথায় ফেট্টি বাঁধা গেরুয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে। দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন মানুষের
মৃত্যু হয়। ‘দিল্লি মাইনরিটি প্যানেল’ সম্প্রতি বলেছে, দাঙ্গার সময় পুলিশ দোষীদের গ্রেপ্তার
না করে, উল্টে আক্রান্তদের গ্রেফতার করতে বেশি তৎপর ছিল। তাঁদের ভাষায়,
‘Were complicit and abetted the attacks.’
৮ অগস্ট দিল্লিতে খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হতে হয় ইউটিউব-র ন্যাশন্যাল
দস্তকের সাংবাদিক আনমল প্রীতমকে। প্রীতম জানিয়েছেন, ‘’আমাকে অকস্মাৎ ১৫০ জন মিলে ঘিরে
ধরে। তারপর তাঁরা বলে, ‘তোর মুখে কি ‘দহি’(দই) জমে গেছে যে তুই ‘জয় শ্রী রাম’ বলবি
না?’’ সাংবাদিক প্রীতম ভারত জোড়ো আন্দোলনের সমর্থকদের কাছে প্রশ্ন করেছিল, আপনারা খাদ্য
নিরাপত্তা, বেকারদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছেন না কেন? ঠিক তখনই ন্যাশন্যাল দস্তকের
সাংবাদিককে ওরা ঘিরে ধরে। এবং ‘জয় শ্রী রাম’ বলার জন্য ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে বলে
জনিয়েছে সে।
প্রীতম নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে লিখেছে, ‘আমি যখন পছন্দ করব
ঠিক তখনই ‘জয় শ্রী রাম’ বলব। বল প্রয়োগ করে আমাকে বলানো যাবে না। বা আমাকে ঘেরাও করে
রাখলেও আমি বলব না।’ ৮ অগস্ট দিল্লিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের উত্তেজনা ছড়ানোর প্রতিবাদ
জানিয়েছেন নাগরিক আন্দোলনের বিভিন্ন নেতৃত্ব। মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দার টুইট করেছেন,
‘জাত সম্প্রদায়’-কে বিষয় করে একদল উন্মত্ত মানুষ রাজধানীর বুকে প্রকাশ্যে ‘ঘৃণা’ ছড়াচ্ছে,
স্লোগান দিচ্ছে। দিল্লি পুলিশ তাদের বাঁধা দিল না। এটাই হচ্ছে বর্তমান শাসকের চরিত্র।‘’
সিপিআইয়ের শাখা সংগঠন ‘ন্যাশন্যাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান মুসলিম’-এর সাধারণ সম্পাদক
অ্যানি রাজা, সমাজকর্মী শবনম হাশমী, মোহিনী গিরি, নীবেদিতা ঝা, লীলা দাবেরূ, যোজনা
কমিশনের প্রাক্তন সদস্য সৈয়দা হামীদ ও সাংবাদিক সুখপ্রীত কাঁহালো আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবাদ
জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, যেভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতৃত্ব প্রকাশ্যে রাস্তায়
‘ঘৃণা’ এবং হিংসা ছড়াচ্ছে দিল্লি পুলিশ তাদের বাঁধা দিল না? সাংবাদিক আনমল প্রীতমের
সঙ্গে যে ধরণের ব্যবহার করা হয়েছে সেই ঘটনারও তীব্র নিন্দা করেছেন তাঁরা। ভারতের মতো
একটি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে ‘হিন্দুত্ববাদী’-র প্রকাশ্যে হুমকির প্রতিবাদ
সমস্ত স্তরের মানুষেরই করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।
Comments
Post a Comment